যে চার বাধার মুখে বৈদ্যুতিক গাড়ি
দিন দিন বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশেও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ গাড়ি বিদ্যুতে চালানোর লক্ষ্য নিয়েছে। আর ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তাঘাটে তো এখন ইভি চলতে দেখা যায় নিয়মিতই। এসবের জেরে বিক্রিও বেড়েছে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন ও পরিবেশ দূষণ রোধে ইভি ব্যবহারে উৎসাহিত করছে সব দেশের সরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ মিলিয়ন ইভি রাস্তায় নামাতে চায়। ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যথাক্রমে ৫০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ গাড়ি বিদুতে চালানোর লক্ষ্য নিয়েছে।
কিন্তু এরকম গণহারে ইভি রাস্তায় নামানোর পথে বেশ কিছু বড় বাধা আছে। একদিকে বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম যেমন এখনও সবার হাতের নাগালে আসেনি, অন্যদিকে এসব গাড়ি চার্জ করার অবকাঠামোও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। স্প্যানিশ সংবাদ এল পাইস-এর প্রতিবেদনে বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রধান তিন বাধার কথা উঠে এসেছে।
গ্রাফাইট
বৈদ্যুতিক গাড়ির লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির নেগেটিভ পোলটি গ্রাফাইট দিয়ে তৈরি। গ্রাফাইট হলো প্রকৃতিতে পাওয়া কার্বনের একটি রূপ। ইভির লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে শুধু গ্রাফাইটই ব্যবহার করা হয়।
স্প্যানিশ গবেষক বেলেন সতিলো বলেন, কার্বন বিরল মৃত্তিকা ধাতু নয়। ভূত্বকে প্রচুর কার্বন আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্যাটারিতে ব্যবহারের জন্য গ্রাফাইটকে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। আর বেশিরভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাই চীনে। এ কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিথিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল ও ম্যাঙ্গানিজের সঙ্গে গ্রাফাইটকেও বিরল মৃত্তিকা ধাতুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। উল্লেখ্য লিথিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজও ইভি ব্যাটারির উপাদান।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সবচেয়ে ভারী উপাদানও গ্রাফাইট। কনসালটেন্সি ফার্ম কেয়ারনি-র তথ্য অনুসারে, এর ওজন ১০০ থেকে ২০০ পাউন্ড হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতি ১০ মিলিয়ন বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য ৫ লাখ থেকে ১ মিলিয়ন টন গ্রাফাইট প্রয়োজন। আর বর্তমানে সারা বিশ্বে মাত্র ১ মিলিয়ন টন গ্রাফাইট প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা আছে।
সতিলো জানান, গ্রাফাইটের উৎপাদন বাড়ানোর উপায় খোঁজা হচ্ছে। তবে এ কাজে সাফল্য পাওয়া খুব কঠিন। আরেকটি উপায় হলো গ্রাফাইটের বিকল্প কিছু ব্যবহার করা—তা-ও সহজ নয়। সতিলো বলেন, নতুন বিকল্প বের করার পর সেটি যদি ভালো কাজ করে, আহলে গোটা শিল্প শূন্য থেকে গড়ে তুলতে হবে। আর এ কাজ অত্যন্ত কঠিন। কারণ তখন গোটা ইভি শিল্পকে নতুন উপাদান দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে।
লিথিয়াম
বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি লিথিয়াম দিয়ে তৈরি। কিন্তু এটি খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়। সতিলো বলেন, 'লিথিয়াম এমন একটি উপাদান যা ভূত্বকে খুব বেশি পরিমাণে নেই। তাই বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করতে যে পরিমাণ উপাদান পাওয়া যেতে পারে, তা সীমিত।'
যুক্তরাজ্যের জিওসায়েন্টিস্ট হান্না রিচির হিসাবে, পৃথিবীতে আনুমানিক ৯৯ মিলিয়ন টন লিথিয়াম আছে। তবে এর মধ্যে মাত্র ২২ মিলিয়ন টন লিথিয়াম নিষ্কাশনযোগ্য। রিচির হিসাব অনুসারে, এই মজুত দিয়ে, ২.৮ বিলিয়ন বৈদ্যুতিক ব্যাটারি তৈরি করা যাবে। পৃথিবীতে মোট কতগুলো ইভি আছে, তা জানা কঠিন। তবে কিছু হিসাব অনুসারে, পৃথিবীতে আনুমানিক প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ইভি রয়েছে। অর্থাৎ খুব বেশি ইভির ব্যাটারি আর বানানো যাবে না। এছাড়া লিথিয়াম অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা হয়—অর্থাৎ মজুত লিথিয়াম শুধু ইভির জন্যই ব্যবহার করা হবে না।
সতিলো বলেন, 'লিথিয়ামের আরেকটি সমস্যা হলো এটি এমন উপাদান যার প্রতিক্রিয়াশীল (রিঅ্যাক্টিভ) হওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। হতে থাকে। একবার ব্যাটারি ব্যবহার করে ফেললে, এটি পুনরুদ্ধার করা খুব কঠিন.
লিথিয়ামের বিকল্প খুঁজে বের করার বিষয়েও গবেষণা চলছে জানিয়ে সতিলো বলেন, লিথিয়ামের অনুরূপ সোডিয়াম বা পটাশিয়াম ব্যাটারি প্রযুক্তিতে শক্তি মজুত রাখার সক্ষমতা হবে কম—তবে সেগুলো সহজেই পুনরুদ্ধার করা যাবে এবং প্রকৃতিতে বিস্তর পাওয়া যায়।
ব্যাটারি রিসাইক্লিং
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে—একটি ইভি ব্যাটারিই গাড়ির পুরো চ্যাসিস দখল করে নেয়। আর এই ব্যাটারি টেকে মাত্র ১০ বছর। এই ব্যাটারি বদলানোর সময় এলেই শুরু হয় রিসাইক্লিংয়ের যাত্রা। আর রিসাইক্লিং কারখানায় ব্যাটারি ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয় খালি হাতে। ব্যাটারি বিচ্ছিন্ন করার কোনো স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
ব্যাটারির ভেতরে থাকে একাধিক আন্তঃসংযুক্ত মডিউল, বিভিন্ন সেল এবং আরও ছোট ছোট ব্যাটারি। ওই ছোট ছোট ব্যাটারিগুলোকে ভেঙে চূর্ণ করা হয়। তারপর মূলত প্লাস্টিক ও তামা আলাদা করার জন্য পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া চালানো হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া নিখুঁত নয়। আর প্রক্রিয়াজাতকরণের পর পাওয়া যায় 'ব্ল্যাক ম্যাস'। এতে কালো গ্রাফাইটের আধিক্য থাকে; তবে সঙ্গে নিকেল, কোবাল্ট ও ম্যাঙ্গানিজ (ক্যাথোড থেকে), লিথিয়াম, ফসফরাস, ফ্লুরিনও (ব্যাটারির ইলেক্ট্রোলাইটে) থাকে।
এসব উপাদান পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়। এছাড়া অটোমেশন না থাকায় প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বর্তমানে পুরো 'ব্ল্যাক ম্যাস' রিসাইক্লিং করার জন্য জন্য চীনে পাঠানো হয়।
আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে ইউরোপে এমন রিসাইক্লিং কোম্পানি গড়ে উঠতে পারে। সেখান থেকে এই রিসাইক্লিংকে শিল্পের রূপ দিতে হবে। কিন্তু এতেও বেশ সময় লাগবে।
শক্তি সরবরাহ
ব্যাপক হাতে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার শুরু হলে বিদ্যুৎ গ্রিডে বিদ্যুতের চাহিদাও অনেক বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে দুটো বিদ্যুৎ ও শক্তির সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা হবে না। যেমন স্পেনের মতো কিছু দেশে বিদ্যুতের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনে কোনো অসুবিধা হবে না। কেননা এসব দেশের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। যেমন স্পেনেই চাহিদা কমে যায় বলে রাতের বেলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোতে তাদের ব্যবহৃত শক্তির চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদনের অবকাঠামো রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এক্ষেত্রে বেশ অসুবিধায় পড়তে পারে।
তবে বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্কের সক্ষমতা নিয়ে উন্নত-উন্নয়নশীল সব দেশকেই চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। সাধারণত দুপুর বা বিকেলের দিকে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি থাকে। এখন সবাই যদি ওই সময় তাদের গাড়ি চার্জ দেয়, তাহলে বড় সমস্যা হবে। বিদ্যুৎ পরিবহন ও বিতরণ উভয় নেটওয়ার্কেই বড় সমস্যা দেখা দেবে তখন। এই সমস্যা এড়াতে রাতের বেলায় গাড়ি চার্জ করার পরামর্শ দেন গবেষকরা।
কিন্তু তারপরও লাখ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য বিতরণ নেটওয়ার্কে ভোল্টেজের সমস্যা হতেই পারে। ইউরোপে বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার পর সেটি উচ্চ ভোল্টেজে একটি সাবস্টেশনে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে ওই বিদ্যুত মাঝারি ভোল্টেজে শক্তি রূপান্তর কেন্দ্রগুলোতে যায়। শক্তি রূপান্তর কেন্দ্রগুলো বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কম ভোল্টেজের তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ করে।
ইউরোপে একটি রূপান্তর কেন্দ্র সাধারণত ১০০ থেকে ৩০০ গ্রাহকককে সেবা দিতে পারে। এখন সেই ৩০০ গ্রাহকের সবারই যদি ইভি থাকে এবং প্রত্যেকে একসঙ্গে গাড়ি চার্জ দেয়—এমনকি রাতের বেলায়ও—সেক্ষেত্রে কম ভোল্টেজের বিতরণ নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
ব্যাপকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের পথে অন্যতম বাধা হলো বৃহৎ পরিসরে ইভি চার্জের সমন্বয় এবং বিদ্যুৎ গ্রিডের উন্নয়ন। সময় যত গড়াবে, ইভির ব্যবহার যত সর্বব্যাপী হবে, এই সমস্যাগুলোও ধীরে ধীরে ততই স্পষ্ট হবে।