নেরুদার জন্মদিনে ‘অণুস্মৃতি’
শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি, জীবন শুষে নেওয়া মানুষ। যে বইটার কাছে বারবার ফিরি, প্রায় প্রতিদিনই ফিরি, সেটা ওনার লেখা একমাত্র গদ্য, তার নিজের জীবন নিয়ে, যার স্প্যানিশে নামের অনুবাদ হবে 'আই কনফেস দ্যাট আই হ্যাভ লিভড', আর ইংরেজিতে বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে 'মেমোয়ার্স'।
"সেই আগ্নেয়গিরিগুলোর নিচে, বরফের মুকুটপরা পাহাড়গুলোর গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বিশাল হ্রদের টুকরোগুলো বুকে রাখা চিলির বনভূমি—সুগন্ধি শান্ত বনভূমি—জড়িয়ে থাকা গাছের বন—আমার পায়ের পাতা ডুবে যায় মৃত পাতার নরম স্তূপে, পাতলা ডাল শব্দ করে ভেঙে পড়ে। দুধারে সুউচ্চ রৌলি গাছ, ঠান্ডা কনকনে বনে পাখি উড়ে যায়, ডানা ঝাড়ে, অনালোকিত গাছের ডালে ডানা গুটিয়ে বসে। তারপর লুকোচুরি খেলার মতো সেখান থেকেই গান গায়, বাতাসে ঝনঝন করে বাজে তার গলার স্বর—লরেলের বুনো গন্ধ, বল্ডো গুল্মের গাঢ় ঘ্রাণ আমার নাকে ঢুকে পড়ে—সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে—রক্তে মিশে একাকার হয়ে যায়। গোয়েতাকাসের সাইপ্রাস গাছ আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। পৃথিবীটা যেন দুধারে না বেড়ে লম্বালম্বি ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে শুধু পাখির সাম্রাজ্য, পাতার অফুরন্ত ঝোপঝাড়।
হঠাৎ এক পাথরে আমি হোঁচট খাই, সেটা গর্ত থেকে খুঁড়ে তুলি, লাল রোমশ কাঁকড়ার মতো বিরাট এক মাকড়শা এদিকে তাকায়, স্থির। একটা সোনালি ক্যারাবাস গুবরে পোকা এক ঝলক বিষবাষ্প ছেড়েই বিদ্যুৎগতিতে তার রঙধনু রঙ নিয়ে হারিয়ে যায়। আরও এগিয়ে যায়, ফার্নের জঙ্গল পেরোই। আমার চেয়ে একমাথা উঁচু ফার্ন গাছ, তাদের ঠান্ডা সবুজ চোখ বেয়ে জল পড়ে আমার ওপর, পাতাগুলো পেছন থেকে পাখার মত বাতাস করে—একি অসামান্য গুপ্তধন।
—হঠাৎ দেখি একটি পচা কাঠের গুঁড়ি, শরীর জুড়ে তার নীল আর কালো ব্যাঙের ছাতা, লালচে পরগাছারা ঝকঝক করছে লাল রত্নের মতো, কিন্তু আলসে গাছগাছালি দাড়ির মতো ঝুলে আছে গুঁড়িটার গাল বেয়ে, আচমকা এক ঝলক বাতাসের মত একটা সাপ পচাগুঁড়ির ফোঁকর গলে ছিটকে বেরোয়—মনে হয় গুঁড়ির আত্মাটুকু বেরিয়ে চলে গেল—
আরও দূরে শত্রুর মতো বিচ্ছিন্ন গাছগুলো ঘাসের সবুজ নরম গালিচার ওপর দাঁড়িয়ে, বনের দুর্বোধ্য রহস্যের দিকে ওরা ডালপালা মেলে রাখে, ছড়িয়ে দেয়। প্রত্যেক গাছের পাতার গড়ন স্বতন্ত্র—কোনোটা ঝুরিঝুরি, কোনোটা সুচের মতো তীক্ষ্ণ, কোনোটা খাড়া লম্বা, কোনোটা বা সুডৌল। মনে হয় এদের নানান দিক থেকে ছুরি চালিয়ে এমন বিভিন্ন গড়ন দেয়া হয়েছে—
নীচে গভীর নালা, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল গ্রানাইট আর জ্যাসপার পাথরের ওপর দিয়ে ঝরঝর করে বয়ে যাচ্ছে—একটা ঝকঝকে লেবুরঙের প্রজাপতি উড়ে যায়, জলের ওপর কাঁপে, সূর্যের আলোয় থিরথির করে ডানাগুলো কাঁপায়—কাছেই গোছা গোছা ক্যালকেওলারিয়া ফুলের হলুদ মুখ হেসে নড়ে ওঠে—
অনেক উঁচুতে ফোঁটা-ফোঁটা লাল রক্তের মত কপিহিউ ফুল বনের সবুজ ধমনী বেয়ে গলে পড়ে। সাদা কপিহিউগুলো বরফের স্ফটিকের মত—একটা বুনোশেয়াল নিঃশব্দ বাতাসকে কাচের টুকরোর মতো চুরমার করে দিয়ে হঠাৎ ছুটে যায়—বনের পাতা থিরথির কাঁপে—কিন্তু এ তল্লাটে টুকরো হওয়া নিঃশব্দ আবার জোড়া লাগে—
শুনতে পাই কোনো ভয় খাওয়া প্রাণীর ঝাপসা আর্তস্বর—অদৃশ্য এক পাখির ধারালো চিৎকার বাতাসে বিঁধে যায়—। বনজ পৃথিবীর অস্ফুট কানাকানি চলতেই থাকে—হঠাৎ ঝড় ওঠে—মাটির সঙ্গীতময় বুকের গান থেমে যায়, ভেঙে যায়।
চিলির এই বনভূমি যে না দেখেছে, সে পৃথিবীর আধখানা মুখই দেখেনি।
আমি এই নিসর্গের বুক থেকে, এই কাদাময় পৃথিবী থেকে, এই শব্দহীন সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসেছি—বেরিয়ে এসেছি সমস্ত পৃথিবীকে গান শোনাব বলে।"
এভাবেই শুরু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক কবি খ্যাত পাবলো নেরুদার জীবনকাহিনী, ওপরের জলতরঙ্গের ঝঙ্কারময় অংশটি ছিল এর মুখবন্ধ, এর পর কবির ছন্দ নিয়ে এগিয়ে গেছে তার জীবন বৃত্তান্তের বর্ণনা। এ মুখবন্ধটি বিগত বেশ ক'বছর ধরেই আমার দেয়ালে লেপটে আছে দেশ-কাল-শক্তির প্রভাব এড়িয়ে।
কয়েক সপ্তাহ আগে টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের কয়েকজন হোমরা-চোমরার কে কী বই পড়ছেন সে সম্পর্কে কয়েক পাতার রিপোর্ট এসেছিল। তাতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন, পাবলো নেরুদার কবিতা নিয়ে তার বরাবরই উচ্ছ্বাস ছিল, কিন্তু তিনি ভেবে পেতেন না একজন মানুষ কি করে এমন কবিতা লিখতে পারেন! তবে নেরুদার স্মৃতিকথা পড়ার পর তিনি খানিকটা আন্দাজ পেয়েছেন, কেন খাঁটি প্রকৃতির সন্তান এমন অনর্গল ফোয়ারার মতো উচ্ছল কাব্য রচনায় সক্ষম হয়েছিলেন।
নেরুদার মেমোয়ার্স বা স্মৃতিকথা আমার সবচেয়ে প্রিয় আত্মজীবনীদের একটি। আসলে এটিকে জীবনকথা না বলে এক বিশাল কবিতা বলা যায়, কবিতার মতোই ছন্দ, মাধুর্য, দীপ্তি, স্বচ্ছতা বয়ে গেছে বইয়ের প্রথম থেকে শেষ ছত্র পর্যন্ত। সেই সঙ্গে নেরুদার একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি ভুবন ভুলানো উপমার (মেটাফোর) ছড়াছড়ি সবখানেই। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল জনৈক সাহিত্যপ্রেমী ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, সম্ভবত মুচকুন্দ দুবে বলেছিলেন, গত শতাব্দীর সেরা উপমা ব্যবহারকারী কবি পাবলো নেরুদা, তার পরপরই শামসুর রাহমান।
কবিতার মতো সুরের নহর হয়ে পাতায় পাতায় আবদ্ধ এ জীবনকাহিনী পড়ার সমস্যাটাও সেইখানেই, পাঠের পর তৃপ্ততা না, বুক ভরে ওঠে হাহাকারে, আবার পড়তে ইচ্ছে করে—প্রতিটি শব্দ ছুঁয়ে, প্রতি উপমা দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে, গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে বারংবার।
কবি জীবনকাহিনী বলে গিয়েছেন মোটামুটি ধারাবাহিকভাবেই, মাঝে মাঝে তার বিপুল কর্মযজ্ঞময় জীবনের কিছু ব্যক্তি, ঘটনা, স্থান পারিপার্শ্বিকতার চাপেই আগুপিছু হয়ে স্থান করে নিয়েছে ধারাবাহিকতার ছন্দ ভেঙে, কাহিনীকে আরও ছন্দময় করে তোলে। এর ফাঁকে-ফাঁকেই পাঠকের সামনে উজ্জ্বল মেঘের কাহিনীর ভেলা থেকে নেরুদার নামের কবি আস্তে আস্তে বাস্তবে রূপ নেন।
মুখবন্ধের পরপরই কবি শুরু করেন তার শৈশবের কাহিনী—১৯০৪ সালে জন্ম নেবার সময় থেকেই বাবা, পরিবার, চিলির মফস্বল শহরের কঠিন জীবন আর প্রকৃতির বাস্তব বর্ণনা। এমনভাবে তিনি অরোক্যানিয়া অঞ্চলের প্রবল বৃষ্টির সূক্ষ্ম কারুকার্যের কথা তুলে ধরেন যে, চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে মেরুপ্রদেশের ধূসর আকাশের নিচে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছে এক শিশু।
শিশুটির জ্ঞান পিপাসার ব্যাপ্তি মহাবিশ্বের চেয়েও বড়, আর তার চেয়ে বৃহত্তর তার মুগ্ধ হবার ক্ষমতা। সেই আকাশচুম্বী মুগ্ধতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকা কবি ঘটনাগুলো বলতে থাকেন স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত হয়ে- তার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া খেলনা, কর্কশ আবহাওয়া, আদিম ট্রেনভ্রমণ, যৌনঅভিযান এবং জীবনে এক দুঃখজনক ঘটনায় গনগনে আবেগ তাড়িত হয়ে লেখা প্রথম কবিতার কথা। যা পড়ে তার বাবা বলেছিলেন, কোথা থেকে তুলেছিস?
শুরু হয় বালক কবির বইয়ের জগতে অনন্ত যাত্রা, সেই সুবাদে নব-নব বন্ধু, বড়দের কালো জগতে প্রবেশ; জীবনপথের ধ্রুবতারা সাহিত্যিকদের গল্প বলে যান তিনি অসীম কৃতজ্ঞতায়।
বাবার চোখে পড়ার ভয়েই পিতৃপ্রদত্ত নাম নেফতালি রিকার্ডো রেয়েস বাসোয়ালতো এড়িয়ে পত্রিকায় দেখা এক চেক দেশের কবি ইয়ান নেরুদার নাম খুবই পছন্দ হওয়ায় সেই নামেই কবিতা ছাপানো শুরু করেন। এক সময়ে ছাড়িয়ে যান মূল নেরুদার খ্যাতিকে যোজন যোজন গুণে।
অবশেষে মফস্বলের মুখচোরা ছেলেটি চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে অধ্যয়নের তাগিদে গমন করেন, তার আকাশ ভরে ওঠে উল্কার ঝাঁকের মতো বন্ধু প্রাপ্তি এবং বন্ধু বিচ্ছেদে। সেই সঙ্গে শুরু করেন জনসমক্ষে স্বরচিত কবিতা পাঠ। ১৯২৩ সালে ছাপা হয় তার প্রথম কবিতার বই, এর পেছনে তার উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা, অবিরাম ত্যাগের কথা আমাদের মুগ্ধ করে সেই কিশোরের কাব্যপ্রেমের প্রতি।
বছর কয়েক পরে লেখাপড়ার পাট আপাত চুকিয়ে ভ্রমণ আর জীবনের নেশায় পাগল কবি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে অনেক দেনদরবার করে চিলির দূতাবাসে নিজের জন্য চাকরি খুঁজে নেন। দেশটার নাম বার্মা। ইরাবতীর তীরে অবস্থিত রেঙ্গুন শহরে শুরু হয় নতুন জীবন, কবির মতে বিশ্বের সবচেয়ে সুরেলা নদীর নাম এটিই। একে একে আসে ভারতবর্ষ, শ্রীলঙ্কা, বাটাভিয়া (ইন্দোনেশিয়া), জাপান, চীন নানা প্রাচ্যদেশের অত্যাশ্চর্য কাহিনী।
