তেপান্তরের তৃণভূমি, পর্যটকহীন পথ আর ফাঁকা রেস্তোরাঁ: বসন্তে কিশোরগঞ্জের হাওর
ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি প্রায় ফাঁকা। কেবল কিশোর টিকটকার রিহান উদ্দিনকে রাস্তার ওপর নাচতে দেখা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে সমান আগ্রহে তার বন্ধুরা সে নাচ রেকর্ড করছে।
রাস্তায় স্থানীয় ছোকরাদের বাইক নিয়ে হল্লার কোনো চিহ্ন নেই, বর্ষাকালেও থাকে না। মাঝেমধ্যে রিহান ও তার বন্ধুদের পাশ কাটিয়ে কয়েকটি অটোরিকশা চলে যাচ্ছে।
২৯.৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি তৈরি করা হয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটাতে।
রাস্তার দুধারে সবুজ তৃণভূমিতে গরুর বড় বড় পাল চরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে অস্থায়ী কিছু ঘর — খুব সম্ভবত গরুর ওপর নজর রাখতে বানানো হয়েছে।
পুরো এলাকা সবুজ জমিতে ভরপুর। তবে সড়কের ধারের তৃণভূমিতে, বিশেষ করে ব্রিজের কাছে গরুগুলোকে চরানো হচ্ছে ব্রিজের তলায় জমে থাকা পানি সহজে পাওয়া যাবে বলে।
হাওর বলে হয়তো চারদিকে পানির প্রত্যাশ্যা করবেন আপনি। তবে আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। পানি ধীরে ধীরে শুকাতে শুরু করেছে। পুরো হাওর হয়ে উঠেছে বিশাল একটা শষ্যখেত।
বর্ষায় পানিতে ডুবুডুবু থাকে হাওরটি। কিন্তু শীত ও বসন্তে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ নেয় এটি।
'দেখে মনে হচ্ছে সুইজারল্যান্ড!' আমার সফরসঙ্গীর অবাক গলা শোনা গেল। তার কথায় অবশ্য হাসলাম না, কারণ সুইজারল্যান্ড কস্মিনকালেও দেখা হয়নি আমার। কিন্তু যেখানটাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে পুরো জায়গাটাকে মনে হচ্ছিল একটা শ্যামল স্বর্গ।
কিন্তু এ সৌন্দর্যের প্রশংসা করার জন্য তখন সেখানে রিহান ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু সেও অবশ্য তখনো তার নাচেই মজে আছে।
আমাদের অটোরিকশাচালকই গাইডের কাজ করছেন। এ রাস্তায় নিয়মিত যাওয়া-আসা তার।
'এখন এখানে কারও টিকিটি দেখতে পাবে না। কিন্তু বর্ষাটা আসতে দিন, এ জায়গায় মানুষ গিজগিজ করবে,' ভদ্রলোক বললেন। 'এখান থেকে যদ্দূর চোখ যায়, সব পানিতে ভরে যাবে।'
এখানে-সেখানে অতীতে পানির অস্তিত্ব থাকার আভাস মাঝেমধ্যে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। বাঁশের সাঁকো দাঁড়িয়ে আছে শুকনো জায়গার ওপর। এসব সাঁকো হাওরের অনেক বাসিন্দাকে মূল সড়কের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
আপাতত এ সাঁকোগুলোর যত্রতত্র মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে অদ্ভুত দেখালেও বর্ষায় এগুলোই সবার ভরসা হয়ে ওঠে।
শস্যখেতের তুলনায় মানুষের ঘরবাড়ি ভূমি থেকে বেশ উপরে। কিন্তু বর্ষায় এ আবাসস্থলগুলো ছোট ছোট দ্বীপে পরিণত হবে, সারাক্ষণ থাকবে বন্যার হুমকিতে।
বাংলাদেশের আর দশটা জেলায় যেরকম সবুজ দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের হাওরের সবুজেও তার সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু স্রেফ সবুজ নয়, এ সবুজের বিস্তৃতিটাই এখানকার আশ্চর্যের বিষয়। এ যেন এক তেপান্তরের মাঠ, কিন্তু পুরোদস্তুর সবুজে মোড়ানো।
তার সঙ্গে যোগ হয়েছে টাটকা বাতাস ও স্থানীয় বাসিন্দাদের আতিথেয়তা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ জায়গাটা বিখ্যাত বর্ষাকালের রূপের জন্য। বর্ষাকালে এখানে তিন মাসের পর্যটক মৌসুম চলে।
