সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে ‘মাইন্ড রিডার’ নিয়োগ দিয়েছিল সিআইএ
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য নানা ফন্দিফিকির এঁটেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল সোভিয়েতদের মন পড়তে পারা তথা 'মাইন্ড রিডিং'। এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানিয়েছে হিস্টোরি ডটকম।
১৯৭০-এর দশকে শুরু হয় এ প্রোগ্রাম। দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ), সেনাবাহিনী ও ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গবেষণাগারে ও পরে মেরিল্যান্ডের এক সামরিক ঘাঁটিতে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে দাবি করা এমন মানুষদের ওপর গবেষণা শুরু করেছিল।
২০১৭ সালে প্রজেক্ট স্টার গেট নামক এ প্রোগ্রামের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ পৃষ্ঠার নথি উন্মুক্ত করে সিআইএ। ১৯৯৫ সালে প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দেয় মার্কিন সরকার।
১৯৭২ সালে সোভিয়েতদের একটি গোপন প্রতিবেদন হাতে পায় মার্কিন সেনাবাহিনী। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন নাকি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা ও সাইকোকাইনেসিস গবেষণার ওপর প্রচুর অর্থ ঢালছে। সাইকোকাইনেসিস বা মনোগতিসঞ্চার হচ্ছে মনের শক্তি দিয়ে কোনো বস্তুকে নাড়াচাড়া করানো। এ ঘটনার পর ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ নিজেদের গবেষণা শুরু করে সিআইএ।
ততদিনে ইসরায়েলি সাবেক প্যারাট্রুপার উরি গ্যালার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তার তথাকথিত মনোগতিসঞ্চারের ক্ষমতার জন্য। তাকে পরীক্ষার জন্য আমন্ত্রণ জানান মার্কিন গবেষকেরা। গ্যালার মনের শক্তি দিয়ে ধাতুর চামচ বাঁকিয়ে ফেলতে পারতেন বলে দাবি করতেন, যদিও অনেকে তার ক্ষমতার কথা বিশ্বাস করেননি। তবে সিআইএ'র আগ্রহ ছিল গ্যালারের আরেকটি ক্ষমতার ওপর: উরি গ্যালার অন্যের মন পড়তে পারতেন, এমনকি নিজের মন দিয়ে অন্যের মনের দখলও নিতে পারতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা ও সাইকোকাইনেসিস গবেষণায় গতি আনতে অন্যতম ভূমিকা ছিল গ্যালারের। ১৯৭৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লিভারমোরের এক ল্যাবরেটরিতে একাধিক সাইকোকাইনেসিস পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে মনোজগৎ নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে দেয় সিআইএ। এরপর মার্কিন সেনাবাহিনীর দায়িত্বে পড়ে প্রোগ্রামটি। সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে প্রোগ্রামের জন্য তহবিল সরবরাহ করেছিল ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি।
রিমোট ভিউয়ার তথা দূরের জিনিস মনশ্চক্ষুতে দেখতে পাওয়া মানুষেরা ছিলেন এ প্রোগ্রামের অন্যতম অংশ। এদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন সেনা কর্মকর্তা জোসেফ ম্যাকমনিগল। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সালে তিনি সরকারের অতি গোপনীয় প্রায় ৪৫০টি মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তার মিশনের মধ্যে ছিল ইরানে জিম্মিদের অবস্থান শনাক্ত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এক সন্দেহভাজন কেজিবি এজেন্টকে ধরতে সিআইএকে সহায়তা করা। মনের চোখে দেখতে পারা আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন অ্যাঞ্জেলা ডেলাফিওরা ফোর্ড।
১৯৮০'র দশকে মার্কিন সরকারের এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট বিষয়ক খবর বাইরে প্রকাশিত হতে শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে পেন্টাগন মনোগত গবেষণায় অর্থ ব্যয় করার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। শেষে ১৯৯৫ সালে সিআইএ এ ধরনের প্রোগ্রাম বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ওই প্রতিবেদনে সিআইএ স্টার গেটকে ব্যর্থ হিসেবে ঘোষণা করে। সেখানে জানানো হয়, 'এ ধরনের মানসিক ক্ষমতার কোনো অস্তিত্ব প্রদর্শন করা হয়েছিল কি-না তা অস্পষ্ট।' তবে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিছু কিছু পরীক্ষা সফল হয়েছিল।
সিআইএ'র প্রতিবেদনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, মনের চোখে দেখা ব্যক্তিরা যেসব তথ্য সরবরাহ করেছিলেন, সেগুলো খুব বেশি 'অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য' ছিল, এবং কোনো 'কার্যকর গোয়েন্দাতথ্য' উৎপাদন করেনি।
তবে মানব মনের ক্ষমতা নিয়ে মার্কিন সরকারের অনুসন্ধান ওই বছরই থেমে যায়নি। ২০১৪ সালে দেশটির অফিস অভ নাভাল রিসার্চ চার বছর মেয়াদি নতুন একটি প্রোগ্রাম শুরু করে। এ প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল নৌবাহিনী ও মেরিন সদস্যদের ইনটুইশনের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করা। ইনটুইশন 'ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়' বা 'স্পাইডি সেন্স' নামেও পরিচিত।