বইটির একটি বড় আকর্ষণ নেরুদার সঙ্গে নানা বিশ্ব ব্যক্তিত্বের সরাসরি সাক্ষাতের রোমন্থন, যে তালিকায় আছেন সালভেদর আয়েন্দে, পাবলো পিকাসো, নাজিম হিকমত, মহাত্মা গান্ধী, গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল, অক্টাভিও পাজ, যোসেফ স্ট্যালিন, জওহরলাল নেহেরু।
আছে বিপ্লবী চে গ্যেভারার সম্পর্কে তার উচ্ছাসময় স্মৃতিচারণ, বলিভিয়ার জঙ্গলে নিহত হবার সময় বিপ্লবের এই সূর্যসন্তানের সঙ্গে ছিল মাত্র দুইখানা বই, একটি তার নোট বুক অন্যটি নেরুদার ক্যান্টো জেনারেল।
তবে সবচেয়ে বেশি শব্দ তিনি বরাদ্দ রেখেছেন তার বন্ধু, আন্দালুসিয়ার কণ্ঠস্বর, স্পেনের মহাকবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে নিয়ে।
লোরকা আর নেরুদা ছিলেন মানিকজোড়; সাহিত্য, বন্ধুত্ব, ভ্রমণ সব ক্ষেত্রেই। এক সঙ্গে বক্তৃতা দিয়েছেন ষাঁড়ের লড়াইয়ের ম্যাতাডোরদের মতো, কাব্য বুনেছেন, গান গেয়েছেন, ঝড় তুলেছেন নাচের আসরে।
স্পেনের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিকে বধ্যভূমিতে নির্মম মৃত্যুকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হল স্বদেশের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধাচারণ করায়। সারা বিশ্বে এর বিরুদ্ধে ঝড় ওঠে, কিন্তু কর্ণপাত করে না নির্বোধ, মাথামোটা ফ্রাঙ্ক আর তার তাঁবেদারেরা। নেরুদা লিখেছেন, স্পেনের নিসর্গে কোনো নদী নেই, এর নদী এখানকার কবিরাই।
সেই সঙ্গে পাওয়া যায় নেরুদার বহুমাত্রিক উৎসাহের পরিচয়। নানা বিষয়ের ওপর হাজার হাজার বইয়ের সংগ্রহতো তার ছিলই, তার সারাবিশ্বের নানা কোন থেকে সংগ্রহ করা মুখোশের সংগ্রহও ছিল অতুলনীয়। আর ছিল শঙ্খের বিশ্বের সেরা সংগ্রহের একটি—সমুদ্রের এবং স্বাদু জলের হাজার দুষ্প্রাপ্য শামুক, ঝিনুক ছিল তার সংগ্রহে, যা তিনি পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। চিলির পাখিদের নিয়েও একটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এক সময়ে। ঘুরে ঘুরে তার নিসর্গ প্রেমের কথা এসেছে বারবার।
নিজের প্রথম বিয়ের ও তার ব্যর্থতার কথা বলেছেন লাজুকতা নিয়ে, কিন্তু দুর্দম উচ্ছ্বাসে বলেছেন তার জীবনের সেরা প্রেম, স্ত্রি মাতিলডা উরুশিয়ের কথা, যিনি ছিলেন তারমতোই চিলির এক কোনো নাম না জানা মফস্বলের মানুষ।
নিজের পরিচয় হিসেবে সবসময়ই বলেছেন নেরুদা—১ম পরিচয় তিনি কবি, ২য় পরিচয় তিনি কম্যুনিস্ট, ৩য় পরিচয় তিনি চিলির অধিবাসী।
কম্যুনিস্ট পরিচয়ের কারণেই এক সময় মাথায় হুলিয়া নিয়ে বিভিন্ন দেশে ফেরারি জীবনযাপন করতে বাধ্য হন আমাদের গ্রহের রোমান্টিকতম কবি, সেই তীব্র কষ্টকর মুহূর্তগুলোর বর্ণনা আঁকা হয়েছে ধূসর পাতায় কালো অক্ষরে। আবার অনেক পরে সেই সমন ফিরিয়ে নেওয়া হলে দেশে ফিরে সাম্যবাদী দলের দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে লড়ার অঙ্গীকার করেন, যদিও পরবর্তীসময়ে বহুদিনের সহযোদ্ধা, ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালভেদর আয়েন্দেকে এ দায়িত্ব সমর্পণ করেন (আয়েন্দে ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত পৃথিবীর প্রথম মার্ক্সসিস্ট নেতা)।
