কার্ল মার্ক্সের শহরে…
ত্রিয়ের-কে বলা হয় জার্মানির সবচেয়ে পুরাতন শহর, রোম সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরুরও কয়েকশ বছর আগে এই শহরটি বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক গবেষণার পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ত্রিবেতা নামের এক আসিরিয়ান যুবরাজ ত্রিয়েরের গোড়াপত্তন করেন প্রায় ৪০০০ বছর আগে! পরবর্তীতে রোমানদের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয় শহরটি।
এখনো জনপদের বিভিন্ন স্থানে রোমানদের তৈরি নানা স্থাপত্য সগর্বে সেই দ্যুতিময় অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে সুপ্রসিদ্ধ হল পোর্টো নিগ্রা। শহরের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত এক সুউচ্চ, অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর এক প্রবেশদ্বার। আল্পস পর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত এটিই সর্ববৃহৎ রোমান প্রবেশদ্বার।
ত্রিয়েরে ঢোকার পরপরই অতি আকর্ষণী পোর্টা নিগ্রা চোখে পড়ে। সাথেসাথেই সময় যেন পিছিয়ে গেল দুই হাজার বছর। কালের অমোঘ নিয়তিতে সুবিশাল এই স্থাপত্যের অনেক জায়গায়ই মূল রঙ চটে কালো হয়ে গেলেও অটুট খিলানগুলো দেখে বোঝা যায়, আরও অনেক দিন কালের করাল গ্রাস ও বর্তমান সভ্যতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তা টিকে থাকবে। পোর্টা নিগ্রা সহ ত্রিয়েরের বেশ কিছু রোমান স্থাপত্য ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব সম্পদ, মানে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে ঘোষিত।
বেশ খানিকটা সময় এই বিস্ময়টি পর্যবেক্ষণ করে এগোলাম শহরের অন্য প্রান্তে একটি বিশেষ বাড়ির উদ্দেশ্যে; মূলত যা দর্শনের জন্যই আমাদের আগমন এই প্রাচীন শহরে। হাতের ম্যাপ দেখে এই গলি, সেই গলি ঘুরে অবশেষে তেঁতলা সেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম বিমুগ্ধ চিত্তে; যার দরজায় ধাতব ফলকে লেখা 'কার্ল মার্ক্স হাউজ মিউজিয়াম'। হ্যাঁ বন্ধুরা, এই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, কম্যুনিজম ও মার্ক্সবাদের জনক কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স। যার মতবাদ ও চিন্তাধারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছে শত কোটি মানুষকে একটি শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য।
বর্তমানে বাড়িটিকে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম সেই পুণ্যতীর্থে। কার্ল মার্ক্স ১৮১৮ সালের ৫মে এই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যালয় জীবন শেষ করে উচ্চ শিক্ষার্থে যখন তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন ততদিনে এই ত্রিয়েরে অতিবাহিত হয়ে গেছে ১৭টি বসন্ত। সেই অর্থে বলা যায় অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শনসহ নানা সামাজিক কাঠামো নিয়ে তিনি যে বৈপ্লবিক তত্ত্বগুলো রচনা করেছেন তার বুনিয়াদ এই শহরটিতেই।
১৩ বছর বয়স পর্যন্ত মার্ক্স বাড়িতেই পরিবারের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করতেন, এরপরে তার বিদ্যালয় গমন শুরু হয়। বাড়ির প্রতিটি কক্ষই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সাজানো, চেষ্টা করা হয়েছে সেই সময়ের আসবাবপত্র দিয়ে অতীতের একটা আবহ ধরে রাখার। কয়েক জায়গায় আছে মার্ক্সের প্রথম প্রকাশিত নানা রচনা ও বইয়ের অতি দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, সেই সাথে ছাত্রাবস্থায় রচিত কবিতাগুচ্ছ, পরিবার ও অন্যান্য কাছের মানুষদের সাথে তার আলোকচিত্র, ব্যবহার্য নানা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।
কিউরেটরের কাছে জানা গেল, বছরে বত্রিশ হাজার পর্যটক আসেন বাড়িটি দেখতে, এর মাঝে এক তৃতীয়াংশই চীনা। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ক্ষমতা দখলের পরপরই এই বিশ্বখ্যাত বাড়িটি জবর দখল করে ছাপাখানার কাজে ব্যবহার করে বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত! পরবর্তীতে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয় জাদুঘরটির অগ্রযাত্রা। মার্ক্সের নিজের হাতে লেখা কিছু চিঠিও আছে প্রদর্শনের জন্য।
ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয় কি অতিমানবীয় দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন এই আত্নভোলা দার্শনিকটি! ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটার সম্ভাবনা তিনি দেখেছিলেন তা ঘটার শত বছর আগে; বর্তমান বিশ্বের টালমাটাল বিপর্যস্ত টালমাটাল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা ভাবনা করছে তা মার্ক্সের চিন্তাপ্রসূত অর্থনীতিরই প্রতিফলন। যে কারণে সাম্প্রতিক টাইম ও নিউজউইকের মত ম্যাগাজিনে কার্টুন ছাপা হয়েছে কবর থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছেন কার্ল মার্ক্স!
বাড়িটির অধিকাংশ কক্ষই একটির সাথে আরেকটি কক্ষ জুড়ে দিয়ে গ্যালারির মত করা হয়েছে। এমন কয়েকটি কক্ষে চারদিকের দেয়াল জুড়ে মার্ক্সবাদ গ্রহণকারী রাষ্ট্রনায়ক ও বিপ্লবীদের নানা ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র; আছে জনগণের ভোটে প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত মার্ক্সিস্ট রাষ্ট্রপতি চিলির সালভেদর আয়েন্দে; কিউবান বিপ্লবের প্রাণপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা; গণচীনে কম্যুনিজমের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং; কঙ্গোর নিহত বিশ্বনেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা; স্বাধীন ভিয়েতনামের স্বপ্নদ্রষ্টা হো চি মিন; তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক ও জনপ্রতিনিধিদের ছবি, তাদের সম্পর্কিত অজানা তথ্যের সম্ভার, নানা স্মারক।
একটি কক্ষের মেঝেতে বিশালাকৃতির পৃথিবীর ম্যাপ যাতে এককালের কম্যুনিজম অধ্যুষিত দেশগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করা আছে, সেখানে দেখা যায় একসময় বিশ্বের অনেক দেশেই চালু ছিল সেই শাসন ব্যবস্থা। তবুও বিশাল এক কিন্তু থেকে যায়-- স্ট্যালিনের রাশিয়া, চসেস্কুর রোমানিয়া, পলপটের কম্বোডিয়া, কিম জং ইলের পরিবারের উত্তর কোরিয়ায় চালিত শাসন ব্যবস্থাকে কি কম্যুনিজম বলা চলে? যেখানে শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজ গড়ার বদলে বিশেষ কিছু ব্যক্তি বা শ্রেণী দণ্ডমুণ্ডের সর্বময় কর্তা হয়ে বসে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে…