তারা লঞ্চ স্পটারস, তারা নদীবন্দর ও লঞ্চের ইতিহাস বলে
পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ অবধি পটুয়াখালী, কালাইয়া, গলাচিপা, ভোলা বা বরিশাল রুটে যাত্রী পারাপারের প্রধান মাধ্যম ছিল গয়না নৌকা। এগুলো হতো কাঠের তৈরি, দৈর্ঘ্যে ৫০ ফুট আর প্রস্থে ১০ ফুটের মতো। যাত্রী ধরত ৪০-৫০ জন। খুব সকাল বলতে সূর্য ওঠার আগেই গয়নার মাল্লারা হাঁকডাক শুরু করত গয়না আইছে, গয়না আইছে বলে। জঙ্গল আর ঝোপঝাড় ছিল পথের দু'ধারে। শেয়াল আর সাপখোপের ভয়ে যাত্রীরা ঘাটে রওনা দিত দলবেঁধে। লঞ্চ স্পটারস বাংলাদেশের অ্যাডমিন সাকিব সাদির সঙ্গে আলাপের আগে এসব ভাবনাতেও ছিল না। যেমন জানা ছিল না বরিশালের নামকরণের কারণ। একদা বড় বড় শাল গাছ থাকায় হতে পারে এ নামকরণ আবার লবণের দানা থেকেও এসে থাকতে পারে। কারণ এখানে যে লবণের দানা পাওয়া যেত, তা ছিল বড় বড়, সেগুলোকে বলা হতো বঢ়িসল্ট, এই বঢ়িসল্ট দিনে দিনে বরিশালে রূপান্তরিত হয়েছে। সাকিব আরো কিছু সূত্র বা লিংক পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে ইতিহাসের এমন অনেক উপাদান আছে যেগুলোর ওপর আলো পড়েছে কম। সেসব কথার পুনরাবৃত্তি অনেক পাঠকের কাছেই নতুন শোনাবে বলে ভরসা।
সাত্তার খানের কথাই আসে আগে
১৯৪৫ সালে প্রভিনশিয়াল ক্যারিং কন্ট্রাকটরের দুটি কার্গো যাদের নাম ছিল আল বখতিয়ার ও আল নূর, বাংলার নদীবন্দরগুলোয় এরা খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিত। ৭৮ বছর আগে যে মানুষটি প্রত্যন্ত জনপদে মালপত্র পৌঁছানোর কথা ভেবেছিলেন তাঁর নাম আব্দুস সাত্তার খান। তিনিই পরে প্রতিষ্ঠা করেন মেসার্স ফারুক শিপিং নেভিগেশন।
তার বড় ছেলে ফারুক ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। ফারুকের স্মৃতি ধরে রাখতেই প্রতিষ্ঠানের ওই নাম রেখেছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে প্রথম মিন্টু খান ও ফারুক ইসলাম নামে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চ নামান সাত্তার খান। দেড়তলা উচ্চতার লঞ্চগুলোর বডি ছিল কাঠের। চলত ঢাকা-ভোলা-ঢাকা রুটে। এর পাঁচ বছর পর ১৯৬৭ সালে ফারুক নেভিগেশন পটুয়াখালি রুটে নামাল দুটি লঞ্চ যেগুলোর নাম ছিল বিউটি অব বিক্রমপুর ও মাসুদ খান। একই বছর আবার চমকে দিল প্রতিষ্ঠানটি ভোলা রুটে সিদ্দিক খান নামের একটি স্টিলবডি লঞ্চ নামিয়ে। পটুয়াখালি রুটেও প্রথম স্টিলবডি লঞ্চ ভাসানোর কৃতিত্ব তাদেরকেই দিতে হয়, লঞ্চটির নাম ছিল মামুন খান। বরিশাল রুটে 'ডাইরেক্ট সার্ভিস'ও প্রথম চালু করে ফারুক নেভিগেশন, স্টিলবডির শাকিল খান লঞ্চটি দিয়ে। মাসুদ খান, নাজমা খান, রিতা, ফেরদৌস