কেন বিশ্বে একমাত্র সিঙ্গাপুরেই বিক্রি হচ্ছে ল্যাবে তৈরি মাংস?
প্লেটে পরিবেশ করা মাংসের টুকরাগুলো মুরগির মাংসের মতো, গন্ধ মুরগির মাংসের মতো, এমনকি খেতেও মুরগির মাংসের মতো। ঘুণাক্ষরেও বোঝার উপায় নেই যে এগুলো সত্যিকারের মুরগির মাংস নয়, বরং রেস্টুরেন্ট থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরের একটা শিল্পাঞ্চলে ল্যাবরেটরিতে তৈরি! সিঙ্গাপুরের হুবার'স বুচারি অ্যান্ড বিস্ট্রোই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র রেস্টুরেন্ট, যেখানে তথাকথিত 'কালটিভেটেড মিট' (চাষের মাংস) বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা মাংস পাওয়া যায় মেন্যুতে।
রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্রেতাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে 'অভূতপূর্ব' সাড়া পেয়েছেন তারা।
তবে এই মাংস তৈরির মূল স্রষ্টা হলো ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান 'ইট জাস্ট'। তাদের ভাষ্যে, এই মাংস তৈরি করা নৈতিকতার দিক থেকে সঠিক, এটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উপায়ে করা হয় এবং গ্রিন (পরিবেশের জন্য নিরাপদ); সেইসঙ্গে স্বাদের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেন না তারা। এই খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই খাদ্যবস্তুটির অভিনবত্বের বাইরে এর কার্যকারিতা নিয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে।
২০১৩ সালে লন্ডনে বিশ্বের প্রথম ল্যাবে উৎপাদিত মাংস দিয়ে তৈরি বার্গার প্রকাশ্যে আনা হয়; যেটি তৈরিতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩৩০,০০০ ডলার! এরপর থেকে বিশ্বের আরও ডজনখানেক কোম্পানি এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে কিভাবে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা মাংস আরও সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে নিয়ে আসা যায়।
এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র 'ইট জাস্ট' নামক এই প্রতিষ্ঠানটিই তাদের পণ্য সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করার জন্য অনুমোদন পেয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এই কোম্পানির কৃত্রিম মুরগির মাংস বাজারজাতের অনুমোদন দেয়। বিশ্বে সিঙ্গাপুরই প্রথম কৃত্রিমভাবে তৈরি মাংস বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে।
কিন্তু এখনও এই মাংস সব জায়গায় সহজলভ্য নয়। ২০২১ সালে একটি বেসরকারি ক্লাবের মেন্যুতে চাষের মাংসের তৈরি চিকেন নাগেটস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের সেই অংশীদারিত্ব কয়েক মাস স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু এবছর হুবার'স বুচারি নতুন করে জনসাধারণের জন্য ল্যাবে তৈরি মুরগির মাংসের স্যান্ডউইচ এবং চিকেন পাস্তা আইটেম নিয়ে এসেছে। যদিও সপ্তাহে মাত্র একদিন সীমিত পরিমাণে সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে।
"চাষ করা মাংস আসল মাংসই, কিন্তু এর জন্য আপনাকে প্রাণীদের হত্যা করতে হবে না", বলেন ইট জাস্ট-এর প্রধান নির্বাহী জশ টেট্রিক। সান ফ্রান্সিসকো থেকে সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে তিনি বলেন, "খাওয়ার এই অভ্যাসটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অর্থবহ।"
প্ল্যান্ট-ভিত্তিক বিকল্পের তুলনায়, কালটিভেটেড মিট বা চাষের মাংস আক্ষরিক অর্থেই এক ধরনের মাংস। কোনো প্রাণী থেকে কোষ নিয়ে সেগুলোকে প্রোটিন, সুগার এবং ফ্যাট এর মতো পুষ্টি যোগ করা হয়। এই কোষগুলোকে বিভক্ত ও বড় হতে দেওয়া হয়। এরপরে একটা বিশাল বড় স্টিলের বায়োরিএক্টরের মধ্যে রাখা হয় যা কিনা একটা ফার্মেন্টেশন ট্যাংকের মতো কাজ করে। চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর বায়োরিএক্টর থেকে বস্তুটি তুলে নেওয়া হয় এবং এতে কিছু ভেজিটেবল প্রোটিন যোগ করা হয়। তারপর প্রক্রিয়াজাত করা হয় অথবা রান্নার দরকার হলে রান্না করা হয় এবং থ্রি-ডি প্রিন্টের মাধ্যমে মাংসগুলোকে প্রয়োজনীয় আকার ও টেক্সচার দেওয়া হয়।
আমার প্লেটে থাকা ওরেকিয়েত্তে পাস্তার মধ্যে দিয়ে যে ডিপ ফ্রাইড চিকেন উকি দিচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই খেতে সত্যিকারের মাংসের মতোই; অথবা বলা যায় কিছুটা প্রসেসড মাংসের মতো। ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টে আমরা যে ধরনের মাংস খাই, অনেকটা সেরকম।
শুধু চাষ করা মুরগির মাংসের স্বাদ নিতে সিঙ্গাপুরের এই রেস্টুরেন্টে আসা ইতালিয়ান শিক্ষার্থী কাতেরিনা সোৎসাহে বলেন, 'এটা সত্যিই মাংস, আর এটা একদম পারফেক্ট!' সাধারণত, স্থায়িত্বের দিক বিবেচনা করে তিনি মাংস খান না, কিন্তু কাতেরিনা জানালেন এই ল্যাবে তৈরি মাংস তিনি খাবেন। কিন্তু তার একমাত্র সমস্যা হলো, পাস্তার সাথে চিকেন দিয়ে পরিবেশ করা যা ইতালিতে সাধারণত দেখা যায় না।
একই রেস্টুরেন্টে খেতে আসা আরেকজন জানালেন, সত্যিকারের মাংসের সাথে ল্যাবে তৈরি মাংসের এতটা মিল দেখে তিনি বিস্মিত!
"এটা আসলে অকৃত্রিমই মনে হচ্ছে! আমি জানিনা এটা কোন জায়গা থেকে এসেছে। কিন্তু আমার চিন্তার বিষয় হলো এর খরচ কেমন", বলেন তিনি।
আমি যে পাস্তাটা নিয়েছিলাম সেটার দাম ছিল ১৮.৫০ সিঙ্গাপুরি ডলার বা ১৩.৭০ মার্কিন ডলার। কিন্তু মাংসটি উৎপাদনের বর্তমান খরচের তুলনায় খাবারটা বেশ ছাড়কৃত মূল্যেই পাওয়া গিয়েছে বলেই মনে হয়।
চাষের মাংস উৎপাদনের পেছেন ঠিক কি পরিমাণ খরচ হচ্ছে তা জানায়নি ইট জাস্ট। কিন্তু এই মুহূর্তে সিঙ্গাপুরে কোম্পানিটির উৎপাদন ক্ষমতা সপ্তাহে মাত্র ২ কেজি।
প্রতি সপ্তাহে শুধুমাত্র হুবার'স বুচারিতেই যেখানে ৪০০০ থেকে ৫০০০ কেজি সাধারণ মুরগির মাংস বিক্রি হচ্ছে, সেই তুলনায় কৃত্রিম মাংস বিক্রির পরিমাণ দেখলেই বোঝা যায় এটি তৈরিতে কেমন শ্রম দিতে হয়। আরও সহজভাবে বললে, প্রতি পিস মুরগির মাংস বিক্রির উপর ক্ষতি এড়াতে চাইলে তাদেরকে প্রচুর উৎপাদন বাড়াতে হবে।
ইট জাস্ট জানিয়েছে, ২০১৮ সালে শুরু করার পর থেকে তারা ইতোমধ্যেই উৎপাদন ব্যয় ৯০ শতাংশ কমাতে পেরেছে এবং কোম্পানিটি আমাকে সিঙ্গাপুরে তাদের নবনির্মিত, মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি পরিদর্শনেরও সুযোগ দিয়েছে। তাদের এই ফ্যাক্টরি আগামী বছর চালু হবে।
প্রতিটি ৬০০০ লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একজোড়া চকচকে স্টিলের বায়োরিএক্টর দেখে তাদের কাজের পরিসর অনেক বড় মনে হলেও, আসল মুরগি জবাই করে করে সরবরাহ করা মাংসের দামের সাথে পাল্লা দিতে চাইলে এখানে কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করতে হবে আরও মিলিয়ন মিলিয়ন টন মুরগির মাংস।
এ শিল্পখাত বিস্তৃতির জন্য ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীরা বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে! ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্ট: মিট ল্যাব এর সহ-পরিচালক রিকার্ডো স্যান মার্টিন বলছেন, "কোম্পানিগুলো যে ন্যারেটিভ নিয়ে মাঠে নেমেছে তা খুবই শক্তিশালী। কিন্তু সেই ন্যারেটিভকে বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করে দেখুন। এই প্রতিযোগিতায় যাদের কিছু পাওয়ার বা হারানোর নেই, সেসব ব্যক্তিদের লেখা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো পড়ে দেখুন, উত্তর স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি সাশ্রয়ী মূল্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উৎপাদন করতে পারবেন? না। আপনি কি এর মাধ্যমে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারবেন? আবারও উত্তর 'না'। এই কোম্পানিগুলোকে সততার সাথে স্বীকার করতেই হবে- এটা খুবই 'উইশফুল থিংকিং' (অসম্ভব কল্পনা)।"
