লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন? স্বপ্নের পেশা না পাওয়ার আক্ষেপ ঝেড়ে ফেলবেন কীভাবে
যেকোনো ক্যারিয়ারের পথ বেছে নেওয়ার আগে মানুষ চিন্তাভাবনা করে এবং তার জন্য উপযুক্ত এমন কোনো পেশাকেই বেছে নেয়। কিন্তু তবুও অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানার পরেও ফেলে আসা কোনো ক্যারিয়ারের পথ বা কাজের সুযোগ নিয়ে মানুষ আফসোস করে। এই অতীতে পড়ে থাকা এবং অন্য পেশা বা কাজকে বেছে নিলে কী হতে পারতো আর পারতো না- তা নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে থাকা একজন ব্যক্তির বর্তমান কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ক্যারিয়ারের অতীত-বর্তমান নিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে, এমন কর্মীদের সাহায্য করতে নিয়োগকর্তা, ম্যানেজার ও প্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা পালন করতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডব্লিউ পি ক্যারি স্কুল অব বিজনেস-এর অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর লেখক র্যাচেল বার্জেস এবং তার সহকর্মী এরিন লং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তিন শতাধিক কর্মী ও তাদের সহকর্মীদের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছেন। তারা পেশাদার ও সিনিয়রিটির ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মীদের কাছে জানতে চেয়েছেন যে তারা তাদের বর্তমান চাকরি নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট, এই চাকরি ব্যতীত অন্য কোনো চাকরিতে যাওয়া কিংবা ফেলে আসা ক্যারিয়ারের পথ নিয়ে কী তারা কতটা ভাবেন এবং নিজেদের জীবন ও কাজ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে তারা কতদূর চিন্তা করতে পারেন। সেই সঙ্গে তাদের সহকর্মীদের প্রশ্ন করা হয়েছে, এই সকল কর্মীরা কী পরিমাণ সহযোগিতামূলক কাজে যুক্ত থাকেন বা তাদের আচরণে সেই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব কতটা প্রকাশ পায়; এবং তারা সহকর্মীর কাছে বর্তমান চাকরিটি ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব প্রকাশ করেন কিনা।
এসব জরিপের মাধ্যমে র্যাচেল এবং এরিন দেখেছেন যে, অনেক কর্মীই দৈনন্দিন জীবনের অনেকটা সময় বিকল্প পেশায় যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবেন- এমনকি নতুন কাজে যুক্ত হওয়ার পর অনেক বছর কেটে গেলেও তারা অতীত নিয়ে ভাবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ তাদের অতীতের ক্যারিয়ার বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবেন না; আর ২১ শতাংশ ব্যক্তি প্রায়ই কিংবা সবসময়ই অতীতের কী হতে পারতো সেসব নিয়ে চিন্তা করেন।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছে সমাজকর্মী যিনি হয়তো পশুচিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন, স্থপতি যিনি হয়তো চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, শিক্ষক যিনি হয়তো আইনি পেশায় যেতে চেয়েছিলেন। গবেষকরা একজন অংশগ্রহণকারীকে খুঁজে পেয়েছেন যিনি পিএইচডি প্রোগ্রাম চলাকালীন সুপারভাইজারের সঙ্গে বাজে অভিজ্ঞতার পর বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে ফাইন্যান্সে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বর্তমান পেশা নিয়ে তিনি খুশি হলেও তিনি জানান, প্রায়ই তিনি তার ফেলে আসা স্বপ্ন নিয়ে ভাবেন এবং সেখানে তিনি কতটা উন্নতি করতে পারতেন সেসব চিন্তা তাকে পীড়া দেয়।
ওই ব্যক্তি বলেন, "আমি প্রায়ই ভাবি, আমি যদি বায়োকেমিস্ট্রি বা জেনেটিকসে আমার পিএইচডিটা শেষ করতে পারতাম তাহলে কী হতো! বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর প্রতি আমার সহজাত আগ্রহ ছিল এবং আমি এসব ক্ষেত্রে বেশ ভালো পারফরম্যান্স দেখাতাম। আমি যদি একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম, তাহলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সম্মুখভাগে থাকতাম এবং মানবসভ্যতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার পেছনে কাজ করতে পারতাম। আমি হয়তো আর্থিকভাবে খুব বেশি লাভবান হতাম না, কিন্তু আমার কাজের মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জনের 'সম্ভাবনা' থাকতো।"
অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে যে ফেলে আসা ক্যারিয়ার নিয়ে তার মধ্যে কিছুটা হলেও কষ্ট রয়েছে। আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের কারণে কিংবা অন্য কোনো অনুপ্রেরণায়, যে কারণেই তারা নতুন পেশার পথ বেছে নেন না কেন; ফেলে আসা ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা নিয়ে তাদের মধ্যে চাপা বেদনা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু তাদের জরিপে আরও দেখা গেছে, ফেলে আসা 'পেশাদার পরিচিতি'র প্রতি আকাঙ্ক্ষার কারণে এই সকল কর্মীরা তাদের বর্তমান চাকরিতে নিজের শতভাগ দিতে পারছেন না এবং পুরোপুরি কার্যক্ষম হতে পারছেন না।
কর্মীদের আত্মমূল্যায়ন এবং তাদের সহকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গবেষকরা দেখেছেন যেসব কর্মী এখনও নিজেদের অতীতে 'আটকে আছেন', তারা বর্তমান কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারছেন না, কাজ করতে বসে আকাশ-কুসুম ভাবছেন, প্রায়ই ছুটি নিচ্ছেন বা কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন, সহকর্মীদের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলছেন না এবং নতুন চাকরি খোঁজার দিকেও তাদের আগ্রহ দেখা গেছে।
এখানে বলে রাখা, এসব কর্মীদের কেউই পুরোপুরি হতাশা বা আক্ষেপে ডুবে নেই। এমনকি জরিপে অংশগ্রহণকারী অনেকেই জানিয়েছেন যে তারা তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে খুশি। কিন্তু তবুও তাদের মনে হয়, ভিন্ন একটি পেশা বেছে নিয়ে তারা কিছু একটা মিস করে গেছেন- বিশেষ করে যে পেশাটি তাদের স্বকীয়তা ও জীবনের উদ্দেশ্যর সঙ্গে বেশি মানিয়ে গিয়েছিল, সেটি ধরে রাখতে না পারার একটা অনুভূতি তাদের মধ্যে রয়েই গেছে।
'নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস' নামক যে প্রবাদ রয়েছে বাংলায়, সেটিই যেন অনেকের ক্ষেত্রে বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার একটি কারণ হলো- অনেক বেশি বিকল্প পথ সামনে থাকা। যেহেতু রিমোট ওয়ার্ক এবং অনলাইনে কাজের ফলে পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে, তাই আমাদের সামনে এখন্ন প্রচুর চাকরির সুযোগ। সাধারণত, চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়া মানে মানুষের জন্য ভালো। কিন্তু অনেক বেশি বিকল্প সুযোগ সামনে থাকলে কখনো কখনো যে চাকরি বা কাজটি আমরা নেবো বলে মনস্থির করি, তার ওপর থেকে গুরুত্ব কমতে থাকে। এই ফোমো ইফেক্ট (ফিয়ার অব মিসিং আউট) আরও খারাপ রূপ নেয় সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে। সোশ্যাল মিডিয়া সবসময় আমাদের সামনে বিকল্প ক্যারিয়ার, স্থান ও লাইফস্টাইল নিয়ে আসে এবং আমাদের তখন মনে হয় যে সেটাই আমাদের বেছে নেওয়া উচিত।
তবে র্যাচেল ও এরিন তাদের গবেষণায় এও দেখেছেন যে, ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে অতীত আকড়ে বসে থাকার এই সমস্যাটি দূর করারও উপায় রয়েছে। বিশেষ করে তারা দুটি প্রধান কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন; এই দুটি কৌশল অবলম্বন করলে কর্মীরা তাদের অতীতের সিদ্ধান্ত নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে থাকা এবং অসস্তুষ্টি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন এবং ভবিষ্যতের দিকে ফোকাস করতে পারবেন।
১. কর্মভিত্তিক পরিচয় গড়ে তোলা
প্রথমত, গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যেসব কর্মী 'জব ক্রাফটিং' করতে পেরেছেন, তারা অন্যদের তুলনায় কম অমনোযোগী এবং সহকর্মীদেরও বেশি সহযোগিতা করেন। 'জব ক্রাফটিং' বলতে বোঝায় নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার পর সেই নিজ প্রচেষ্টায় সেই কাজকে সম্ভাবনাময় ও পরিপূরক করে তোলা। যদিও চাকরিতে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়; কিন্তু নিজের বর্তমান কাজের প্রতি একাগ্রতা ও আগ্রহ নিয়ে আসার কিছু না কিছু উপায় তো রয়েছেই।
উদাহরণস্বরূপ, একজন সমাজকর্মী, যিনি পশুচিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন, তিনি বর্তমান কাজের পাশাপাশি ট্রমায় থাকা পশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সাহায্য করতে পারেন। প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসাকে তিনি নিজের পেশাদার কাজের মধ্য দিয়েও প্রকাশ করতে পারেন; এতে দুই ধরনের সন্তুষ্টি পেতে পারেন তিনি। একইভাবে, একজন বিক্রয়কর্মী হয়তো ভ্রমণ লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন... তিনি বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন, যাতে করে তার বিদেশে ভ্রমণের সুযোগ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি বর্তমান কাজের মাধ্যমে উচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়াও অব্যহত থাকে। এভাবেই নিজের বর্তমানে কাজের মধ্য থেকে নানা ভূমিকা খুজে বের করা উচিত যেটি আপনাকে সত্যিই আনন্দ দিবে এবং মনে সন্তুষ্টি নিয়ে আসবে।
একই সময়ে ম্যানেজারদেরও তাদের কর্মীদের লুকায়িত প্রতিভা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা উচিত। কর্মীদের প্যাশন যে বিষয়ে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল উপায় খুজে বের করা যেতে পারে, যা কর্মীদের একটি আলাদা পরিচিতি তৈরি করবে। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, চাইলেই যেকোনো চাকরিতে থেকে ভিন্ন আরেকটি ভূমিকা পালন করা যায় না। কিন্তু কর্মীদের আগ্রহের উপর ভিত্তি করে সেরকম প্রজেক্টে তাদের নিয়োজিত করতে কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্টি ও উতপাদনশীলতা-দুটোই অর্জন করা যায়। অবশ্যই এ ধরনের কাজে সহায়তা করাটা চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু একজন প্রতিভাবান কর্মী হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চাইতে তাকে খুশি রাখাটাই বরং প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি সহজ ও লাভজনক।
২. মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা
দ্বিতীয়ত, গবেষণায় দেখা গেছে যে বাইরে থেকে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না হলেও, অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন একজন ব্যক্তির আচরণ ও কার্যকলাপে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।
মনোবিজ্ঞানীরা 'ইন্টারনাল লোকাস অব কন্ট্রোল' নামক একটি টার্ম ব্যবহার করেন- এটি এমন এক ধরনের প্রবণতা যেখানে ব্যক্তি তার জীবনে যা কিছুই হোক না কেন, সেটিকে নিজের কর্মফল হিসেবেই মনে করে; তারা ভাবে যা ঘটেছে তা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ঘটেনি। গবেষকরা দেখেছেন, এই বিশেষ প্রবণতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় দ্রুত অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে আগ্রহী। তারা তাদের নতুন চাকরিতে মানিয়ে নেওয়া চেষ্টা করেন এবং কাজে সক্রিয় হয়ে পড়েন।
'ইন্টারনাল লোকাস অব কন্ট্রোল' এর বিষয়টি শুরু হয় অতীতে ক্যারিয়ার নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে নিজেরই দায়বদ্ধতা ভাবার মাধ্যমে। কী হতে পারতো তা নিয়ে কম চিন্তা করা, বরং কেন নতুন পেশায় আসার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম সেদিকে বেশি মনোযোগ দিলে চাপ অনেকটাই কমে। এরপরে ভবিষ্যতে চমতকার ফলাফল করার জন্য নতুন উদ্যমে কাজে নেমে পড়া উচিত।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে জীবনের সকল ভালো-মন্দের বিচার করতে খানিকটা সময় প্রয়োজন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃতজ্ঞতাবোধ আমাদের জীবনে প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে এবং মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে। সেজন্য কেউ চাইলে একটি 'গ্র্যাটিচিউড জার্নাল' রাখতে পারে। জীবনে কোন কোন বিষয়ের জন্য আপনি কারো কাছে কৃতজ্ঞ, তা লিখে রাখতে পারেন। তবে সেজন্য নিজের স্বপ্নকে দূরে ঠেলে দেওয়া বা ক্ষতিকর পরিবেশে কাজ করাকে মেনে নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ জীবন ও ক্যারিয়ারকে আরও বড় পরিসরে মূল্যায়ন করতে শেখায় এবং বোঝায় যে আপনি আসলেই ভালো আছেন।
কী করলে কী হতে পারতো তা নিয়ে চিন্তা করাটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু জীবন ও কর্মস্থলে গেলে, আমাদের সামনে এই মুহূর্তে কী আছে এবং সেটার মাধ্যমেই আমাকে কাজ করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে- এই সচেতনতার মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলেই অতীত থেকে বেরিয়ে এসে জীবনে উন্নতি করা এবং বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে।
সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