ভারতে পথশিশুদের যে সংবাদপত্র ২০ বছরের মাইলফলক স্পর্শ করেছে...
ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণের একটি এলাকা গৌতম নগর। এখানকার একটি ভবনের বেজমেন্টে সেই অফিস। শীতলপাটির ওপর যেখানে অর্ধ-বৃত্তাকার হয়ে বসে সংবাদ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত একদল টিনএজার। 'বালকনামা' সংবাদপত্রের মাসিক সম্পাদকীয় বৈঠক এভাবেই হয়। খবর দ্য গার্ডিয়ান-এর।
আর পাঁচটা দৈনিকের থেকে আলাদা এই গণমাধ্যম; এটি পরিচালনা করছে পথেই যাদের রুজি ও বসবাস সেই পথশিশুরা।
আরও চমকপ্রদ বিষয় ৯০ জন প্রতিবেদকের অধিকাংশই নিরক্ষর এবং তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ফলে লিখে নয়, মৌখিকভাবেই প্রতিবেদন দেয় তারা। এ ধরনের রিপোর্টারকে হিন্দিতে 'বাতৌনি' বা মৌখিক প্রতিবেদক বলা হয়।
আট পাতার এই ট্যাবলয়েড পত্রিকার জন্য সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব তাদেরই কাঁধে। যখন যে মহল্লায় তারা থাকে, সেখানকার বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করে লেখক ও সম্পাদকদের কাছে পৌঁছে দেয়। এরপর তারা সংবাদের যথার্থতাসহ অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় যাচাই করেন।
বালকনামার সম্পাদক কিশোর রাঠোরের বয়স মাত্র ১৮ বছর। সম্পাদক জানান, যারা লিখতে পারে তারা হোয়াটসঅ্যাপে লিখে সংবাদ পাঠায়। অন্যরা অফিসে এসে মৌখিকভাবে বলে যায়, খসড়া লেখে অন্য কেউ।
১৫ বছরের আকাশ তেমনই একজন মৌখিক প্রতিবেদক। সে একটি প্রতিবেদন নিয়ে এসেছে, ড্রেন ও খানাখন্দ থেকে প্ল্যাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করা পথশিশুদের নিয়ে।
এবছর ২০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে সংবাদপত্রটি। দুই দশকের এই পথচলায় অনেক শিশুকিশোরের জীবন বদলাতে রেখেছে অনবদ্য অবদান।
কিশোর রাঠোর নিজেও তার উদাহরণ। বছর সাতেক আগেও পিতৃহীন রাঠোর ঘুমাত ফুটপাতে, বেচত সিগারেট। এভাবেই একদিন ঘটনাচক্রে তার দেখা হয় দাতব্য সংস্থা– চাইল্ডহুড এনহান্সমেন্ট থ্রু ট্রেইনিং অ্যান্ড অ্যাকশন (চেতনা)-র এক কর্মীর সাথে। তার মাধ্যমে এই সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত হয় রাঠোর।
আরেকটি কল্যাণমূলক সংস্থা – 'বাড়তে কদম' (এগিয়ো চলো)-র সাথে যৌথভাবে ২০০৩ সালে বালকনামা পত্রিকা চালু করে 'চেতনা'। উদ্দেশ্য ছিল, দিল্লির প্রায় ৮০ হাজার পথশিশুদের সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশন।
আমার জীবনে পুরোপুরি বদলেছে – রাস্তায় রাস্তায় মার খেয়ে ফেরা আমি শিক্ষার আলোয় সম্মানজনক এক জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছি।
কিশোর রাঠোর বলেন, 'পথশিশু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে লেখা ও সংবাদ প্রকাশের নির্মল আনন্দ আজ আমি পাচ্ছি, তারা আমার অন্তরের নিকটজন'।
দাতব্য সংস্থা 'চেতনা'-র বৃত্তিতে পড়াশোনার সুযোগ পান রাঠোর। আজকাল একটি ভাড়া বাড়িতে এক কক্ষ নিয়ে থাকার সামর্থ্যও হয়েছে। বালকনামায় আজ পর্যন্ত যে ৭ শতাধিক শিশু কাজ করেছে, তাদেরই একজন রাঠোর।
বালকনামা বিক্রি হয় মাত্র পাঁচ রুপিতে। ছাপা হয় হিন্দি ও ইংরেজিতে। পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। এর তহবিল আসে চেতনা-সহ বেসরকারি অনুদান ও বিজ্ঞাপন থেকে।
সামর্থ্যের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর অনেক সংবাদ প্রকাশ করেছে এই পত্রিকা। প্রতিবেদন করেছে পথশিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন, পুলিশি নির্যাতন, শিশুশ্রম ও অপুষ্টি নিয়ে। পথশিশুদের যাতে পরিচয়পত্র দেওয়া হয় সে জন্য প্রচারণা চালিয়েছে। রেললাইন থেকে দূর্ঘটনা বা আত্মহত্যায় মৃতদের দেহ সরাতে পথশিশুদের ব্যবহার করেছে পুলিশ – এই সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে চাঞ্চল্য ফেলেছিল বালকনামা। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এছাড়া, পথশিশুদের মাদকাসক্তি নিয়ে তাদের সংবাদে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
প্রায় সব ধরনের প্রতিবেদন করেছেন রাঠোর। এরমধ্যে অন্যতম একটি ছিল দিল্লির এক বস্তিতে শিশুদের মৃতদেহ পাওয়া নিয়ে।
তিনি বলেন, সব সংবাদই যে হৃদয়বিদারক ছিল তা নয়। 'যেমন বস্তিতে বাসকারী ১৬ বছরের এক কিশোরীর গল্পও ছিল, সহৃদয় এক প্রতিবেশী তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্যক্তি মহল্লার মালিকহীন কুকুরগুলোর দেখভালও করতেন'।
বালকনামার একজন সম্পাদক হওয়ার আগে মদ্যপ বাবার সাথে ফ্লাইওভারের নিচে থাকতেন জয়তী। তিনি বলেন, 'আমি আবর্জনা কুড়াতাম, হয়ে পড়েছিলাম মাদকাসক্ত। পথে বসবাসের অন্যান্য সমস্যাতেও জীবন বিষিয়ে উঠেছিল'।
জয়তীর বয়স এখন ২২, সম্পাদকের পদ ছেড়ে এখন 'চেতনা'র হয়ে শিক্ষকতা করেন। ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন মায়ের সাথে।
তিনি বলেন, 'আমার রিপোর্ট করা অন্যতম একটি সংবাদ ছিল এক ঠিকাদারকে নিয়ে। সে ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে বস্তিতে মাদক ও অ্যালকোহল বিক্রি করাতো। কিন্তু, প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিশুদের নিয়োগ করা বাদ দিতে বাধ্য হয় ওই ঠিকাদার'।
বালকনামার আরেকজন সম্পাদক ছিলেন শম্ভু কুমার। পথশিশু থাকা অবস্থায় সবজি বিক্রি করতেন। সম্পাদক পদ ছেড়ে ২৪ বছরের এই তরুণ এখন ইন্দিরা গান্ধী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
তিনি বলেন, 'আমার জীবনে পুরোপুরি বদলেছে – রাস্তায় রাস্তায় মার খেয়ে ফেরা আমি শিক্ষার আলোয় সম্মানজনক এক জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছি'।
'আমার দুই ছোট ভাইয়ের জন্যও এমন জীবন চেয়েছিলাম, তারাও আজ স্কুলে পড়ছে। একজন নবম অন্যজন দ্বাদশ শ্রেণিতে আছে। এর চেয়ে আর বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার'।