স্বাস্থ্য ও ওষুধ নীতি: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছিল তার স্বপ্ন, তার কাজের কথা। বিচিত্রার ১৯৮৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: বড় বড় সাহায্যদাতা পশ্চিমা দেশগুলোর শত শত শর্তের বেড়াজালে বাংলাদেশের মতো গরীব দেশগুলো যেখানে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত সেদেশে ওষুধনীতির মতো সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবিরোধী আইন কীভাবে কার্যকর হবে—বিশেষ করে বর্তমান আর্থসামাজিক রাজনৈতিক কাঠামোয়?
জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থায় বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে ওষুধনীতি প্রণীত হবারই কথা নয়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম এবং সম্ভবত সাম্রাজ্যবাদের ওপর বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশে ওষুধনীতি প্রণীত হওয়ার পেছনে আশ্চর্যজনকভাবে দুটো শর্তে সংযোগ ঘটেছে! প্রথমত: স্বাস্থ্য ও ওষুধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ এবং শোষণ কীভাবে চলে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একটি দল গোড়া থেকেই সচেতন ও সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের নতুন সামরিক সরকার যেকোনো কারণেই হোক সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থবিরোধী অর্থনীতি প্রণয়ন করেন। প্রতিটি নতুন সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসে এমন কিছু করতে চান, যা করলে তাদের ভিত নড়বে না, অথচ সুনাম হবে। ওষুধনীতির ক্ষেত্রে আমাদের মতো ওই ওয়াকিবহাল দল ও সামরিক সরকারের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটে। যার ফলশ্রুতি হচ্ছে ওষুধনীতি প্রণয়ন। সরকার তখন বুঝে উঠতে পারেননি যে, তাদের এ সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থকে প্রবলভাবে নাড়া দেবে। বিশেষজ্ঞরা তাদের রিপোর্টকে পুরোপুরি বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তৈরি করার ফলে সামরিক সরকারের বিভিন্ন কমিটি এর খুব একটা অদল-বদল করতে পারেননি। এর পুরোপুরি সুফল পাওয়া যেত যদি না আমলারা বাধা হয়ে না উঠত। তবে আমাদের ওষুধনীতি বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসা ও স্বীকৃতি লাভ করেছে। এবং ওইসব দেশের সরকার বিরোধিতা করলেও পত্র-পত্রিকা ও জনগণ সমর্থন দিয়েছেন। তাছাড়া পুঁজিবাদেরও অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তাই অনেক সময় পুঁজিবাদী দেশগুলোকেও পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু কিছু পুঁজিবাদবিরোধী পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। যেমন বর্তমানে ইংল্যান্ডে রক্ষণশীল সরকার ১৯৮৫ সাল অর্থাৎ এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে জিনেরিক নামে ওষুধ চালু করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের চিন্তা হচ্ছে দেশে জনগণের স্বাস্থ্যের অবনতি যেমন ঘটবে না এবং একই সঙ্গে খারাপ ওষুধগুলো বাতিলের ফলে বছরে ৪৯০ কোটি (১৪০ মিলিয়ন পাউন্ড) টাকা বাঁচবে।
আজকে বাংলাদেশের ওষুধনীতি দুবছর টিকে থাকার কারণে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশও এ ধরনের ওষুধনীতি প্রণয়নের কথা ভাবছেন। তবে এ ওষুধনীতিকে বানচাল করার জন্যও অব্যাহত চক্রান্ত চলছে। এ ক্ষেত্রে চক্রান্তকে রুখে দেয়ার একমাত্র শক্তি হচ্ছে বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। তারা ব্যর্থ হলে ওষুধনীতিও ব্যর্থ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: ওষুধনীতি সত্যিকার অর্থে কার্যকর করার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: ওষুধনীতি সম্পর্কে জনসাধারণ এবং অনেক চিকিৎসকের মনে ভুল ধারণা রয়েছে। এদের এই ভুল ধারণাটাকে বজায় রেখে ওষুধনীতির বিরোধীরা এ নীতির সুফল থেকে জনগণকে বঞ্চিত করছে। ওষুধনীতির দুবছর পরও প্রত্যেক চিকিৎসককে বাতিল ওষুধ বাতিলের কারণ এবং বাতিল ওষুধের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কোন ওষুধ দেয়া যাবে, সে সম্পর্কিত তথ্য সম্বলিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট এ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। অথচ এটার প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। এর সুফল জনসাধারণকে দিতে হলে প্রতিদিন দশ মিনিট করে রেডিও এবং টেলিভিশনে সমস্ত বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে। ওষুধনীতি প্রণয়নের পূর্বে সরকার প্রচারের জন্য তৎপর হবেন বলে বিশেষজ্ঞ কমিটিকে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ জাতির বড় দুর্ভাগ্য যে, যে ওষুধনীতি সরকারকে সুনাম দিয়েছে, জনগণকে সুফল দিয়েছে; কিন্তু তা সরকারের প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হয় না। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশের ওষুধনীতির ওপর ভিত্তি করে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে—যা সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে নন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তা দেখানো হয়েছে। কিন্তু সে ফিল্মটি ছিল ইংরেজিতে। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ছবি না তৈরি করলেও 'এভিটি' ফিল্মটি কি বাংলায় ডাবিং করে দেখানো উচিত নয়?