হয়তো এ সাম্যবাদিতার কারণেই তাকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয় অনেক অনেক পরে, ১৯৭১ সালে। এর কিছুদিন পরেই সিআইএ'র সহযোগিতায় চিলির এক হঠকারী জেনারেল পিনোশে ক্ষমতা দখল করেন বন্দুকের মুখে, পাওয়া যায় গণনেতা আয়েন্দের মৃতদেহ (অবশ্য মৃত্যুর কারণ নিয়ে আজও রহস্য উদঘাটন হয়নি)। সে সময়কে এক ঘনীভূত পঙ্কিল আঁধার হিসেবে বর্ণনা করেছেন কবি। এখানেই থেমে গেছে তার কলম। সবুজ কলম দিয়ে সবসময় কাব্য সৃষ্টি করতে পছন্দ করতেন তিনি, বলতেন এই রং তাকে আগামীদিনের স্বপ্নে উজ্জীবিত করে।
এর মাত্র ১২ দিন পরেই অন্য ভুবনে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
সামরিক বাহিনী হানা দিয়েছিল তার বাড়িতেও। উদ্যত অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন কবি: চারিদিকে তাকিয়ে দেখ, তোমাদের জন্য বিপজ্জনক একটিই জিনিস আছে এখানে—কবিতা!
১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৬৯ বছর বয়সে হাসপাতালে অবস্থানরত অবস্থায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় চিলির বিবেক। যদিও অনেকেই ধারণা করে থাকেন, পিনোশের গুণ্ডাবাহিনী বিষ দিয়ে হত্যা করেছিল তাকে, যা নিয়ে পুনঃতদন্ত শুরু হয়েছে এখন চিলিতে। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অত্যন্ত গোপনে সেরে ফেলার চেষ্টা চালায় সেনাবাহিনী, সেখানে যোগদানের অনুমতি ছিল না সর্বসাধারণের। যদিও নেরুদাপ্রেমী চিলির অধিবাসীরা এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
শেষে সারাজীবনে শব্দের ঝড় তোলা আলোকময় ভুবন নিয়ে কাজ করে যাওয়া কবির শব্দ নিয়ে বলা অমূল্য শব্দগুচ্ছ এখানে হুবহু তুলে দিয়ে শেষ করছি।
"কে বলে শব্দের প্রাণ নেই? শব্দ তো গান করতে জানে, উড়তে জানে, ডানা গুটিয়ে বসতে জানে—সেসব শব্দ আমি যে শুধু ভালবাসি তা-ই নয়, শ্রদ্ধাও করি, আঁকড়ে ধরি, হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে চলি, নরম শব্দের মধ্যে আমি দাঁত বসাতে জানি, গলিয়ে তরল করে ফেলতে জানি—শব্দ ভালবাসি আমি—
—হঠাৎ চমকে দেওয়া শব্দ—আগ্রহে অধীর আমি, তীর ছুড়ি—শব্দেরা ডানা থমকে পায়ের কাছে খসে পড়ে—রঙিন নুড়ির মতো ঝকঝকে শব্দ, রুপালি মাছের মতো ছিটকে ওঠা শব্দ, ফেনার মতো, সুতোর মতো শব্দ, ধাতব শব্দ, শিশিরের মতো ফোঁটাফোঁটা শব্দ—শব্দ খুঁজে বেড়াই তন্নতন্ন করে—শব্দের জৌলুসে ধাঁধিয়ে যায় চোখ—সমস্ত শব্দ দিয়ে কবিতাকে গড়তে যাই—ওরা উড়াল দেয়, গুনগুন করে ওড়ে—
আমি ওদের মাঝপথে ধরে ফেলি, ময়লা সরাই, খোসা ছাড়াই, মেলে ধরি—মনে হয় ওরা স্ফটিকের মতো, হাতির দাঁতের মতো, ধুকপুকে পিছল শব্দ, ফলের মতো, শ্যাওলার মতো, সবুজ পাতার মতো শব্দ, জলপাই শব্দ—সব, সব শব্দ ঝাঁকিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলি, গুঁড়ো করে উড়িয়ে দিই বাতাসে—কবিতায় ওরা জমাট বেঁধে থাকে, পালিশ করা কাঠের মতোন উজ্জল রুপালি শব্দেরা।
কয়লার মতো শব্দেরা—সমুদ্র খুঁড়ে আনা জাহাজডুবির ফেলে যাওয়া গুপ্তধন, ঢেউয়ের রেখে যাওয়া উপহার। কী নেই ওদের সত্ত্বার মধ্যে, ওদের রক্তের মধ্যে? একটি শব্দ উড়ে এসে কোন পংক্তিজুড়ে বসা মাত্র, একটি অবাঞ্ছিত শব্দ পোকার মতো কোনো ছত্রের মাঝে সিঁদ কেটে ঢুকলেই কবিতা পাল্টে যায়—
ওরা কখনো ছায়ার মতো ম্লান, কখনো স্বচ্ছ, কখনো ওরা পালকের মতো হালকা, কখনো ভারী, কখনো বা রোমশ। এতদিন ধরে নদীর খাত বেয়ে গড়িয়ে এসে, পৃথিবীর দশ মাথা ছুঁয়ে, মাটির তলায় শেকড় চালিয়ে, ওদের শরীরে কী নেই? ওরা পুরোনো, অথচ ওরাই নতুনের মতো আচমকা—ওরা গুহায় আর ফুলের কুঁড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকে—এ ভাষার তুলনা পাই না কোথাও।
এ দেশটাকে যারা হামলা চালিয়ে দখল করেছে তারা আমাদের জন্য রাখার মধ্যে রেখে গেছে এই ভাষাটাই! দানবের মতো উঁচু কর্দিলেরা পাহাড় ডিঙিয়ে, আমেরিকার রুখো কর্কশ মাটির ওপর ঘোড়া চালিয়ে, ওরা খুঁজেছে, শিকার করেছে। আলু, শিম, কালো তামাক, সসেজ, গম, ডিম—যা পেয়েছে হাঙরের মতো ভয়ানক খিদের আক্রোশে সমস্ত সাবাড় করে ফেলেছে- এমন মারাত্নক খিদের নজির পৃথিবীতে আর নেই- ওদের ক্ষুধার্ত মুখ দিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে সব ধরনের ধর্ম, সব ধরনের জাত, গিলে খেয়েছে পিরামিড, শেষ করে দিয়েছে প্রাচীন দেবদেবতার মূর্তি—ওদের সঙ্গে আনা বস্তার মধ্যে ওদের তৈরি এরকম মূর্তিই কিছু ছিল। ওরা কোথাও কিছু রাখেনি—জমি-জিরেত চেঁছে ছুলে সাফ করে দিয়েছে—
কিন্তু তবুওতো ঝকঝকে শব্দ ওরা ফেলে গেছে অজান্তেই—ওদের বর্বর শুকতলা থেকে, ওদের দাড়ি, হেলমেট, ঘোড়ার নাল থেকে নুড়ির মতো শব্দ ঝর ঝর করে পড়তে পড়তে গেছে—ওরা এ জ্বলজ্বলে ভাষাকে অজান্তে ফেলে গেছে।
আমরা খুইয়েছি সব, হারিয়েছি সব—আবার পেয়েছি অনেক, জিতেছি অনেক। আমাদের সোনা ওরা লুট করে নিয়ে গেছে, ফেলেও গেছে রাশিরাশি সোনা—সবকিছু নিয়ে গিয়েও সবকিছু রেখে গেছে ওরা—রেখে গেছে দুর্মূল্য শব্দ।"
(পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথা একাধিক ভাষায় পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। স্প্যানিশটা এখনো সড়গড় হয়নি বলে দাঁত ফোঁটাতে পারিনি খুব গভীরে। ইংরেজি পড়ে খুব একটা আরাম পাইনি, তার মূল কারণ অসাধারণ একটি বাংলা অনুবাদ পড়ে ফেলেছিলাম আগেই।
এ লেখায় প্রথমে ও শেষে যে অনুবাদ অংশ হুবহু তুলে ধরলাম, তা সহ নেরুদার পূর্ণ স্মৃতিকথার অনন্য অসাধারণ অনুবাদটি করেছেন অতি আপনার জন, দিদি আনন্দময়ী মজুমদার। বইটি প্রকাশিত হয়েছে 'সময় প্রকাশন' থেকে।)