খান, সাজেদা খান, রাহাত খান নামের লঞ্চও ভাসিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি, মূলত বরিশাল রুটে সার্ভিস দিয়েছে এগুলো। তবে পরের দিকে ফেরদৌস খান হুলারহাট রুটের প্রথম স্টিলবডির লঞ্চ হয় আর ঝালকাঠি রুটের সূচনা ঘটে নাজমা খানের মারফত। নাজমা খান দীর্ঘদিন সার্ভিসে ছিল, চলাচল করেছে ছোট-বড় অনেক রুটে। ১৯৯১ সালে সাত্তার খান মারা যান, প্রতিষ্ঠানের নামে তখন কিছু পরিবর্তন এনে রাখা হয় মেসার্স ফারুক শিপিং লাইনস। ৯৩-৯৪ সালে তারা যে নতুন লঞ্চটি ভাসিয়েছিল সেটি যুগান্তর এনেছিল। লঞ্চটি তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় লঞ্চ, এর বাইরের ও ভিতরের সজ্জা ছিল আগের যে কোনো লঞ্চের তুলনায় ভিন্ন, এর সম্মুখভাগ তৈরি করা হয়েছিল সমুদ্রগামী জাহাজের আদলে আর এর পুরো বডি ছিল সাদা। এটির নাম সাত্তার খান ১। পরিপূর্ণ একটি তিন তলা লঞ্চ ছিল সেটি। অল্পদিনেই লঞ্চটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়।
তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০০৭ সালে এমভি কামাল খান নামে চারতলা একটি লঞ্চ নামিয়ে আলোড়ন তোলে ফারুক শিপিং। পরে অবশ্য বিভিন্ন জটিলতায় কামাল খানের চার তলার বেশ কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। এরপর থেকে ফারুক শিপিং বলতে গেলে ব্যবসা গোটাতে শুরু করে। তবে তার আগেই ইতিহাসের খাতায় তার নাম লেখা হয়ে গেছে। আসলে বরিশাল, ভোলা পটুয়াখালী, গলাচিপা, বরগুনা, হুলারহাট, লালমোহন, ঝালকাঠি, কালাইয়া ও পাতার হাটে প্রথম স্টিল বডির লঞ্চ আনে ফারুক শিপিং। বৃদ্ধরা তো বটেই, জোয়ানদের অনেকের মনে পড়বে এর কথা।
ঢাকা-পটুয়াখালী রুট
পটুয়াখালি রুটের ইতিহাসে নব্বইয়ের দশকটা বেশ জমকালো। এই সময় অনেকগুলো নতুন লঞ্চ জলে ভাসানো হয়। যেমন দীপরাজ, কামাল, নিজাম, কদম রসূল ইত্যাদি। রুটটি জমে ওঠে দীপরাজ-৩ এর কল্যাণে। তবে সাগর-৪ কে বলা যায় এই রুটের স্ট্রাইকার। পটুয়াখালিতে সাগর ৫, ৬, ৭ আর ১০ও ভালো সার্ভিস দিয়েছে।
২০০১ সালে সাগর সিরিজের আরো লঞ্চ সৈকত নাম দিয়ে এ রুটে চলতে থাকে। সৈকত ১৪ এর প্রোপালশন সিস্টেমে ছিল তিনটি ইঞ্জিন। পটুয়াখালি রুটে নতুন আকর্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রায় এক যুগ। ডলার ট্রেডিং করপোরেশন নিয়ে আসে কুয়াকাটা ১। এর সার্ভিস ছিল অনবদ্য। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছিল অনন্য। তখন ৭৫০ অশ্বশক্তির ইঞ্জিনের অস্তিত্ব ছিল না, পুরো ইন্ডাস্ট্রিতেই যা ছিল কুয়াকাটা-১ এ। এরপর আসে সুন্দরবন নেভিগেশনের লঞ্চ। কুয়াকাটার সঙ্গে পাল্লা দিতে সুন্দরবন নিয়ে আসে চার তলা সুন্দরবন ৯। ২০১৪ সালে রুটটি আরেকটি দারুণ লঞ্চ পায় যার নাম এমভি কাজল ৭। ডিজাইন, সার্ভিস, গতিময়তায় এটি জনপ্রিয়তার ওপরের দিকে চলে যায় অল্প সময়ে। পরের বছর জামাল সাতও নজর কাড়ে এর ডিজাইন, সাজসজ্জা ও গতির কারণে। ২০১৬ সালে একই দিনে দুটি লঞ্চ নামে এই রুটে- প্রিন্স আওলাদ ৭ ও এ আর খান ১। বলা হয়ে থাকে, এদের আগমনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায় ঢাকা-পটুয়াখালি রুট।
ঐতিহ্যবাহী রুট লালমোহন
দ্বীপজেলা ভোলার একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নৌরুট হলো ঢাকা-নাজিরপুর-লালমোহন। ষাটের দশকে চলত গ্লোরি অব মেহেন্দিগঞ্জ, পাতারহাট ইত্যাদি। এগুলোর বডি ছিল কাঠের। লঞ্চগুলো ঢাকা থেকে ছাড়ত দুপুর ৩টায় আর লালমোহন পৌঁছাত পরদিন সন্ধ্যা ৬টায়। সবমিলিয়ে লেগে যেত ১৫ ঘণ্টা। আশির দশকের শেষভাগে এ রুটে যুক্ত হয় এমভি হেনা, সাজেদা, রাজলক্ষ্মী ও রাহাত খান। এর মধ্যে হেনা ছিল দেড় তলা আর রাহাত খান দুই তলা। রাজলক্ষ্মীই প্রথম ভোলা রুটের স্টিলবডির লঞ্চ তবে এর দোতলা কাঠেরই ছিল। নব্বই দশকের শুরুতে লালমোহন রুটে কোকো অপারেটরকে বলা যায় গেমচেঞ্জার। কোকো-৫ এবং কোকো-৬ ডাইরেক্ট সার্ভিস দিয়ে জমিয়ে দেয় রুটটিকে। অবশ্য কোকোর কারণেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অন্য লঞ্চগুলোর। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে কোকো-৬ ও কোকো-৪ লঞ্চডুবির পর। নতুন করে সার্ভিসে আসে পাতারহাট -৪ যা পরে অথৈ-২ নামে রাঙ্গাবালিতে সার্ভিস দিয়ে এখন জামাল-৪ নামে চলছে। তবে হঠাৎই নাব্যতা সংকট রুটটিকে অচল করে দেয়। এরপর কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর। নতুন করে গ্লোরি অব শ্রীনগর-৩ ও কর্ণফুলি ৩ এর হাত ধরে রুটটি আবার জেগে ওঠে।
সাকিব সাদির বাড়ি বরিশালের ভান্ডারিয়ায়। চলাচলের পথ ছিল মেহেন্দীগঞ্জ দিয়ে। যখন সে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র তখন প্রথমবারের মতো লঞ্চে করে ঢাকায় আসে। সেটা ২০০২ সাল। লঞ্চ ছাড়ার পর থেকেই সাকিব রেলিং ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল নদীতে কিশোরের দুরন্তপনা, পাড় থেকে দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত অবারিত সবুজের বিস্তৃতি। সাকিব চোখ ফেরাতে পারছিল না। সাকিবের বিস্ময় ছিল, লোহার জিনিস কীভাবে পানিতে ভাসে। তাই এমন একটি অবাক করা যানের প্রতি সাকিবের ভালোবাসা তৈরি হতে সময় বেশি লাগেনি।
লঞ্চ স্পটারস বাংলাদেশ