ওষুধনীতির পূর্বে অ্যান্টিবায়োটিকের সরকারি অনুমোদিত দাম ছিল আড়াই টাকা—যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৫ টাকা দরে। ওষুধনীতি আংশিক কার্যকর হওয়ার পর সেই একই কোম্পানি একই ওষুধ বাজারজাত করছে ১ টাকা ৩০ পয়সা দরে এবং খুচরা দোকানদের কমিশন দিচ্ছে শতকরা ৩০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। তার ওপর লাভ করছে। অন্যদিকে ক্রেতারাও সহজেই এক টাকায় কিনতে পারছেন। কিন্তু এই তথ্য কি প্রতিনিয়ত জনসাধারণকে জানানো উচিত নয়?
প্রশ্ন: বর্তমান সরকার ওষুধনীতিকে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বহাল রেখেছেন। আপনি কি মনে করেন পরবর্তী সরকার এটাকে আইনে পরিণত করতে পারবেন?
উ: ওষুধনীতি সাধারণ মানুষের স্বার্থে প্রণীত। ভবিষ্যতের সরকার যদি সাধারণ মানুষের স্বার্থকে রক্ষা করতে চান, তাহলে ওষুধনীতি আইনে পরিণত করতে বাধ্য হবেন। অবশ্যি যদি কেউ বহুজাতিক কোম্পানির ক্রীড়নক হন তবে অন্যথাও হতে পারে।
প্রশ্ন: ওষুধনীতি ঘোষিত হওয়ার পূর্বাপর পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করুন।
উ: ওষুধনীতি প্রণীত হবার পর থেকে এটা কার্যকর না করার জন্য একের পর এক শুরু হয় চক্রান্ত। ১৯৮২ সালের ২৯ মে প্রধান সামরিক আসন প্রশাসক ও তাঁর উপদেষ্টাদের সভায় ওষুধনীতি গৃহীত হলেও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দফতরের কর্মকর্তাদের কারণে তা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা বন্ধ থাকে। তারপর যদিও বা বাংলাদেশ টাইমসের সাহসিকতার কারণে একই বছর ১ জুন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, হল্যান্ড, ব্রিটেন ও পশ্চিম জার্মানির রাষ্ট্রদূতরা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে সরকার একটি রিভিউ কমিটি গঠন করেন। এই রিভিউ কমিটির রিপোর্টের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না এবং এটা ছিল এক ন্যক্কারজনক রিপোর্ট। বহুজাতিকের লোকেরাও এর থেকে ভালো রিপোর্ট করতে পারত। তবে আমাদের সঙ্গে কথা ছিল যে, রিভিউ কমিটির রিপোর্ট পেশ করলে, আমরা বিশেষজ্ঞ কমিটি ও রিভিউ কমিটি মুখোমুখি অলোচনায় বসব। সেই মোতাবেক রিভিউ কমিটি ও বিশেষজ্ঞ কমিটির মধ্যে সরাসরি আলোচনা হয় এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রিভিউ কমিটির রিপোর্ট বাতিল করে দেন। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা সবচেয়ে দুঃখজনক ও অবৈজ্ঞানিক। দুবছরের পরও মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন কোনো আলোচনা সভা সেমিনার করেনি; অথচ অলোচনা ছাড়াই তারা ওষুধনীতি বাতিল বা রিভিউ করার কথা বলছেন। দেশের স্বার্থবিরোধী চক্র এবং বিদেশি শক্তিগুলোর চাপের মধ্যে ওষুধনীতি বহাল রাখার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মেজর জেনারেল শামসুল হক এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এরশাদকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। বিশেষ করে জেনারেল এরশাদের অবিচল দৃঢ়তাই কাজ করেছে বেশি। তবে এ ক্ষেত্রে এ কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ওষুধনীতির বাকি সুপারিশগুলো এখনো কার্যকর করা হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশের সব জিনিসের দামই বেড়েছে, কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বাড়েনি। আর এটা সম্ভব হয়েছে ওষুধনীতির কারণে। ওষুধনীতি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে কয়েকটি ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের দাম আরো কমবে। ওষুধনীতি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো যে ২০০ মিলিলিটার বোতলের তরল অ্যান্টাসিডের (আলসারের ওষুধ) মূল্য কোনোক্রমেই ১৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়; অথচ তার দাম রাখছে ২২ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা দোকানদারদের কমিশন দিচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এতে লাভ হচ্ছে ওষুধ প্রস্তুতকারকদের, খুচরা দোকানদারদের; আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। একই ঘটনা ঘটেছে ভিটামিন ক্যাপসুলের বেলায়। যে ভিটামিন ক্যাপসুলের দাম ২৫ পয়সার ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত নয়; কিন্তু তার মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ৭০ পয়সা থেকে ১ টাকা দরে। আর এসব হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল্য নির্ধারক বোর্ডের অসচেতনতার সুযোগে। ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটি ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মার্কিন বহুজাতিক ফাইজার আয়রন ও ভিটামিনের পাঁচমিশালি ওষুধ 'হেপচুনা প্লাস' এবং ব্রিটিশ বহুজাতিক ফাইসন্স ভিটামিন ও আয়রনের পাঁচমিশালি ওষুধে 'ফ্যারেট' উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। উভয় ওষুধই ওষুধনীতির নীতিবিরুদ্ধ। একইভাবে অপর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ওয়েথ কারখানা স্থাপন না করেই অ্যান্টাসিড বাজারজাত করছে। সম্ভবত মার্কিন সরকারের চাপের মাঝে এ-জাতীয় ঘটনা ঘটছে। তবে এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ফ্যারেট বা হেপচুনা প্লাস কেবলমাত্র আয়রনের উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করলে নীতিবিরুদ্ধ হবে না। তবে হেপচুনা প্লাস নামটি বাতিল করে দেয়া অবশ্যকর্তব্য। কারণ তা না হলে চিকিৎসকরা বহু সমস্যার আসান হিসাবে ভুলবশত ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যাবেন।
ওষুধনীতিতে বলা হয়েছে, যে সব ওষুধ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় তা আমদানি করা যাবে না। কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে সে নীতি লঙ্ঘন হচ্ছে। ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির অসতর্কতার কারণে জার্মানি থেকে এলবোথিল নামক অপ্রয়োজনীয় ওষুধের আমদানি করা হয়েছে। এ ওষুধ কোম্পানির লিটারেচার পড়লে দেখা যায় যে, জার্মানি ছাড়া এ ওষুধ সম্পর্কে অন্য কোথাও কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি এবং অধিকাংশ রেফারেন্সই ২০ বছরেরও অধিক পুরানো। এভাবেই বহুজাতিকরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের অনুপ্রবেশ ঘটায়।
ওষুধনীতিতে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নাম প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি প্রাথমিক পরিচর্যার ৪৫টি ওষুধকে অবিলম্বে কেবলমাত্র জিনেরিক নামে বাজারজাতকরণের জন্য কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা উচিত এবং জিনেরিক ওষুধটি যে কোম্পানিই প্রস্তুত করে না কেন তার একই মূল্য হওয়া উচিত। ৫০ লাখ টাকার উপরে যে সমস্ত কোম্পানির বাৎসরিক বিক্রি হয়েছে তাদের উপরে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের বিষয়টি কড়াকড়িভাবে আরোপ করা উচিত। বড় কোম্পানিগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে এর কোনো রকম শিথিলতা একদমই বাঞ্ছনীয় নয়। এ সমস্ত কোম্পানির মান নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তিনজন লোককে নিয়ে একটি পরিদর্শক কমিটি গঠন করা উচিত। এই কমিটির মুখ্য পরিদর্শক হবেন ড্রাগ ইন্সপেক্টর এবং বাকি দুজন হবেন পর্যবেক্ষক পরিদর্শক। এদের একজন হবেন ওষুধ প্রস্তুতকারক সমিতির প্রতিনিধি এবং অপরজন হবেন চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট কিম্বা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি। এ জাতীয় পরিদর্শক কমিটি থাকলে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দেশে পর্যাপ্ত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট না থাকায় প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসককে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাগ ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। তারা স্থানীয় ভিত্তিতে ওষুধের দোকানসমূহ পরিদর্শন করে ভেজাল ও বাতিল ওষুধ চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন এবং তারা প্রেসক্রিপশন ছাড়া মাদকদ্রব্য ব্যবহারও বন্ধ করতে সক্ষম হবেন ।
বর্তমান অবস্থায় পল্লী অঞ্চলে কেবলমাত্র প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে ওষুধ বিক্রির ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে আটটি মেডিকেল কলেজের শহরে অবিলম্বে কেবলমাত্র প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে ওষুধ বিক্রির ব্যবস্থা করা যায়। চিকিৎসকদের কোড নম্বর সম্বলিত প্রেসক্রিপশন প্যাড সরকারই সরবরাহ করবেন। প্রতিটি প্রেসক্রিপশনের তিনটি পাতা থাকবে। এর একটি চিকিৎসকের কাছে থাকবে; আর দুটি রোগী নিয়ে যাবেন এবং রোগী দোকানদারকে একটা দিয়ে দেবেন। এ জাতীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে ভবিষ্যতে কোনো জরিপ বা পরিসংখ্যান গ্রহণ করা সহজ হবে এবং মাদকদ্রব্যের ব্যবহার কমানোও সম্ভব হবে।
প্রশ্ন: আপনি বিভিন্ন কোম্পানির কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা মান নিয়ন্ত্রণের অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত করলেন—একই অভিযোগ কি গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেলস সম্পর্কেও করা যায় না?
