জাকারবার্গ কি আইডিয়াশূন্য হয়ে পড়ছেন?
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্ট দিয়ে মেটা ভেরিফাইড নামের একটি সেবার ঘোষণা দেন মেটা সিইও মার্ক জাকারবার্গ। এই ভেরিফিকেশন সেবা অনেকটাই টুইটারের ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা টুইটার ব্লুয়ের অনুকরণে তৈরি। জাকারবার্গের এই পদক্ষেপ কি প্রমাণ করছে মেটা নতুন কিছু উদ্ভাবনের আইডিয়া হারিয়ে ফেলছে?
মেটা ভেরিফাইড কী?
জাকারবার্গ মেটা ভেরিফাইডকে এমন এক সেবা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, 'যার মাধ্যমে ব্যক্তি সরকারি আইডির মাধ্যমে তার অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করতে পারবেন, ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টের প্রমাণ হিসেবে নীলরঙা পাবেন, এবং একইসাথে সরাসরি কাস্টমার সার্ভিস সহায়তাও পাবেন।' অন্য দেশে এই সার্ভিস চালু করার আগে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জিল্যান্ডে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হবে। অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশনের জন্য ওয়েবসাইটে মাসে ১২ ডলার এবং আইওএস-এর ক্ষেত্রে ১৫ ডলার ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। জাকারবার্গ জানান, "এই নতুন ফিচারটি মেটা প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ও অকৃত্রিমতা বাড়াবে।"
সার্ভিসটির বিজ্ঞাপনেও প্রতিষ্ঠানটি একে 'ইন্সটাগ্রাম এবং ফেসবুকে আরও বেশি উপস্থিতি বাড়ানোর উপায়' হিসেবে প্রচারণা চালিয়েছে, যার অর্থ যারা যারা এই সার্ভিসে সাবস্ক্রাইব করবেন তারা অন্যান্য সাধারণ ব্যবহারকারীদের তুলনায় সার্চ রেজাল্ট এবং রিকমেন্ডেশনে 'বেশি রিচ এবং ভিজিবিলিটি' পাবেন। তবে ইন্সটাগ্রাম প্রধান অ্যাডাম মোসেরির মতে, "এর মানে এই না যে, আপনি যদি বড় কোনো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হন, তবে বিশাল সুবিধা পাবেন। মেটা ছোট আকারের কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য এই সুবিধা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে, কারণ আমরা চাই তারাও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকুক।" তবে নতুন এই সার্ভিসের সাথে যে 'ব্লু টিক' সুবিধা আসবে, তা পুরনো ব্লু টিকধারীদের জন্য কোনো সমস্যা বয়ে আনবে না। সেগুলো পুরনো নিয়ম অনুযায়ী ভেরিফাইড অবস্থাতেই থাকবে।
মেটা কি আইডিয়াশূন্য হয়ে পড়ছে?
