কার্ল মার্ক্সের ১৪০তম প্রয়াণ দিবস: মার্ক্স কি এখনও প্রাসঙ্গিক
কার্ল মার্ক্সের ১৪০তম প্রয়াণ দিবস পার হলো। লন্ডনের হাইগেট সিমেট্রিতে শায়িত মার্ক্স যে জার্মান শহরে জন্মেছিলেন সেখানে তার দর্শন ঠিকমত জায়গা পায়নি। আজ অবধি জার্মানরা কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে তেমন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। যদিও বিশ্বের বহু দেশে তাকে নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হতো। জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ মার্ক্সীয় দর্শনের মৌলিক তত্ত্ব বাস্তবায়নের পথে অনেক কিছু সম্পন্ন করেছে। সেই মৌলিক তত্ত্ব হচ্ছে, মানুষের জীবনের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা। জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ মানুষের এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পেরেছে। জার্মানির শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই ফ্রি। চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনুরূপ। মানুষের বাসস্থান, কর্মসংস্থান সবই রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে। যদিও রাশিয়াতে যে ধরনের মার্ক্সীয় দর্শনের প্রয়োগ করা হয়েছিল- উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা রাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া, তা জার্মানিতে করা হয়নি।
উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা ব্যক্তির হাতে রেখে বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে জনগণের সহায়তার জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেমন রেল ব্যবস্থা রাষ্ট্রের কাছে। তেমনি আরো কিছু মৌলিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে।
উৎপাদন ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে প্রায় ৭০ বছরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং জনগণের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। চীন '৪৯ সালের প্রথমদিকে উৎপাদন ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ফলে একই পরিণতি লাভ করেছিল। এর ফলে এই দুটি ভূখণ্ডের রাজনৈতিক দর্শন পাল্টে যায়। ৯০ দশকের শুরু থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার তত্ত্ব ত্যাগ করে ব্যক্তিখাতের বিকাশ ঘটাতে শুরু করে। তবে বহু ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ রাখে। এখন এই দ্বৈত উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিমানুষের মঙ্গল ও বিকাশ সংঘটিত হয়েছে।
দেশ দুটি দারিদ্রতার সীমানা পেরিয়ে বহুকাল আগে বেরিয়ে এসেছে। মানুষের প্রতিটি মৌলিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। সেই বিবেচনায় ভিন্ন ধরনের মার্ক্সীয় দর্শন জার্মানিরা অব্যাহতভাবে অনুসরণ করেছে- মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা এবং আয় বৈষম্যে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
২০০ বছর আগে জন্ম নেওয়া কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, হেগেল প্রমুখ দার্শনিকরা জার্মান মাটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন। তারপরও জার্মান রাজনীতিকরা তাদের দর্শনের ব্যাখ্যা নিজেদের মতো করে নিয়েছিলেন। ফলে তাদের স্বার্থকতা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মত দেশগুলোর অনেকে এখনো চোরাবালিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি তাদের সম্মেলন শেষ করে ২০২১ সালে। তারা সেই পুরনো ধাঁচের কথাই মানুষকে শোনান। উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো কথা তারা সামনে নিয়ে আসেননি।
দেশে কয়েকটি ছোট ছোট প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া রাজনৈতিক দল আছে যারা নিজেদেরকে কম্যুনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী বলে প্রকাশ করে, তাদের আহ্বান বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে আর কোন প্রভাব ফেলে না। আমাদের যৌবনের প্রারম্ভে আমরা যখন তরুণ তখন আমরাও এই সাম্যবাদী আন্দোলন বা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে অংশ নিয়েছিলাম। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এক শতাংশও এই আবেগ দ্বারা তাড়িত নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের মধ্যে এক নতুন বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল। সেই বিভাজনের সময় তারা একটা বাক্যের যোগান দিয়েছিল তরুণ সমাজের কাছে এবং তা ছিল- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের এই ধারণা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়নি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কথাটি এক ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ব্যাপকভাবে সংকটের মুখে ফেলেছিল জাসদের তরুণ প্রজন্ম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বিশ্বাসীরা। কিছু ছোট ছোট সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব তখনও ছিল। তারাও স্বাধীনতা-উত্তর একটি বিধ্বস্ত দেশে সামাজিক ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। যদিও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও এক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল- সামাজিকভাবে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখতে না পারা।
বাংলাদেশের জন্মের পরে যখন সামাজিক ঐক্য করার প্রয়োজনীয়তা তীব্র ছিল তখন এই মার্কসীয় অনুসারীরা দেশকে আরো বেশি বিভক্ত করেছিল ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা নানানভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন এবং দেশ চূড়ান্তভাবে বিভাজিত হয়, ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে।