মারিও বার্গাস ইয়োসা কেন মার্কেসকে ঘুসি মেরেছিলেন! আবার আলোচনায়
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে পেরুর লেখক হাইমে বেইলি-র বই 'লস জেনিওস' ('দ্য জিনিয়াসেস')। এ বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নোবেলজয়ী লেখক মারিও বার্গাস ইয়োসা কয়েক সপ্তাহ আগে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইসকে বলেছিলেন, 'বইটা হবে একটা মিথ্যের ডালি।'
এরপর গত ২২ মার্চ মাদ্রিদে ইয়োসার এ মন্তব্যে সায় দেন বেইলিও। 'হ্যাঁ, এটা মিথ্যের ডালি—সব উপন্যাসের মতোই—কিন্তু [এতে] খেমখেয়ালি কিংবা উদ্ভট কোনো মিথ্যা নেই...আছে শুধু বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা।'
যে দুই জিনিয়াস বা অমিত প্রতিভাবানকে নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে, তারা হলেন বার্গাস ইয়োসা ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। আর এ বইটি তাদের দুজনের বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়া নিয়ে। তবে বইটির প্রারম্ভিকাতেই বেইলি সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই বলে:
'এ বই কোনো ঐতিহাসিক লেখা কিংবা সাংবাদিকের অনুসন্ধানের ফসল নয়। এটা একটা উপন্যাস, ফিকশন কাজ—যার মধ্যে বাস্তবতা, ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে লেখক-উদ্ভাবিত কাল্পনিক ঘটনার মিশেল ঘটেছে।'
বেইলি এল পাইসকে বলেন, 'এটা ঐতিহাসিক লেখা নয় বটে, তবে ঐতিহাসিক উপন্যাস। আর এটা কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার লেখা না হলেও এ উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমি সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছি।'
এ উপন্যাসের শুরুতে বেইলি এ ঘরানার বৈধতা দেন বার্গাস ইয়োসারই লেখা ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'হিস্টোরিয়া ডি মায়তা' (দ্য রিয়েল লাইফ অভ আলেহান্দ্রো মায়তা) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে:
'মানুষের কথার ভিত্তি যখন কোনো ঘটনার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করা হয়, তখন জানতে পারবেন যে এই সবগুলো গল্প স্রেফ গল্পই, এবং এসব গল্প তৈরি হয়েছে সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে।'
এর উদাহরণও বইয়ের প্রথম বাক্যেই দেখা যায়, যেখানে ১৯৭৬ সালে মেক্সিকো সিটিতে এক মুভি থিয়েটারে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে ঘুসি মারার আগে বার্গাস ইয়োসা চেঁচিয়ে বলেন: 'প্যাট্রিসিয়ার সাথে করেছ, এটা তার জন্য।'
'তিনি বলেছিলেন, "ওর সঙ্গে যা করেছ সেটার জন্য—ওকে যা বলেছ সেটার জন্য" না,'—ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জেনেছেন বলে দাবি করেন বেইলি।
ওই দিন কী ঘটেছিল, তা কখনোই নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বার্গাস ইয়োসার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া ইয়োসাকে গার্সিয়া মার্কেস সত্যিই কিছু বলেছিলেন কিংবা করেছিলেন কি না, তা-ও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। কলম্বিয়ান নোবেলজয়ী এ বিষয়ে কিছু খোলাসা না করেই মারা যান। ৮৬ বছর বয়সি পেরুভিয়ান নোবেলজয়ী ইয়োসাও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু খোলাসা করেননি, ভবিষ্যতে করার পরিকল্পনাও নেই।
এল পাইসের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ম্যানুয়েল হাবোইস তাকে আবারও প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের সম্পর্ক ভাঙার কারণ কী। বার্গাস ইয়োসা উত্তর দিয়েছিলেন: 'নারী, সোজা কথায়।'
অতীতে বেইলিও দুই লেখককে একই প্রশ্ন করেছিলেন। মার্কেসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ১৯৯০-এর দশকে, ওয়াশিংটন ডিসিতে। তখন মার্কেস বেইলিকে বলেছিলেন: 'আমি [বার্গাস ইয়োসার সঙ্গে] ঝগড়া করিনি…ও আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। আমি তোমাকে আর কিছু বলছি না। আমার বন্ধুদের সাথে কথা বলো।'
১৯৮৫ সালে পেরুর রাজধানী লিমায় বার্গাস ইয়োসার বিএমডব্লিউতে বসে ইয়োসা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বেইলিকে বলেছিলেন যে তিনি 'কখনও এ বিষয়ে কথা বলবেন না'। ইয়োসা আরও বলেছিলেন, 'গার্সিয়া মার্কেস ক্যান্সারে আক্রান্ত।'
বেইলি বলেন, 'আমার এখনও মনে আছে, এই গতকালের ঘটনা যেন। গাবো (মার্কেসের ডাকনাম) এরপর আরও ৩০ বছর বেঁচে ছিলেন।'
ওই মিথতুল্য ঘুসির প্রতিফলন দেখা গেছে গার্সিয়া মার্কেসের এক ছবিতে। ওই ছবিতে মার্কেসের কালশিটে পড়া চোখ দেখা যায়। এই ঘটনাকে বেইলির কাছে বরাবরই 'দারুণ সাহিত্যিক সাহিত্যিক' মনে হয়েছিল। এ অনুভূতিই তাকে সত্যে-মিথ্যায় মেশানো গল্পটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে উৎসাহিত করে।
'দুই জিনিয়াস যখন এরকম একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি না হন, তখনই তো মনের মধ্যে সাহিত্যিক কৌতূহল ঘাই মারে! কারণ আমার কাছে মনে হয় সাহিত্য হলো একটা ক্লজিটের ভেতরে কী কী কঙ্কাল রাখা আছে, তা খুলে দেখা।'
বেইলি নিশ্চিত করেছেন যে তার বইটি ১৯৯০-এর দশকের তথ্য-উপাত্ত, কাগজপত্র ও সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। গ্রন্থপঞ্জিতে তিনি গার্সিয়া মার্কেসের জীবনীগুলোর উল্লেখ করেছেন। এছাড়া যুক্ত করেছেন জাভি আয়েনের এনসাইক্লোপিডিয়াতুল্য কাজ 'অকুয়েলোস আনোস ডেল বুম'-এর (দ্য ইয়ারস অভ দ্য ল্যাটিন আমেরিকান বুম) নামও।
বইটিতে হোর্হে এডওয়ার্ডস, প্লিনিও আপুলেয়ো মেন্দোজা, টমাস এলয় মার্তিনেজ ও আলভারো মিউতিস-এর বক্তব্য রয়েছে। এছাড়া আছে দুই নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের লিটারেরি এজেন্ট হিসেবে কাজ করা কারমেন বালকেলসের বর্ণনাও। বেইলি তাকে দুই লেখকের চেয়েও বেশি চালাক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
এত এত তথ্য জড়ো করার ফলে ইয়োসা ও মার্কেসের নয় বছরের বন্ধুত্বের একটা সমৃদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক ও প্রাসঙ্গিক প্রোফাইল দাঁড় করাতে পেরেছেন বেইলি। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে, যে পর্যায়টা তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে ওই সময় নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন তিনি: ঘুসি মারার ঘটনার দুই বছরে আগের পর্যায়।
বই অনুসারে, ওই সময়ে বার্গাস ইয়োসা তার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়াকে ছেড়ে অন্য নারীর কাছে চলে যান।
'ওই মুহূর্তে প্যাট্রিসিয়া ও গাবোর মধ্যে যা ঘটেছে…সেখানেই লুকিয়ে আছে এ উপন্যাসের রহস্য। প্যাট্রিসিয়া ও গাবোদের [মার্কেস ও তার স্ত্রী মার্সিডিজ বার্কা] মধ্যে যা ঘটেছে। গাবোরা তাকে কী বলেছিলেন? ডন গ্যাব্রিয়েল কীভাবে প্যাট্রিসিয়াকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন…যদি আদৌ তা করে থাকেন আরকি?'
উপন্যাসটিতে বেইলি নিজের মতো করে একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তা এই লেখায় প্রকাশ করছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, যত তীব্র সমাপ্তি পাঠক আশা করবে, তার তুলনায় অনেক নমনীয় সমাপ্তিই টেনেছেন লেখক।
তবে গুজব যেভাবে তুলে এনেছে, সেটা এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক নয়। দুই মহান লেখকের বন্ধুত্বের বিপর্যয়কর সমাপ্তির ওপর যেভাবে আলো ফেলেছে, সেখানেই এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের গুরুত্ব।
বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য উঠে এসেছে এ বইয়ে। এমনকি প্রচ্ছদে দুই লেখকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও দুর্লভ। বেইলি এটি পেয়েছেন পেরুভিয়ান ম্যাগাজিন 'কারেতাস'-এর আর্কাইভে। তাদের কাছ থেকে ছবিটি কিনে নেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ছবিটি তোলার কয়েক সপ্তাহ আগে লিমার একটি সম্মেলনের উদ্দেশে রওনা দেবার আগে কারাকাসে দেখা হয়েছিল দুই লেখকের। ছবিটিতে দুজনের পরনেই স্যুট ও টাইন—ইয়োসার হাতে একটা সিগারেট। দীর্ঘকায় ইয়োসা চোখের কোনা দিয়ে মার্কেসকে দেখছেন। আর তখন সদ্যই 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অভ সলিচিউড' প্রকাশ হয়েছে। মার্কেসকে দেখা যাচ্ছে ফুরফুরে মেজাজে। ১৯৮২ সালে গাবো সাহিত্যে নোবেল পান।
গাবোর জাদুবাস্তব উপন্যাসের ব্যাপক বাণিজ্যিক সফলতার উল্লেখ করে বেইলি বলেন, 'এ ছবিতে ইতিমধ্যে সফল মারিওর মতোই সফল হতে চেয়েছিলেন গাবো। ১৯৬৭ সালের মধ্যেই দুই লেখকের পরিচয় ঘটে।
এরপরের বছরগুলোতে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনায় তারা প্রতিবেশী ছিলেন: মার্সিডিজ ও মার্কেস, ইয়োসা ও প্যাট্রিসিয়া। দুই বাড়ির দরজার দূরত্ব পায়ে মেপে দেখেছেন বেইলি…একশো কদমও হবে না। বেইলি জানালেন, ইয়োসাকে মার্কেস 'ভাই' বলে ডাকতেন।
মার্কেসের 'বিস্ময়কর' কল্পনাশক্তির জন্য তাকে রীতিমতো পূজা করতেন ইয়োসা। আর ইয়োসার 'বুদ্ধিবৃত্তিক মস্তিষ্কের' প্রশংসায় পঞ্চমুখ করতেন মার্কেস। তবে ১৯৭০-এর দশকটা দুই লেখকের কারোর জন্যই সৃজনশীল ছিল না।
'বার্গাস ইয়োসা এ সময় মাত্র একটি অন্নুলেখযোগ্য উপন্যাস প্রকাশ করেন—'ক্যাপ্টেন পানতোহা অ্যান্ড দ্য স্পেশাল সার্ভিস'—আর মার্কেস ১৯৭৫ সালে 'দি অটাম অভ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক'-এর আগে আর কিছুই প্রকাশ করেননি। আমার মনে হয় 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অভ সলিচিউট'-এর সাফল্য তাদের দুজনকেই গ্রাস করে নিয়েছিল। গাবো যে কাজ করেছেন, সেই মান ধরে রাখার জন্য কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না…আর মারিও বুঝতে পারছিলেন গাবোকে টেক্কা দেওয়ার জন্য কী করবেন, যেমন আগেও প্রতিবার দিয়েছেন, অন্তত বিক্রির দিক থেকে না হলেও সমালোচকদের দিক থেকে।'
ওই ঘুসি তাদের বন্ধুত্বে ইতি টেনে দেয়। এরপর তারা আর কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেননি, দেখাও করেননি। তবে এই দুজন মানুষের জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখা বেইলির সৃজনশীল কাজটির আলোকে এ কথা বলা যায় যে ওই ঝগড়া ছিল অসাধারণ এক সাহিত্যিক সিদ্ধান্ত। চোখের নিচে কালশিটে পড়ার ওই ঘটনার পরই এ দুই লেখক নিজেদের সৃজনশীলতার অর্গল খুলে দেন। গার্সিয়া মার্কেস ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন, আর বার্গাস ইয়োসা জেতেন ২০১০ সালে।
'দ্য জিনিয়াসেস'-এর লেখক জানান, বালকেলস দুজনের মধ্যে বিরোধ মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গাবোর ইচ্ছেও ছিল ঝামেলা মেটানোর। 'জীবনের শেষ দশ বছরে গার্সিয়া মার্কেস তার [ইয়োসা] জন্য দুইবার অপেক্ষা করেছিলেন…একবার বার্সেলোনায়, আরেকবার কার্টাগেনায়। কিন্তু মারিও আর দেখা করতে আসেননি।'
ইয়োসা কেন এ কাজ করতে পারেন, বেইলির কাছে এ প্রশ্ন রাখলেন তিনি বলেন: 'কারণ আমার ধারণা তিনি বন্ধুদের প্রতি খুব বিশ্বস্ত একজন মানুষ…আর শত্রুদের প্রতি আরও বেশি বিশ্বস্ত।'
বেইলির বইয়ে দুই লেখকের স্ত্রীদের কথাও উঠে এসেছে। দুজনকেই জীবনের গৌরবময় যাত্রায় যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন তাদের স্ত্রীরা। গাবোর ওপর মার্সিডিজের প্রভাব ছিল অপরিসীম। আর প্যাট্রিসিয়া ছিলেন ইয়োসার কাজিন। উপন্যাসে ইয়োসার অবিশ্বস্ততা ক্ষমা করে দেন প্যাট্রিসিয়া এবং স্বামীর কাছে ফিরে যান।
প্যাট্রিসিয়া সম্পর্কে হাইমে বেইলি বলেন, 'ওই কাজ করার জন্য অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বুদ্ধিমত্তা আর প্রজ্ঞার প্রয়োজন। "দ্য জিনিয়াসেস"-এ তিনিই হলেন আন্ডাররেটেড জিনিয়াস।'
- সূত্র: এল পাইস