অন্য কোম্পানিকে কিনে না নেওয়া হলে, বহুদিন ধরেই অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে বিভিন্ন আইডিয়া নকল করার অভ্যাস রয়েছে ফেসবুক তথা মেটার। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনেট স্টাডিজের অধ্যাপক টামা লিভার জানান, "একেবারেই সাধারণ কিছু সুবিধা দিয়ে টুইটারকে এর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যাওয়ার আইডিয়া দেখার পর জাকারবার্গও একই জিনিস করার চেষ্টা করছেন। তবে টুইটারের এই সাবস্ক্রিপশন মডেলের এই অনুকরণ বাস্তবে দেখায় যে, তারা 'নতুন আইডিয়া উদ্ভাবনের অভাবে ভুগছে,' বিশেষ করে তারা যখন কর্মী ছাঁটাই করে সেই টাকা মেটাভার্স তৈরি করার জন্য ঢালছে, যেটির পেছনে তেমন কারোরই আগ্রহ নেই।"
সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ফিচারের জন্য ভোক্তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বলে জানান সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষক ম্যাট নাভারা। তিনি জানান, "স্ন্যাপচ্যাট, ডিসকর্ড এবং টুইটারের সাবস্ক্রিপশন পরিকল্পনার পর মেটাও নির্দ্বিধায় নিজেরাও এটি শুরু করবে। তবে ঝুঁকি হলো এটা সফল হবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।"
ব্লুমবার্গের বিশেষজ্ঞ পার্মি ওলসন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, "জাকারবার্গ হয়তো একজন নির্লজ্জ 'চোর', কিন্তু তার 'কৌশল কাজ করে'। রিলস কিংবা স্টোরির মতো অনেকগুলো ফিচার জাকারবার্গ চুরি করেছে, যেগুলো ইন্সটাগ্রামে ভালোই সফল হয়েছে। এটা হয়তো জাকারবার্গের নতুন সাবস্ক্রিপশন সার্ভিসেও কাজ করবে। প্রথম দেখায় যদিও একে তেমন আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছে না। অন্য কোম্পানির জন্য যা সফল হয়নি, তা জাকারবার্গ মেটার ক্ষেত্রে সফল বানিয়েছেন এরকম বহু উদাহরণ আছে। টুইটারের সিইও এলন মাস্ক 'টুইটার ব্লু'-এর মাধ্যমে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন, আর জাকারবার্গও সেই পথ ধরেছেন। অনলাইনে লোকজনের টাকা খরচের প্রবণতা কিছুতা ঢিলে হয়ে যাওয়ায় এখন এই সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামিয়ে সেটি মেটাভার্সের পেছনে খরচ করবেন।"
সামাজিক মাধ্যমে সাবস্ক্রিপশন চালু করা নিয়ে সমালোচকরা কী বলছেন?
ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জফ্রি ফাউলারের মতে, জাকারবার্গ এর মাধ্যমে 'ডন কর্লিওনি'র মতো অনুভূতি তৈরি করছেন। "জাকারবার্গ এমন এক অফার নিয়ে এসেছে যা আপনি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। টাকা দেও: নাহলে ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টগুলো হ্যাকারদের হাতে ছেড়ে দেও।"
ফাউলার জানান, "ফেসবুক এর ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকিকে এক ধরনের ব্যবসার সুযোগে পরিণত করতে চাচ্ছে।" যদিও সাধারণ ব্যবহারকারীদের ব্যবহারের জন্য কোনো অর্থ তারা নিচ্ছে না, কিন্তু অ্যাকাউন্ট লক হয়ে যাওয়া কিংবা হ্যাকারের হাত থেকে 'বাঁচানোর' মাধ্যমে তারা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে।"
সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থা চালু হলে ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে বলে জানান সাইবারনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। আইডেন্টিটি থেফট রিসোর্স সেন্টারের চিফ অপারেটিং অফিসার জেমস লি সিএনবিসিকে জানান, "ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় সময় আর অর্থের বিশাল অপচয় হবে। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আর ফিশিং রয়ে যাবেই, ফলে ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টগুলোও যে খুব বেশি নিরাপত্তা পাবে তা নয়। অনেক অপরাধীই থাকবে যারা খুব সহজেই এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া পেরিয়ে যেতে পারবে। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা কোনোভাবেই উচিৎ নয়।"
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই সাবস্ক্রিপশন মডেলের ফলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুইটি স্তর তৈরি হবে। সাইবারনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ইনফারসাইটের চিফ ইনফরমেশন সিকিউরিটি অফিসার পিটার ট্র্যান টাইমকে জানান, "তারা নিরাপত্তাকে বিজনেস মডেলে রূপান্তর করেছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এর ফলে নিরাপত্তা আছে এবং নিরাপত্তা নেই, এরকম এক অবস্থা তৈরি হবে।" ট্র্যানের মতে, 'এই পে-টু-প্লে ব্যবস্থা তার দেখা নিরাপত্তাকেন্দ্রিক সবচেয়ে জঘন্য সিদ্ধান্ত'।
সূত্র: দ্য উইক