ফেসবুকের এই গ্রুপটিতে এখন ফলোয়ারের সংখ্যা ৭৯ হাজার। ২০১২ বা ১৩ সালে এটি প্রথম পেইজ হিসাবে চালু হয়। আলিম শিকদার, ফায়জুল হক মানু ছিলেন পেইজের এডমিন। ভোলায় তাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। লঞ্চের ভেঁপুর শব্দে তাদের প্রাণে চঞ্চলতা তৈরি হতো। একসময় প্লেন স্পটারস গ্রুপটি তাদের নজরে আসে। সেখানে সুন্দর সুন্দর ছবি ও মজাদার সব তথ্য দেখে লঞ্চ নিয়েও একটি পেইজ করার ইচ্ছে তাদের জাগে। সেই থেকে যাত্রা শুরু হয় লঞ্চ স্পটারস বাংলাদেশের।
সাকিব বলছিলেন, মানু ভাই এখন আমেরিকায় থাকেন। অন্যরাও ব্যস্ত সংসার নিয়ে। তাই প্রথম দিকে যারা ছিলেন তারা সেভাবে আর সময় দিতে পারছেন না। সাকিব সক্রিয় হয় ২০১৭ সাল থেকে। ততদিনে পেইজটি গ্রুপে রুপ নিয়েছে কারণ পেইজে ইন্টারেকশনের (পারস্পরিক বিনিময়ের) সুযোগ কম। এখন গ্রুপের এডমিন ২ জন আর মডারেটর ৪ জন। এদের সবাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নন। লঞ্চ ভ্রমণ ভালোবাসে বা শ্বশুরবাড়ি ভোলায় এমনও আছেন কেউ কেউ। একজন আছেন নাফিয়া হাসান রিতি যার বাসা সদরঘাটের কাছে, বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই লঞ্চের ছবি তোলেন, তিনিও গ্রুপের মডারেটর। গ্রুপ হওয়ার কারণে মেম্বাররা হয়ে গেছেন মূল কন্ট্রিবিউটর। তারা তথ্য বিনিময় করেও পরস্পরকে সহযোগিতা করেন যেমন কোন লঞ্চের শিডিউল বদলেছে, কোন লঞ্চ রিবডি (নতুন সাজ) হয়ে আবার জলে নামছে, কোন লঞ্চের রুট পরিবর্তন হয়েছে ইত্যাদি। মেম্বারদের মধ্যে কমই আছেন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। তারা মোবাইল দিয়েই বেশি ছবি তোলেন।'
সাকিব একজন চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্ট। পেশাগত ব্যস্ততা তার অনেক। এর মধ্যেই ছবি তুলতে যান মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর বা ইলিশায়। বেশিরভাগ লঞ্চ চলে রাতের বেলায়। তাই লঞ্চের ছবি তোলার সুযোগ বেশি আসে ঈদের মৌসুমে। তখন দিনের বেলায়ও অনেক লঞ্চ গন্তব্যে রওনা হয়। মুন্সিগঞ্জ বা চাঁদপুর ঘাটে দাঁড়ালে লঞ্চ পাওয়া যায় বেশি। তিনি ছবি তুলতে ভালোবাসেন লঞ্চ চলমান থাকা অবস্থায়। আর যদি সামনে কোনো অবজেক্ট (নৌকা যেমন) পেয়ে যান তবে খুশি হন তাতে একই ছবিতে একাধিক চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটে।
সবদিন ভালো ছবি পান না তবে লঞ্চ ভ্রমণে সাকিব কখনো ক্লান্ত হন না। ২০১৯ সালের এক জ্যোৎস্না রাতের কথা তিনি বুঝি কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না। নদী সে রাতে রূপালি ছিল, চাঁদের আলোয় ভেসে গিয়েছিল পথ-প্রান্তর। তিনি ওপরের ডেকে শুয়ে বা আধশোয়া হয়ে, কখনো বসে বা দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রকৃতির সে অতিপ্রাকৃত রূপ দেখেছিলেন।
লঞ্চের খাবারও সাকিবের বেশ পছন্দ। ডাল চচ্চরির কথাই বললেন প্রথমে। এটি লঞ্চের একটি সিগনেচার ফুড। লঞ্চের ঝালমুড়ি খেতেও ভালো লাগে। নারকেল-চিড়ার কথাও মনে পড়বে অনেকের। সাকিবের পছন্দের লঞ্চ তরঙ্গ-৭, চারতলার চেয়ে তিনতলা লঞ্চই তার বেশি ভালো লাগে। সুরভি-৯ তার ভালো লাগে ফ্রন্ট লুকের জন্য।
সাকিব বললেন, 'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চের বাহ্যিক যেমন, অভ্যন্তরীণ চেহারাও বদলেছে। এখনকার লঞ্চগুলো ৩০০ থেকে ৩০৫ ফুট দীর্ঘও হয়। প্রস্থে হয় ৫০ ফুটের বেশি। যেমন পারাবত ১২। এখনকার লঞ্চগুলোর ফ্লোর হাইটও অনেক বেশি। এছাড়া আলোকসজ্জা বেড়েছে। আগে ছিল স্টিয়ারিং যেটা ঘুরিয়ে মাস্টার ডান বা বামে নিতেন। লঞ্চে এখন এসেছে হাইড্রলিক সিস্টেম যার তুলনা চলে অটো কারের সঙ্গে। আরো যুক্ত হয়েছে ফগ লাইট, জিপিএস। গতি বেড়েছে প্রায় সব লঞ্চের। ঈগল-৩ নামের একটি লঞ্চের কথা বলা যায় যেটি চলে প্রায় ১৪০০ অশ্বশক্তিতে। লঞ্চগুলোয় ইঞ্জিন থাকে ২টি। সরাসরি চীন থেকেও আসে এগুলো পুরো আনকোরা আবার চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে জেনারেটর মডিফাই করেও তৈরি হয়। জাপান থেকে ডাইহাটসু ইঞ্জিনও আনে কোনো কোনো পরিবহন যেমন বিআইডব্লিউটিসির বাঙালি ও মধুমতি স্টিমারগুলো চলে ডাইহাটসু ইঞ্জিন দিয়ে।'
পদ্মা সেতু হওয়ার পর এখন ভোলা রুটটিই সবচেয়ে জমজমাট। গ্রিনলাইনও এ রুটে চলাচল করছে। গ্রিনলাইনের লঞ্চগুলোর গতি বেশি আর গঠনশৈলীও আলাদা। এগুলোকে বলে ক্যাটামেরন। গ্রিনলাইনের মালিক আলাউদ্দিন সাহেব প্রথম ইলিশা রুট চালু করেন। ভোলা সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন ইলিশা। ইলিশা রুটের কালীগঞ্জে এখন বলতে গেলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লঞ্চ ভিড়ে।
সাকিব বলছিলেন উপকূলীয় অঞ্চলে চলাচলকারী লঞ্চের কথাও। মনপুরা, হাতিয়া, রাঙ্গাবালি ইত্যাদি জায়গা সাগরের অনেকটা কাছে। বড় বড় ঢেউ পার হয়ে পৌঁছাতে হয় জায়গাগুলোয়। চলাচলকারী লঞ্চগুলোর তাই তলদেশ পুরু হতে হয়, শক্ত হতে হয়। এগুলোর হ্যাচকভার আবদ্ধ থাকে আর ইঞ্জিন রুম থাকে এয়ার টাইট। লঞ্চপ্রেমী সাকিবকে ভারাক্রান্ত শোনাল নদীর প্রতি মানুষের ভালোবাসাহীনতার কথা বলার সময়। তিনি জানালেন, নাব্যতা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক লঞ্চঘাট যেগুলো আগে ছিল প্রাণচঞ্চল সেগুলোয় আর মানুষ ভিড় করে না। নাব্যতা সংকট দূর করতে আশু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ ইতিমধ্যেই অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। যেমন ঢাকা-কালাইয়া রুটে ১৪টি ঘাট সচল ছিল, এখন আছে মোটে ৫টি।
কচুয়া ছিল চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী
চারশো বছর আগের কথা। তখন দক্ষিণাঞ্চলের বাহারি নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। বাউফলের কচুয়া ছিল এর রাজধানী। তখন বৃটিশ, পর্তুগীজ, ডাচ বণিকেরা জাহাজ নোঙর করত ওই কচুয়ায়। বাণিজ্যের পাশাপাশি সুপেয় জল সংগ্রহও ছিল তাদের উদ্দেশ্য। রাজধানীর নিরাপত্তার কথা ভেবেই চন্দ্রদ্বীপের রাজা কালাই রাজ্যের দক্ষিণে বহমান খালের পাড়ে তৈরি করলেন ঘাট আর নির্দেশ দিলেন এখানেই নোঙর ফেলতে হবে। রাজার নামে ঘাটটির নাম হলো কালাইয়া ঘাট যা পরে হয় বন্দর। সে থেকে আজ অবধি এখানে চাল, ডাল, গরু, মহিষের কেনাবেচা চলে। দূর দূর থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসেন কালাইয়া বন্দরে। বর্তমানে নুরাইনপুর হয়ে ঢাকা থেকে কালাইয়া অবধি নৌযান চলাচল করে। সত্তরের দশকে হাজী ও চৌধুরী কোম্পানীর একতলা লঞ্চ চলত বরিশাল-কালাইয়া রুটে। প্রায় ৮ ঘণ্টা লেগে যেত পথটুকু পাড়ি দিতে। সত্তরের দশকের শেষে এমভি পাতারহাট লঞ্চটি সরাসরি ঢাকা-কালাইয়া রুটে সার্ভিস দিতে থাকে। আসে ফারুক নেভিগেশনের সিদ্দিক খান, শাকিল খান ও ফেরদৌস খান। নব্বইয়ের দশকে আসে পারাবত-১। নুরাইনপুর হয়ে চলাচল পারাবতই চালু করে। মাঝে আরো কিছু লঞ্চ যাওয়া আসা করে এই রুটে। তবে ২০১৫ সালে সুন্দরবন-৬ রুটটিকে ঝলমলে করে তোলে। তবে বেশিদিন চলেনি লঞ্চটি। তারপর ওয়ালিদ-৬ ও স্বর্ণদ্বীপ প্লাস রাজত্ব করে কিছুকাল। এরপর আসে ঈগল-৪ যেটি ছিল রুটের সবচেয়ে বড় ও বিলাসবহুল লঞ্চ। ধুলিয়া-১ নামের লঞ্চটিও আলোড়ন তুলেছিল একসময়। এর ইন্টেরিয়র ছিল জমকালো, আলোকসজ্জা ছিল বর্ণিল। ২০১৬ সালে এ পথে আসে কম্প্যাক্ট বডি ও দুর্দান্ত গতির এমভি বন্ধন-৫। ঢাকা-নুরাইনপুর-কালাইয়া রুটে ঘাটের সংখ্যা ১৪টি। এগুলো হলো ঢাকা, ফতুল্লা, কাঠপট্টি, চাঁদপুর, ধুলিয়া, কালীশুরী, কেশবপুর, গাজীমাঝি, নারায়ণপুর, তাতেরকাঠি, তালতলী, নিমদী, কচুয়া এবং কালাইয়া। তবে নাব্যতা সংকটসহ আরো কিছু কারণে ফতুল্লা, চাঁদপুর বাদে ভিড়ে কেবল ধুলিয়া, কচুয়া আর কালাইয়ায়।
আরো অনেকগুলো রুটের কথা বলা বাকি রয়ে গেল, সেসঙ্গে লঞ্চের কথাও। কেবল বরিশালের অভ্যন্তরেই ৪০টি রুট ছিল। এখনো কিছু রুট সচল আছে। তবে একটা কথা সাকিব মনে করিয়ে দিলেন বারবার, নদীর যত্ন নিতে হবে কারণ নদী মরলে বন্দর বাঁচে না।
তথ্য যোগানদাতা: মাইনুল হোসেন শামীম, হাসান কায়েস, আবুল হাসান মনসুর, রাজন মনসুর, কাজী বেলাল উদ্দিন, রাজিব হোসেন বিয়ন, মো: মানিক মিয়া প্রমুখ