উ: না; বিজ্ঞাননির্ধারিত পরিপূর্ণ মান নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে মূলতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরবরাহই আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমাদের উপরে, কারও ওষুধের মান হওয়া সম্ভবপর নয়, বিজ্ঞাননির্ধারিত মানের নিয়মাবলি সজ্ঞার সঙ্গে পালন করলে অন্যদের দেশিই হোক বা বিদেশি বহুজাতিকই হোক, তাদের মান আমাদের সমান হবে মাত্র। একশত নম্বরের মধ্যে একশত নম্বরের অধিক পাওয়া কি সম্ভব? সঠিক মানের ওষুধ তৈরি না করার একটি মাত্র কারণ—মানুষকে প্রতারণা করে, অত্যধিক লাভ করে নিজের বৈভব বাড়ানো। কিন্তু গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেলস ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নয় বিধায় মানুষকে প্রতারণা করে লাভের প্রশ্ন আসে না। কারণ এই লাভ কোনো ব্যক্তিকে সমৃদ্ধশালী করবে না, কারো পকেটে যাবে না। বরঞ্চ উন্নতমানের ওষুধ সুলভে বাজারে সরবরাহ করলে জনগণের উপকার হবে এবং কর্মীদের আনন্দ হবে। গণস্বাস্থ্যের কর্মীদের আত্মীয় সাধারণ জনগণ।
গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেলসের মান নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় কাঁচামাল কেনার পূর্বেই। কাঁচামাল উৎপাদকদের সরবরাহকৃত স্যাম্পলের বিশদ বিশ্লেষণ দিয়ে ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া, ইউনাইটেড স্টেটস ফার্মাকোপিয়া বা ইউরোপিয়ান ফার্মাকোপিয়া নির্ধারিত মানদণ্ড উত্তরণে আমরা কাঁচামালের অর্ডার দেই। কাঁচামাল আমাদের হাতে পৌঁছার পর ফোরানটাইলে রেখে, কাঁচামালের প্রতিটি ড্রাম বিশ্লেষণ করার পর উৎপাদন বিভাগে পাঠানো হয়। উৎপাদন বিভাগে সর্বক্ষণ নজর রাখার জন্য রয়েছে ইনপ্রসেস কোয়ালিটি কন্ট্রোল—প্রতিটি পদক্ষেপে ওষুধের বিশ্লেষণ করা হয়—আমাদের মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগই বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় মা ননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি এবং বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত ও নিবেদিত কর্মী দ্বারা পরিচালিত। মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চারটি প্রধান শাখা—মাইক্রোবায়োটিক কেমিক্যাল, স্পেকট্রোফটোমেট্রিক ও প্রাণীতে গবেষণা। এসব শাখার পরীক্ষা উত্তীর্ণের পরই তদুপরি কেবল আমাদের ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়। ফার্মাসিউটিকেলসের প্রতিটি কর্মীকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত গুড মানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কারও কখনও অসুখ হলে আমরা নিজেরা গণস্বাস্থ্যের ওষুধ খাই, ছেলে-মেয়েদের খাওয়াই। তাই ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বদা সজাগ।
প্রশ্ন: আপনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং এটাও সত্য যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে একা কখনো আপনি জয়ী হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখন পর্যন্ত আপনি কোনো সমঝোতায় আসেননি, বরং এদের অনেকে আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখে। এ সমস্যার সমাধান কীভাবে করবেন?
উ: সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায় দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন স্থানে বহু লোক সক্রিয় রয়েছেন। আমি তাদেরই একজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বিচ্ছিন্নভাবেই সংগ্রাম চালাচ্ছেন, সম্মিলিতভাবে নয়। তাদের সম্মিলন ঘটলেই এ যুদ্ধে বিজয় সহজ হবে। দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বামপন্থী দল বহু আছে। তবে বামপন্থী কথা বললেই যে প্রগতিশীল হবে তার নিশ্চয়তা এক্ষেত্রে দেখছি না। শিক্ষা সমাজ ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে বামপন্থীদের অনেকেই এখনো অন্ধকারে আছেন এবং প্রতিনিয়তই তারা অন্ধকার ঘরে একটি অশরীরী কালো বিড়ালকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে চোখ মেলে সব কিছু পরীক্ষা করে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, তারা অহেতুক সন্দেহ বাতিকে ভুগছেন। তাদের অন্ধকারে থাকার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের অনুচর এবং বহুজাতিক কোম্পানিরা তাদেরকে আমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আসলে তারা আমাকে ভুল বুঝছেন। তাদের সঙ্গে আমার হয়তো অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক লাইন সম্পর্কে কৌশলগত বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু সত্যিকার বামপন্থী নেতাদের আমি শ্রদ্ধা করি। জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে তারা আন্দোলন শুরু করলে আমরাও সে সংগ্রামে অংশ নেব এবং সহায়ক শক্তি হিসাবে অবশ্য কাজ করব। অর কিছু না হোক বৃহত্তর সংগ্রামে বহু যোদ্ধা এই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন বিদেশি সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে? কেন, কীভাবে?
উ: বিদেশি সাহায্যের বৃহৎ অংশই ব্যয় হয় বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রতিপালনে এবং একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অপব্যয় হয় ভুল পরিকল্পনা ও ঘুষ দেয়ায়। প্রকৃতপক্ষে বিদেশি সাহায্য দেশের কোনো কাজেই আসে না। যে সাহায্য দেশের কোন কাজে আসে না, সে সাহায্য নিয়ে দেশের দায় আরো বাড়ানো অর্থহীন। বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ নিশ্চয়ই বেঁচে থাকতে পারবে এবং উন্নতিও হবে। প্রথমে আমাদের অনুৎপাদন খাতে অর্থ ব্যয় বন্ধ করতে হবে। জাতির জীবনে আগামী দশ বছরে কোনো বিলাসিতার অবকাশ থাকবে না। সব ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। অর্থ বিনিয়োগ হবে প্রাথমিক শিক্ষায়, প্রাথমিক পরিচর্যার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদনে, লাঙ্গল হাতে চাষ করে যে কৃষক তার খাতে। কোনোক্রমেই পাঁচশ থেকে সাতশ স্কয়ার ফুটের উপরে কোনো বাসস্থানে অর্থ বিনিয়োগ করতে দেয়া হবে না। প্রসাধনী সামগ্রীর উৎপাদনে বিনিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে জাতির ভাগ্য উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত। অর্থ বিনিয়োগ হবে নারী মুক্তি, নারীদের প্রশিক্ষণে, অর্থ বিনিয়োগ হবে পতিত জমিতে উৎপাদনের জন্য। বাংলাদেশের সব আবাদি জমিতে বছরে দুটো উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদন এবং ভরে যাওয়া ডোবা, নালা, খাল-বিলের সংস্কার করে মৎস্য চাষ, এবং হাঁস-মুরগির খামার করলে দেখা যাবে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা তো বেশি নয়ই, বরং আরো কম। অর্থের সঙ্গে শিক্ষা যোগ হলে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাবে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত প্রকল্পের জন্য শর্তহীন বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ দোষনীয় নয়। যে বৈদেশিক সাহায্য বাংলাদেশকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে; সে ধরনের সাহায্য গ্রহণে আমি আপত্তির কিছু দেখি না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে জাতীয় পুঁজির বিকাশ কি সম্ভব?
উ: বর্তমান আর্থসামাজিক কাঠামোয় পুরোপুরি স্বাধীনভাবে জাতীয় পুঁজি বিকাশ সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশে শিল্প কল-কারখানার উন্নতি না ঘটার ফলে পুঁজি বিকাশে বাধা পড়ছে। বর্তমানে পুঁজিটা পুঞ্জিভূত আছে ব্যবসায়ী ও ইন্ডেন্টর শ্রেণীর হাতে এবং তাদের সাথে রয়েছে সরকার এবং সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে তাদের প্রভু। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করছে। তাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের কোনো সংঘাত নেই এবং সে প্রশ্নও ওঠে না। তাই স্বাধীনভাবে জাতীয় পুঁজি বিকাশের অবকাশ খুব কম। অপরদিকে শিল্পের (Industry) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। '৭০-এর দশক পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলো তাদের প্রযুক্তিকে নিজ দেশে সংরক্ষণে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু ৭০-এর পর চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে। তার পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে কতকগুলো প্রযুক্তি তৃতীয় বিশ্বে স্থানান্তরে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। কতকগুলি ক্ষেত্রে তারা তৃতীয় বিশ্বে জয়েন্ট ভেঞ্চারে শিল্প কারখানা স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাপান জয়েন্ট ভেঞ্চারের জন্য শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত বিনা সুদে অর্থ দিয়ে থাকে।
আজ প্রতিটি দেশে গড়ে উঠেছে রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ জোন। বড় বড় শিল্পগুলো যৌথ উদ্যোগে হলেও, স্বাধীন পুঁজি বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোন দ্বন্দ্ব নেই। কারণ যৌথ উদ্যোগের অপর পার্টি বাংলাদেশি। সুতরাং স্বাধীন পুঁজি বিকাশের জন্য প্রযুক্তিগত উন্নতিও প্রয়োজন।
প্রশ্ন: আপনার প্রতিষ্ঠান চালাবার সিংহভাগ ব্যয়ের জোগানদার বিদেশি সাহায্য সংস্থাসমূহ। আপনি যদি আন্তরিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হন, এরা আপনাকে কেন অর্থ সাহায্য করে? কোনো কারণে এরা যদি সাহায্য বন্ধ করে, তাহলে এত বড় প্রতিষ্ঠান আপনি কীভাবে চালাবেন?
উ: যে সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের সাহায্য দিচ্ছে, তাদের অবস্থান সাম্রাজ্যবাদী দেশে, এটা সত্য। এসব সংস্থা বিশ্বাস করে—দারিদ্র্য সাম্রাজ্যবাদী দেশে যে কেবল রয়েছে শুধু তাই নয়, বরং ক্রমশ বাড়ছে। অনুন্নত বিশ্বের দারিদ্র্যতার অন্যতম কারণ ওইসব উন্নত দেশের অতীতের ঔপনিবেশিক ও বর্তমানের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ। তাই তারা তাদের অতীত কার্যকলাপের কিছুটা ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা নিয়ে আমাদের সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে এসব সংস্থার অয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে সাধারণ মানুষের চাঁদা। আসলে ধনী দেশের দরিদ্ররা সাহায্য করতে চাইছে দরিদ্র দেশের দরিদ্রদের। উন্নত দেশের সাধারণ মানুষের মনে ক্রমশই দানা বাঁধছে যে, সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে আয়কর দিতে অস্বীকার করছেন। সরকারও তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন এবং এ সমস্যা উত্তরণের পদ্ধতি হিসাবে আয়করের অর্ধেক অংশ পর্যন্ত করদাতার ধর্মীয় ও আদর্শগত বিশ্বাস অনুসারে ওই সমস্ত সংস্থাকে দিতে পারবে। হল্যান্ডে এই আয়কর, যারা প্রোটেস্ট্যান্ট তারা প্রোটেস্ট্যান্ট ফান্ডে দেয় এবং যারা ক্যাথলিক তারা ক্যাথলিক ফান্ডে জমা দেয়। কিন্তু এর মাঝে আরেকটি দল আছে, যারা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী নয়, তারা ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের একটি সংস্থা আছে; নাম নোভিব (Novib) অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা। এই সংস্থাই চিলিতে আলেন্দে নিহত হলে তার সহকর্মীদের পুনর্বাসনে সাহায্য করে। তারা নিকারাগুয়া ও মোজাম্বিক সরকারকেও সাহায্য করছে। এই 'নোভিব'ই আমাদের কয়েকটি প্রকল্পে সাহায্য করেছে। এটি একটি শর্তহীন অনুদান। তবে এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানে জন্মলগ্ন থেকে দুবছর পর্যন্ত কোনো বিদেশি সাহায্য ছিল না। স্থানীয় জনগণের দান ও বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্যে চলেছে।
বর্তমানে আমাদের সাভারস্থ ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে দুটি বাদে বাকি সব কয়টি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এগুলোর দৈনন্দিন পরিচালনার জন্য কোনো বৈদেশিক সাহায্যের দরকার নেই। তবে এগুলোর আরো প্রসার ঘটানোর জন্য মূলধনী সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে। আমাদের গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল এ বছর লাভের দিকে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানের লাভের অর্ধেক ব্যয় হবে ফ্যাক্টরির কর্মী, ভবন, মেশিনপত্রের উন্নতির জন্য। বাকি অর্ধেক দিয়ে আমাদের ঘাটতি প্রকল্পগুলো চালানো হবে। তাছাড়া আমাদের অধিকাংশ কর্মী সবরকম সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলেও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে প্রকল্প চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। পুঁজিবাদী সংস্থাই আমাদের সাহায্য দিতে আগ্রহী। কিন্তু আমরা তদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করি।
প্রশ্ন: আপনি সাধারণ মানুষের সার্বিক অবস্থা পরিবর্তন এবং উন্নত করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দর্শন বা নীতিতে বিশ্বাসী কি? হলে সেটা কী?
উ: জিএনপির মাধ্যমে জাতির বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটে না। দরিদ্র জনগণের অবস্থার উন্নয়নেই জাতির উন্নয়ন। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলো মূল ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষি এবং মহিলা ও শিশু। এদের অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যেই আমরা কাজ করি এবং আমরা বিশ্বাস করি সাধারণ মানুষের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি এদের সাথে সম্পৃক্ত। ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষির ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দিতে হলে, তাদের সেই শিক্ষা দিতে হবে যা তাদেরকে প্রযুক্তিবিদ্যার সংস্পর্শে আনবে। কিন্তু এই প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে গেলে ওই কৃষকের ছেলের অন্নের চিন্তাও করতে হবে। অন্তত যে সময়টা সে স্কুলে কাটায়, সে সময়ে একবেলা খাবার এবং বইপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে তার পক্ষে শিক্ষার সংযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। ঠিক একইভাবে আমরা দরিদ্র মানুষের স্ত্রী বা মেয়ে সাধারণ বা প্রযুক্তি শিক্ষা নিতে এলে তাকে ঢেঁকির কাজটা বাদ দিতে হবে। তবে প্রযুক্তি শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাধারণ শিক্ষা তারা না পেলে কল-কারখানার সস্তা শ্রমিকে পরিণত হবে এবং শোষিত হবে। আর মহিলা বলে সে আরো শোষিত হবে। আমরা এসব চিন্তা করেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনি '৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাগরিক কমিটির মাধ্যমে জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট পদে অন্যতম প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করাবার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। এই নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীর শোচনীয় পরাজয়ের মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করবেন?
উ: ১৯৮১ সালে আমরা একটা বিষয় উপলব্ধি করেছিলাম যে, জীবিত জিয়ার চেয়ে মৃত জিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী। মৃত জিয়াকে ভর করে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এবং এই সাথে সাথে একটি সামরিক সরকারেরও জন্ম হতে পারে। এই অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র জেনারেল ওসমানীকে নির্বাচনে দাঁড় করাবার মাধ্যমে। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দেশে সংসদীয় শাসনের প্রবর্তন করতেন এবং তাকে আঘাত করার মতো দুঃসাহস কারো হতো না।
জেনারেল ওসমানীকে বিরোধী দলের একক প্রার্থী হিসাবে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যেই সরকারি চক্রান্তে প্রতিটি বিরোধী দল থেকেই একজন করে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দাঁড় করানো হয়। ফলে সহজে অথর্ব বৃদ্ধ সাত্তার নির্বাচিত হন এবং সময়মতো তাকে সরিয়ে দিয়ে সামরিক শাসনের প্রবর্তন হয়। আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কিন্তু বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছি বিরোধী দলগুলোর অদূরদর্শিতার কারণে। অমাদের সন্দেহ সঠিক প্রমাণ হয় ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
প্রশ্ন: সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করার কোনো পরিকল্পনা আপনার আছে কি? না থাকলে এদেশের রাজনীতিতে আপনি নির্দিষ্ট কোন ভূমিকা পালন করতে চান?
উ: রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়। রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ছাড়া দরিদ্র জনগণের পরিপূর্ণ ভাগ্য পরিবর্তনে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: সামরিক শাসন অবসানের লক্ষে পরিচালিত ২২ দল, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
উ: সামরিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সবচেয়ে গৌরবময়। তাদের এই সংগ্রাম ব্যাহত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তার অস্বচ্ছতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে। তাদের প্রজ্ঞার অভাবের কারণে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এখন তাদের পাশে দাঁড়াবার দুঃসাহস দেখাতে পারছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিষ্ঠার সাথে স্পষ্টভাবে সত্য কথা না বলার কারণে দেশে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে নির্বাচন হলে পার্লামেন্টে বিরোধী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এরশাদই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এবং তা হবে বিরোধী দলগুলোর অনৈক্যের কারণে। নির্বাচন না হলে একটা বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হবে। আর যদি শ্রমিক ও ছাত্রদের আন্দোলনের নৈকট্য সৃষ্টি হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ আন্দোলন আরো জোরদার হবে।
প্রশ্ন: বিচিত্রার এক জরিপে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ আপনাকে সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিপরিষদে দেখতে চান। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব সরকারিভাবে এলে আপনি কীভাবে নেবেন?
উ: সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এ-জাতীয় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। জাতির সাময়িক সংকট উত্তরণে আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।
প্রশ্ন: একজন সাংবাদিক আপনার প্রতিষ্ঠান দেখে বক্তব্য করছিলেন আপনি ইউটোপিয়ান চিন্তায় আক্রান্ত। আপনার একলা চলো নীতি আপনাকে কোন ভবিষ্যতের দিকে নেবে বলে মনে করেন?
উ: আমাদের চিন্তাধারা ও কার্যক্রম দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ কখনও এশিয়ার সুইজারল্যান্ডে পরিণত হবে না। তবে সাধারণ মানুষের কথা মনে রেখে দেশ পরিচালিত হলে কোনো মানুষ অনাহারে মারা যাবে না, দৃষ্টিহীনতায় ভুগবে না, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পুরোনো কাপড় পরতে হবে না। সবাই স্বাস্থ্য নিয়ে বাঁচবে। বাস্তব স্বীকার করে মানুষের জন্য কাজ করা কি ইউটোপীয়?
উপসংহার টানার আগে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা আবশ্যক—তা না হলে গোটা বিষয়টা একপেশে হয়ে যাবে। তৃতীয় বিশ্বে সাহায্য সংস্থাগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ভূমিকার ফলশ্রুতি। পুঁজিবাদ যখন গোড়ার পর্যায়ে তখন বিশ্বের সম্পদশালী অঞ্চলগুলো (যেগুলো এখন দরিদ্র অঞ্চল বলে চিহ্নিত) থেকে প্রাথমিক লুণ্ঠন পরিচালনা ছিল পুঁজিবাদ সুসংহত করবার অন্যতম শর্ত। এ শর্ত পূরণের জন্যে তখন মিশনারিদের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পাশ্চাত্যের বেনিয়া পুঁজির আগমন নিষ্কণ্টক করবার জন্যে এই মিশনারিরা আফ্রিকা, এশিয়ায় বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে; এসব এলাকায় সৃষ্টি করেছে সহযোগী শক্তি—সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে সহযোগিতার আবহ। আফ্রিকান এক রাজনৈতিক নেতা এদের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, 'মিশনারির লোক এসে আমাদের সম্মুখে দাঁড়াল। তার হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের হাতে ছিল এই ভূখণ্ড। সে বলল, মুক্তি পেতে হলে স্রষ্টার নামে চোখ বোজো। চোখ বুজলাম। কিছু পরে চোখ খুলে দেখলাম আমার হাতে ভূখণ্ড নেই, আছে বাইবেল—আমার ভূখণ্ড তার হাতে।' এই প্রতীকী ঘটনা বিশ্ব পুঁজিবাদ বিকাশের একটি পর্যায়কে আমাদের কাছে ধরিয়ে দেয়। সেই ভূখণ্ড নিয়ে নেবার পর পুঁজিবাদ বিকশিত হয়ে দানবাকৃতি পেয়েছে। নিজেদের অপরিহার্য সংকট যখন তাদের অন্তিমকাল ঘোষণা করছে তখন তাদের আবার সেই ভূমিকায় নামতে হচ্ছে, একটু অন্যভাবে।
অন্যভাবে নেয়া এই ভূমিকার মূল দিক হচ্ছে সাহায্য সংস্থা। উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে এই সংস্থাগুলোর কেন্দ্র। দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্য প্রচার করে ব্যাপকভাবে করমুক্ত চাঁদা তুলেই এসব সংস্থার তহবিল গঠিত হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও 'দারিদ্র্য দূর করবার মহৎ উদ্দেশ্যে' এসব সংস্থাকে সহায়তা করে থাকে। প্রতিটি সাহায্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে সে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের, যারা বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম খুঁটি, বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব। সবরকম রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিয়ে এসব সংস্থা কাজ চালায় (আনু মুহাম্মদ—সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা টার্গেট গ্রুপে এবং কৃষক মুক্তি শীর্ষক বুকলেট) ।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওইসব সাহায্য সংস্থার সাহায্যেই পরিচালিত। কিন্তু বাংলাদেশে অন্যান্য সাহায্য সংস্থার থেকে গণস্বাস্থ্য ব্যতিক্রম। কারণ গণস্বাস্থ্যের সমস্ত প্রকল্প গড়ে উঠেছে একটি ভিন্ন উদ্দেশ্য ও আদর্শের ভিত্তিতে। প্রগতির পথে মোটিভেশন গণস্বাস্থ্যের প্রধান লক্ষ্য। সাহায্যের অর্থে ব্যক্তিগত প্রাচুর্যে গড়ে তোলার অবকাশ এখানে নেই। তবে অনেকের কাছে যে জিনিসটা খারাপ লাগতে পারে, তা হচ্ছে—গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র রেজিমেন্টাল সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে, যা পুঁজিবাদী মন-মানসিকতার লোকদের জন্য সুখকর নয়। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলায় এখানকার জীবন পরিচালিত। যা সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে বিদ্যমান। যে সমস্ত লোক জীবনের অনাবিল সুখ, শান্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণস্বাস্থ্যে কাজ করতে যাবেন, তারা হতাশই হবেন।