মার্কেস ছাড়াও যেসব লেখক মরণোত্তর ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ শিকার হয়েছেন
মৃত্যুর ঠিক ১০ বছর পরে চলতি মাসে প্রকাশ করা হয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'দ্য লস্ট নভেল' বা 'হারিয়ে যাওয়া উপন্যাস' বলে অভিহিত 'আনটিল অগাস্ট'। এই উপন্যাসটিকে 'হারিয়ে যাওয়া' বলাটা কিছুটা বাড়াবাড়িই বলা যায়। কেননা এটি প্রকাশের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই বইটি সম্পর্কে জানতেন।
বইটি ২০০৩ সালের দিকে লেখা হলেও শেষ হয়নি উপন্যাসটি। উপন্যাসটি সম্পর্কে এমনই কিছু আবছা ধারণা দেয় মার্কেসের সম্পাদক। কীভাবে স্মৃতি ভ্রষ্টতা তার এই শেষ উপন্যাসের সকল ধরনের সংস্করণের ক্ষেত্রে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারই বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রকাশকরা।
তবে 'স্মৃতিভ্রম' যে এখানে একটা বিষয় ছিল তা মূলত একে শুধুই শ্রুতিমধুর করার চেষ্টা। শেষ জীবনে ডিমেনশিয়ায় ভুগেছেন মার্কেস।
কিন্তু মার্কেস স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন যে, 'আনটিল অগাস্ট' প্রকাশ করতে চান না তিনি।
"বইটি কিছুই লেখা হচ্ছে না। নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে এই বই", নিজের সন্তানের কাছে এমনটাই বলে যান মার্কেস। তখন রাজিও হয় তারা। আর একারণেই বইটি পেতে দেরি প্রায় কয়েক দশক।
তবে এবার মার্কেসের ইচ্ছার সাথে অনেকটা 'বিশ্বাসঘাতকতা' করেই প্রকাশিত হলো উপন্যাসটি। তাদের দাবি, বইটির কপিরাইট রক্ষা করতেই প্রকাশের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, "মার্কেসের মৃত্যুর প্রায় ১০ বছর পরে বইটি আবার পড়ে মনে হয় যে, বইটি যথেষ্ট উপভোগ্য। তার কাজ উপভোগ করার মতো সবগুলো গুণই আছে উপন্যাসটির। তার আবিষ্কারের ক্ষমতা, কাব্যিক ভাষা, চিত্তাকর্ষকভাবে গল্প বলা, মানবজাতি সম্পর্কে বোঝাপড়া ও জীবনের নানা দুঃখ দুর্দশার প্রতি তার দরদ; কিছুই বাদ পড়েনি উপন্যাসটি থেকে। তবে সম্ভবত প্রেমই ছিল তার সমস্ত কাজের মূল বিষয়।"
'আনটিল অগাস্ট' যে অনন্য এই লেখকের প্রথমসারির কাজ নয় তা সবারই বোধহয় জানা। বইটি যদি মার্কেসের মহান মনোলিথ 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড' এবং 'লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা' কিংবা তার অন্যান্য লেখনী থেকে ভিন্ন ধারার কিংবা নিম্ন মানের নাও হয়ে থাকে, তবে এই উপন্যাসটি নতুনভাবে লেখকের জন্য কিছুই বয়ে আনবে না।
তবে মার্কেসই প্রথম লেখক নন যিনি মরণোত্তর এমন 'বিশ্বাসঘাতকতার' শিকার হয়েছেন। বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষের কাছ থেকে এমন 'প্রতারিত' হওয়ার তালিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে আছে ফ্রাঞ্জ কাফকা। আসছে জুনে মৃত্যুর ১০০ বছর পূর্ণ হবে এই লেখকের। মৃত্যুর আগে তার সমস্ত অপ্রকাশিত কাজ ধ্বংস করার কথা বলে যান তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে।
অথচ ব্রড না থাকলে, আমরা বঞ্চিত হতাম কাফকার বেশিরভাগ ছোটগল্প, তিনটি উপন্যাস, লেখা ডায়েরি ও চিঠিগুলো থেকে। এসব ডায়েরি কিংবা প্রেয়সীকে লেখা কাফকার চিঠি তাদের স্বমহিমায় স্থান করে নিয়েছে সাহিত্য জগতে।
তবে এ কারণে শাস্তি পেতে হয়েছে ব্রডকে। প্রখ্যাত এই ঔপন্যাসিক তার নিজের লেখার মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করার কথা থাকলেও নিজের অজান্তেই তিনি তৈরি করে ফেলেছেন তার বন্ধু 'কাফকার শিল্প জগৎ'।
২০০৮ সালে কাফকা বীমা আইনজীবী হিসাবে কাজ করার সময়ে তার লেখা প্রতিবেদনগুলোর সংগ্রহ 'দ্য অফিস রাইটিংস' প্রকাশিত হয়।
কেউ কেউ ধারণা করে, কাফকা ব্রডকে তার কাজ সরিয়ে ফেলার দ্বায়িত্ব দিয়েছিল কারণ সে জানতেন যে, ব্রড তার অনুরোধ শেষ পর্যন্ত রাখবে না। আর এভাবেই তার লেখা আরো একবার স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ পাবে।
তবে কাফকা যেভাবে তার সমস্ত অপ্রকাশিত লেখাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, অন্য কোন লেখক ব্যাপারটা নিয়ে এভাবে ভাবেনি। অন্যান্য লেখকরা কেবল তাদের অসম্পূর্ণ রচনাগুলো প্রকাশ হতে বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষান্ত দিয়েছে বিষয়টিতে।
এমনই তার নিজের অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে ভ্লাদিমির নাবোকভ তার স্বাভাবিক পোলিশ ভাষায় বলেছেন, "কেবল উচ্চাভিলাষী কিছু তুচ্ছতা এবং মধ্যম শ্রেণির আন্তরিকতার দেখা মেলে এসব খসড়ায়। এগুলো যেন তুচ্ছ থেকেও তুচ্ছতর।"
কিন্তু নাবোকভের ছেলে দিমিত্রি তার বাবার কথাটি ঠিক ধরতে পারেননি হয়তো। তার বাবা নাবোকভ এসব খসড়াগুলোকে ধ্বংস করতে বলার অনুরোধের প্রায় ৩২ বছর পরে ২০০৯ সালে 'দ্য অরিজিনাল অব লরা' উপন্যাসটি প্রকাশ করে দিমিত্রি।
লেখাটিকে অবশ্য অসমাপ্ত বলা যায় না। মূলত ইন্ডেক্স কার্ডে কিছু নোট হিসেবে সবে শুরু করা হয়েছিল লেখাটি। এমনকি নাবোকভের বিরোধী অংশের লেখক মার্টিন অ্যামিসও ঠিক মজা পাননি এমন লেখা দেখে।
তিনি নাভোকভের লেখার পর্যালোচনায় লেখেন, "যখন একজন লেখক তার লেখনী থেকে সরতে শুরু করে তখন তার লেখনিতে কিছু তারতম্য দেখা যায়। ভাঙা কাঁচের মতো টুকরো টুকরো অবস্থার মতো। কিন্তু নাবোকভের এসব লেখা ছিল এক একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনা মাত্র।"
এস্টেটের আর্থিক সুবিধা হওয়া ছাড়া এই ধরনের কাজ প্রকাশের কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, লেখা তার স্রষ্টা থেকে স্বাধীন এবং এর নিজস্ব একটি অবস্থান আছে। আর তার চেয়ে বড় হলো, বইগুলো প্রকাশিত হলে লক্ষ লক্ষ মানুষের খুশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অপরদিকে এসব বই ধ্বংস করলে শুধু মাত্র একজন ব্যক্তির খুশি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তিই তখন মৃত।
তবে আমরা সবাই যে এতটা উচ্চমনা এমনটা ভান না করাই ভালো। অপ্রকাশিত এসব বই প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্রে যে পাঠকদের নিছক কৌতূহলও একটি ভূমিকা পালন করে তা অস্বীকার করা সম্ভব না।
ফিলিপ লারকিনের তার প্রেমিকাকে লেখা সরস চিঠিগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর তার এই ডায়েরিতে একবারের জন্য হলেও উঁকি দেওয়ার কথা ভাবতেন না বলছেন? তবে দুর্ভাগ্য যে, তার গার্লফ্রেন্ড মনিকা জোনস তার ইচ্ছে মেনে নিয়ে লারকিনের লেখা সব চিঠি ধ্বংস করে ফেলেছেন।
এরকমটা মাঝে মধ্যে ঘটলেও এমন উদাহরণের সংখ্যা খুবই কম। টেরি প্র্যাচেট মার্কেসের মতোই ভুগেছিলেন ডিমেনশিয়াতে। এই অবস্থাতেই লেখা তার শেষ বইগুলোর ক্ষেত্রে প্র্যাচেট তার বন্ধু রব উইলকিনস পরিচালিত তার এস্টেটকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, তার সকল অসমাপ্ত কাজগুলো যেন স্টিমরোলার চালিয়ে ধ্বংস করা হয়।
প্র্যাচেটের মৃত্যুর দুই বছর পর ২০১৭ সালে উইলকিন্স তার বন্ধুর ইচ্ছা অনুসারে ঠিক সেটাই করেছিল। স্ট্রিমরোলার দিয়ে চূর্ণ করা হার্ড ড্রাইভের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন তিনি।
মৃত্যুর পর একজন লেখকের ইচ্ছাকে সম্মানিত করা হবে তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো, বেঁচে থাকতে তাদের নিজেদের হাতে এসব অপ্রকাশিত লেখা ধ্বংস করে ফেলা।
যেমনটা করেছিল জেমস জয়েস। তিনি তার 'এ ব্রিলিয়ান্ট ক্যারিয়ার' নাটক ও 'স্টিফেন হিরো' উপন্যাসের প্রথমার্ধ পুড়িয়ে ফেলেন।
অন্যদিকে হার্পার লি'র 'গো সেট এ ওয়াচম্যান' মূলত তার ক্লাসিক উপন্যাস 'টু কিল এ মকিংবার্ডের' প্রাথমিক সংস্করণ। যা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। লি তখনও জীবিত থাকা স্বত্বেও তার পূর্বের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই প্রকাশিত হয় বইটি।
যদিও প্রকাশনাটি বিতর্কিত হয়েছিল। লি'র বোনের মৃত্যুর প্রায় দুই মাস পরে ঘোষণা করা হয়েছিল বইটি প্রকাশের কথা। তিনি লি'র আইনজীবী হিসাবে কাজ করতেন।
মৃত্যুর আগে লি'র একেবারেই শ্রবণশক্তিহীন ও প্রায় অন্ধ ছিলেন। যদিও তার নিকটবর্তী অন্যরা ধারণা করেছিলেন যে, লি'র বোন এই প্রকাশনাটিকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। সম্ভবত মরণোত্তর অন্য কারো দ্বারা প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি এড়াতেই তিনি এই পন্থা বেছে নিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করেন তারা। বইটি বের হওয়ার সাত মাস পরে মারা যান লি'র বোন।
যদিও সাহিত্যিক ও লেখকরা নিজেরাই মরণোত্তর প্রকাশ করতে পারতেন নিজেদের সাহিত্যকর্ম। জর্জ অরওয়েলের এস্টেট এটাই প্রমাণ করে যখন তারা '১৯৮৪' এর সহচর উপন্যাস হিসেবে 'জুলিয়া' অনুমোদন দেয়।
গত বছর প্রকাশিত হয় 'জুলিয়া' উপন্যাসটি। আর এসব কারণেই আমরা অপেক্ষা করতে থাকি, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে, সাহিত্যের পাতায় কোন এক উত্তেজনাপূর্ণ ঘোষণার। হয়তো আজ নয়, কাল নয়, তবে শীঘ্রই 'এনাদার হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড' কিংবা 'হোয়াট লোলিতা ডিড নেক্সট'-এর আসন্ন প্রকাশনার।
অনুবাদ: জেনিফার এহসান