শুধু যে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে তা-ই নয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর 'গ্রিন ক্রেডেনশিয়াল' (কোনো একটি উদ্যোগ যে পরিবেশ রক্ষার জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ দেখানোর মতো দক্ষতা বা বৈশিষ্ট্য) নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা এটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, মাংস উৎপাদনের জন্য ভূমি এবং পশুসম্পদের উপর বিশ্বের নির্ভরতা হ্রাস করার ফলে কার্বন নির্গমন হ্রাস পাওয়া উচিত। কিন্তু এই মুহুর্তে চাষের মাংস তৈরির জন্য যে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন তা এতটাই শক্তি নিবিড় যে এটি অন্য কোনো সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চাষের মাংস তৈরির এ প্রক্রিয়ায় সাধারণ গরুর মাংস উৎপাদনের তুলনায় ৪ থেকে ২৫ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়। যদিও ইট জাস্ট এই গবেষণাকে 'ত্রুটিপূর্ণ' বলে অভিহিত করেছে।
পুরো প্রজেক্টটিই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে কিনা, বিবিসির এমন প্রশ্নে ইট জাস্ট- এর প্রধান নির্বাহী জশ টেট্রিক বলেন, "হ্যাঁ হতেই পারে।" কিন্তু তিনি অপ্রতিহত: "এভাবে মাংস তৈরি একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং চরম অনিশ্চিত।"
"এটা সোজাসাপ্টা কিছু নয়। এটা জটিল। এখানে নিশ্চয়তা নেই, বিষয়টা কাজ নাও করতে পারে। কিন্তু আমাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হলো, কিছুই না করা। তাই আমরা এই বাজি ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এগিয়ে যাচ্ছি।"
টেট্রিকের মতো এই একই বাজি ধরেছেন আরও অনেক বিনিয়োগকারী। এবছর চাষের মাংস তৈরির পেছনে প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
তবে চাষ করা মাংস যদি উন্নত বিশ্বের সচ্ছল মানুষের জন্য একটি 'বিশেষ বিকল্পে'র চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠে, তাহলে ব্যক্তিগত ব্যবসার বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে থাকা যথেষ্ট নাও হতে পারে। টেট্রিক বলেন, পশু জবাই করে পাওয়া মাংসের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইলে সরকারকে চাষের মাংস উৎপাদনের পেছনে 'উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জনসাধারণের অর্থ' ব্যয় করতে হবে।
"এটা অনেকটা নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ধাবিত হওয়ার মতো... আজীবনের প্রজেক্ট... হয়তো কয়েক প্রজন্ম ধরে অব্যহত থাকার মতো প্রজেক্ট", বলেন টেট্রিক। কিন্তু যথাযথ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি তো দূরে থাক, এই মুহূর্তে সিঙ্গাপুর ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশই বৈধভাবে চাষের মাংস বিক্রির অনুমোদন দেয়নি।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিকার্ডো স্যান মার্টিনের মতে, কোম্পানিগুলো যদি বিষয়টি সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি না করে এবং বিনিয়োগকারীদের সামনে ভবিষ্যত নিয়ে বাস্তবসম্মত আভাস না দেয়, তাহলে খুব শীঘ্রই চাষের মাংস তৈরিতে কোম্পানিগুলোর পেছনে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ ফুরিয়ে যাবে।
"ভবিষ্যতে একটা পর্যায়ে গিয়ে যদি এই খাতে সফলতার সহজ পথ তৈরি না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা এবং সরকারও এমন কিছুর পেছনে অর্থ ব্যয় করতে চাইবে না যেটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।"