তবে আমাদের কাছে যা মনে হলো, শুকনো মৌসুমে এ জায়গাটা যে কতটুকু সৌন্দর্য উথলে দিতে পারে, তা নিয়ে মানুষের কোনো ধারণাই নেই। বোধহয় মানুষের এ ধরনের শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ ভালো লাগে না।
অষ্টগ্রামের জিরো-পয়েন্টের কাছে কয়েকটা রেস্তোরাঁর দেখা মিলল। ম্যানেজার যাদের সঙ্গেই কথা হলো, জানালেন ব্যাবসা ভালো যাচ্ছে না। আসলে বর্ষাকাল ছাড়া এখানে আর কোনো মৌসুমে ব্যাবসা খুব একটা জমে না।
কিন্তু এখন হোটেলসংশ্লিষ্টরা আরও বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন, কারণ গত পানির মৌসুমেও খুব বেশি পর্যটক আসেননি।
'কাস্টমার একদমই নাই। পর্যটক মৌসুম শুরু হতে আরও প্রায় পাঁচ মাস। আগামী কয়েক মাস অবস্থা আরও কঠিন হবে। কোনো কোনো দিনতো এক পয়সারও বিক্রিবাট্টা হয় না,' ফুড ব্যাংক রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক ঝলক সাহা বললেন।
'আমরা পুরো লসের ওপর চলতেছি। আমাদের ব্যাবসার মূল মৌসুম তিন থেকে চার মাস (মোটামুটি জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর)। কিন্তু গত বছর আমাদের কষ্ট হয়ে গেছিল বেশি পর্যটক না আসার কারণে। সেই থেকে আমরা লসের ওপরই আছি,' বলতে থাকেন তিনি।
ক্যাফে কিং স্পেশাল-এর রাতুল মিয়া জানালেন, 'আমাদের জন্য এটা একটা মৌসুমি ব্যাবসা; মোটামুটি মাস তিনেক চলে। কিন্তু গত বছর পর্যটকের সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। তাও আমরা কোনোরকম ওই ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছি।'
নিরিবিলি রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড কফি হাউজ-এর মালিক মাহফুজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলাম, গত বছর ভরা মৌসুমেও ব্যাবসা কেন চলল না। 'বন্যা একটা কারণ হতে পারে, যদিও এ এলাকায় বন্যার প্রভাব পড়েনি। তারপরও, বন্যা নিয়ে মানুষের মধ্যে আশঙ্কা ছিল, আর পানির স্তরও অনেক বেশি ছিল,' তিনি জানালেন।
তবে প্রেসিডেন্ট রিসর্ট-এর ব্যবস্থাপক গুলজার হোসেন জানান, তাদের ব্যাবসা ভালোই ছিল। গত বছর মিঠামইনে রেস্তোরাঁটি চালু হয়।
'আমাদের এখানে শীতকালেও মানুষ এসেছেন, যদিও বর্ষার মতো অত বেশি নয়। কেউ কেউ আসেন স্রেফ এ শ্যামলিমা উপভোগ করতে,' গুলজার বললেন।
কিন্তু গত বছরের পর্যটক সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এখানকার বেশিরভাগ ব্যাবসায়ী এখন চিন্তার মুখে পড়েছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, যদি হাওর নিয়ে মানুষে আগ্রহ এবার থেকে পড়তির মুখে থাকে।
'তেমনটা হলে কী করবেন, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন হোটেল মালিকেরা। আমরা এখন আগামী মৌসুমের ওপর ভরসা করে আছি। ওই মৌসুমে সব ঠিকঠাক থাকলেই কেবল আমার এবারের মতো টিকে যাব। নাহলে মালিকেরা হয়তো রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবেন,' ঝলক জানান।
রেস্তোরাঁগুলোর ফাঁকা চেয়ার-টেবিল যেন মালিকদের হতাশার কথাই জানান দিচ্ছে। দুপুর গড়িয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো ক্ষুধার্ত অতিথির দেখা নেই। আমার মতো নীরবতা প্রেমিকের কাছেও ব্যাপারটা ভালো লাগল না।
অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত