তাজা ফলের মিশ্রণে ঝটপট বানানো রোল আইসক্রিম খেতে চাইলে
স্টিলের বড় একটি প্যানে টুকরো টুকরো করে কেটে দেওয়া হচ্ছে স্ট্রবেরি, কলা ও আপেল। তারপর একে একে মেশানো হলো তরল দুধ ও একধরণের ক্রিম। সবকিছুকে একত্রে দুটি ছোট খুন্তি দিয়ে মেশানোর সময় দেখা গেল, সেগুলো প্যানের ওপর ঠাণ্ডায় জমে যেতে শুরু করেছে। ফলের টুকরোগুলো ভালভাবে মিশে যাওয়ার পর প্যানের ওপর থেকে সেগুলোকে রোল করে চিমনি দিয়ে তুলে আইসক্রিম কাপে রাখা হলো।
এবার পালা এটিকে আরও লোভনীয় ও আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে তোলার। তাই উপরে খানিকটা লিকুইড চকলেট আর জেমস চকলেট ছড়িয়ে দেওয়া হলো। মাঝে দিয়ে দেওয়া হলো একটি ওয়েফার রোল। এভাবেই ক্রেতাদের সামনে তাদের পছন্দ অনুযায়ী আইসক্রিম বানিয়ে হাতে তুলে দিলেন দোকানী স্বজন।
'কিনসম্যান রোল আইসক্রিম' নামটির নিচেই একটি বোর্ডে প্রায় ৩০ রকমের আইসক্রিমের নামসহ দাম লিখে রাখা হয়েছে। একটি ফ্লেভারের সাথে অন্যটি মিশিয়ে প্রায় ৭০ রকম ভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম পাওয়া যায় ছোট্ট এই দোকানটিতে। মিরপুরের মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের উল্টোদিকের একটি বিল্ডিং এর নীচতলায় অবস্থিত আইসক্রিমের এই দোকানটিতে প্রতিদিন অনেক লোকের সমাগম দেখা যায়। স্কুলের পাশে হওয়ায় বেশিরভাগ ক্রেতাই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। আশপাশের এলাকা ও ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকেও মানুষ রোল আইসক্রিম খেতে এখানে চলে আসেন। আইসক্রিম খেতে এতো লোকের ভিড় কেন! এমন প্রশ্ন অনেকের মাথায় ঘুরপাক খায় দোকানের সামনে মানুষজনের জটলা দেখে। কারণ হিসেবে জানা যায়, ঢাকায় সচরাচর আইসক্রিমের দোকান অহরহ চোখে পড়লেও রোল আইসক্রিমের দোকান তেমন একটা নেই। হরেক রকম ফল দিয়ে তৈরি করা রোল আইসক্রিম বানানোর প্রক্রিয়া দেখতে তাই উৎসুক লোকেরা এখানে ভিড় জমান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে মানুষ এখন ভিন্ন কিছু দেখলেই কৌতূহলী হয়ে ওঠে। খাবারদাবারের ব্যাপারে যারা আগ্রহী, এমন 'ফুড লাভার'দের কয়েকটি গ্রুপও রয়েছে। কেউ কেউ আবার সৌখিন ফুড লাভার। অর্থাৎ ভিন্ন স্বাদের ও নতুন কিছু চেখে দেখতে এদের আগ্রহ বেশি। গ্রুপগুলিতে কে কী খেলেন, কোথায় পাওয়া যায়-এমন সব তথ্য তারা শেয়ার করেন। সেখান থেকে অনেকে 'কিনসম্যান রোল আইসক্রিমের' কথা জানতে পেরে স্বাদ পরখ করতে মিরপুরে ছুটে আসেন। সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম বানানো দেখতে পেয়ে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় শিশুরা। মেয়ে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরায় ছোট্ট লায়লা কে নিয়ে তার বাবা এসেছেন। ছোটদের জন্য আইসক্রিম ক্ষতিকর, তবে রোল আইসক্রিম ফল দিয়ে বানানো হয়। এ কারণে লায়লার বাবা মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছেন বলে জানান।
কঠিন পরিস্থিতিতে ভিন্নরকম উদ্যোগ
'কিনসম্যান রোল আইসক্রিম' দোকানের স্বত্বাধিকারী মুবদিউর রহমান স্বজন। ম্যানেজমেন্ট থেকে বিবিএ পাশ করা এই তরুণ চাকরীর বাজারে না ঢুকে হেঁটেছেন ভিন্ন এক পথে। তার এমন ভিন্নধর্মী চিন্তার উদ্ভব হয় করোনার সময়। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হওয়া স্বজন করোনাকালে বেকার হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তার আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যায়। কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। চিন্তা করেন উদ্যোক্তা হলেও এমন কিছু করবেন, যা মোটামুটি সব বয়সের মানুষের প্রয়োজন হবে।
স্বজন বলেন, "করোনার সময় সবাইকে দূরত্ব বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাসায় গিয়ে পড়ানো তখন সম্ভব ছিল না। এই সময়টা কী করা যায় সে ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা মাথায় আসে। শিক্ষিত হয়েছি বলেই চাকরি করতে হবে এমন ধারণায় বিশ্বাসী নই আমি। কারণ আমার কাছে কোনো কাজই ছোট না। ছোট কোনো ব্যবসা করলেও সেটা যেন ভিন্নধর্মী ও মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে এমন চিন্তা করতে থাকি। তখন ভাবলাম আইসক্রিম এমন একটি খাবার যা ছোট থেকে বড় সব বয়সের মানুষ খায় এবং সব সিজনেই বিক্রি হয়। আমি দেখেছি শীতেও মানুষ আইসক্রিম খায়, সেটা হয়তো গরমের তুলনায় কম তবে বিক্রি কিছুটা হলেও হয়।"
"আইসক্রিম নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে দেখলাম বাইরের দেশে রোল আইসক্রিম বেশ জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশে এগুলো তেমন একটা পাওয়া যায় না। রোল আইসক্রিমের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ফল ব্যবহার করা হয়, তাই এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এবং বাচ্চারাও খেতে পারবে। অন্য আইসক্রিমের থেকে মিষ্টি কম হওয়ার কারণ হচ্ছে, এখানে আলাদা করে চিনি ব্যবহার করা হয় না। তাই বয়স্ক ও ডায়াবেটিস আছে এমন মানুষজনও চাইলে খেতে পারবেন।"
ব্যর্থতা থেকে নতুন কিছু তৈরি
রোল আইসক্রিম যে প্যানের ওপর বানানো হয়, সেটি বাক্সের মতো একটি মেশিনের ওপর বসানো থাকে। আমাদের দেশে এই মেশিনগুলো সচরাচর পাওয়া যায় না। ভালো মানের মেশিনের দাম লক্ষাধিক। স্বজন দেখলেন এককালীন টাকা দিয়ে মেশিন কেনা সম্ভব হলেও-ইলেক্ট্রনিক জিনিস কাজ করার সময় একাধিকবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, আমাদের দেশে এধরণের মেশিনের ব্যবহার নেই। তাই মেরামত করার মতো দক্ষ লোকও পাওয়া যায় না। সেখান থেকে তিনি নিজেই মেশিন বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মেশিন বানাতে যা যা প্রয়োজন সেগুলো জোগাড় করে একাধিক ভিডিও ও ওয়েবসাইট দেখে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
অভিজ্ঞতার কথা জানাতে স্বজন বলেন, "এতোবার ব্যর্থ হয়েছিলাম বলেই এখন মেশিন নষ্ট হওয়ার পর কোথায় কী সমস্যা হয়েছে সহজেই বুঝে যেতে পারি। মেশিন বানানোর আগেই দোকান ভাড়া নিয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম এতোটাও কঠিন কিছু হবে না। কিন্তু মেশিন বানাতে অনেকদিন লেগে যাওয়ায়-খালি পড়ে থাকা দোকানের ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছিল। মেশিন বানাতে গিয়ে কখনো ৭০ ভাগ সম্পন্ন হতো, পুনরায় চেষ্টার পর কখনো ৯০-এ যেয়ে আটকে যেতো। একবার ৯৮ ভাগ হওয়ার পরেও ঠিকঠাক মতো কাজ হচ্ছিল না। এভাবে বারবার চেষ্টা করতে থাকার পর একসময় আমি সফল হতে পেরেছি। এতোবার ব্যর্থ হয়েছিলাম, কখনো যে সফল হতে পারবো এটাও ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম হয়তো নতুন কিছু শিখতে পারবো কাজটা করতে গিয়ে আর এটাই হবে বড় প্রাপ্তি।"
"মেশিন বানানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাপ জানা প্রয়োজন। আমি ইঞ্জিনিয়ার না বা এই বিষয়ে কোন ধারণাও আগে থেকে ছিল না। তাই কাজটি করতে আমার সময় বেশি লেগেছে। প্রথমদিকে আমার নিজের বানানো মেশিন দিয়েই আইসক্রিম বানানো হতো। পরবর্তীতে আরও একটি মেশিন বাইরে থেকে কিনে আনা হয়েছে। এখনও বেশিরভাগ সময় আমার বানানো মেশিন দিয়েই কাজ করা হয়। কাজের চাপ বেশি থাকলে দু'টো মেশিন দিয়েই আইসক্রিম বানানো হয়।"
হরেক রকম ফ্লেভারে তৈরি মজাদার আইসক্রিম
কলা, কমলা, আপেল, তরমুজ- এমন পরিচিত ফলের পাশাপাশি স্বজনের দোকানে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, ব্লু বেরি, কিউই ফল দিয়ে তৈরি আইসক্রিমও পাওয়া যায়। একেকটি আইসক্রিম স্বাদে যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি দেখতেও কিছুটা ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। ফল ছাড়াও চকলেট, অরিও, টুটি ফুটি, ভ্যানিলা, বাটার স্কচ ফ্লেভারে আইসক্রিম পাওয়া যায়। দামের দিক দিয়ে রোল আইসক্রিমের দাম অন্যান্য আইসক্রিমের তুলনায় বেশি। বোর্ডে আইসক্রিমগুলোর নামের পাশেই দাম লিখে রাখা হয়েছে। যাতে ক্রেতারা নিজেদের পছন্দ ও দামের সাথে সাথে মিলিয়ে অর্ডার করতে পারেন। এক্ষেত্রে বারবার দাম বলার ঝক্কিও পোহাতে হবে না দোকানীকে।
'কিনসম্যান রোল আইসক্রিমের' দোকানে প্রতিটা রোল আইসক্রিমের দাম সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আইসক্রিমের পরিমাণ ও ফলের ওপর ভিত্তি করে দামের পরিবর্তন হয় বলে জানালেন দোকানী স্বজন। ড্রাগন, কিউই, স্ট্রবেরি, চকলেট, ব্লু বেরি, মিক্সড ফ্রুট ও কিনসম্যান স্পেশাল আইসক্রিমের দাম অন্যগুলোর থেকে বেশি। আইসক্রিমের দোকান হলেও এখানে অনেক ধরণের ডেজার্ট খাবার ও ফলের জুস পাওয়া যায়। কাপকেক, জারকেক, ডোনাট, পেস্ট্রি ও বিভিন্ন ফ্লেভারের ওয়াফেলসও দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়।
স্বজন জানান, "ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ফল একসাথে মিশিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে দেওয়া হয়। তাই যে কেউ চাইলেই নিজের পছন্দ অনুযায়ী আইসক্রিমের স্বাদ কাস্টমাইজ করে নিতে পারবেন। ক্রেতাদের সামনেই আইসক্রিম বানানো হয়, তাই এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তৃপ্তিটা বেশি কাজ করে। আমরা আইসক্রিম বানাতে যে ঘন দুধ ও হুইপড ক্রিম ব্যবহার করি, এগুলোর প্রতিটি হোমমেড। অর্থাৎ আমি নিজেই এগুলো স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বানিয়ে থাকি। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু আইসক্রিম বিক্রি নয়, মানুষ যে টাকাটা দিয়ে কিনছেন সেটার বিনিময়ে তাদেরকে ভালো কিছু খাওয়ানো।"
রোল আইসক্রিমের দাম বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ তাদের বাবা-মার সাথে আসেন। ফলের দাম বেশি তাই আইসক্রিমের দাম কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান স্বজন। প্রতিদিন তার ৪০-৫০টি আইসক্রিম বিক্রি হয়। সংখ্যাটা কোনো কোনো দিন এরচেয়ে কম বা বেশি হয়। তবুও তিনি নিয়ম মেনে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত দোকান খুলে রাখেন। তবে তরুণ এই উদ্যোক্তার ইচ্ছে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আইসক্রিম পার্লার করার। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে শুরু থেকেই তাকে নানা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পরিবার থেকে আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় তার এই পথচলা আরও সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে। ব্যবসাটি বড় করে শুরু করার স্বপ্ন তারমধ্যে থাকলেও স্থায়ী কোনো সম্পদ না থাকায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিকবার চেষ্টা করেও লোন পাননি কোনো। তাই তিনি নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়েই ধীরে ধীরে এই আইসক্রিমের ব্যবসাকে বড় করার স্বপ্ন দেখছেন। বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠানে স্বজন তার কিনসম্যানের ছোট্ট স্টল নিয়ে হাজির হয়ে যান- রোল আইসক্রিমের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে।