লিপ রিডারস: ঠোঁটের ভাষা বুঝতে পারেন যারা!
১৬ বছর বয়সে প্রথম নিনা ডেলিঙ্গার বুঝতে পারেন যে, তিনি মানুষের 'লিপ রিড' করতে পারেন! অর্থাৎ শব্দ না শুনেও অপরপক্ষ ফিসফিস করে কী বলছে, তা ঠোঁট নাড়ানো দেখেই বুঝতে পারেন নিনা।
সে সময় একদিন গণিতের ক্লাসে একাকী বসেছিলেন নিনা। কোন শব্দ কানে আসছিলো না, তবু রুমের অপর পাশে তার সহপাঠী কী মন্তব্য করে যাচ্ছে, তা ঠিক বুঝতে পারছিলেন।
বছরের পর বছর নিনা তার এই গোপন প্রতিভার কথা বুঝতে দেননি কাউকে। নিজেই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে চর্চা করে যেতেন, রীতিমতো খেলা হয়ে উঠেছিল এটি তার কাছে। কিন্তু ২০২০ সালে ভিডিও শেয়ারিং সাইট টিকটকে যোগ দেয়ার পর নিনার চিন্তায় বদল এলো। ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন তারকার ফিসফিসিয়ে বলা কথার অনুমান করে তা নিয়ে ভিডিও বানাতে লাগলেন। জনপ্রিয়তা আর ফলোয়ারের সংখ্যা, দুটোই বাড়তে লাগল নিনার।
ফেব্রুয়ারিতে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের ৬৫তম আয়োজনে উপস্থিত তারকাযুগল বেন অ্যাফ্লেক এবং জেনিফার লোপেজের টেবিলে তাদের মধ্যে একটু অস্বস্তির আভাস পাওয়া যায়। কিছু একটা বলছিলেন তারা।
তাদের মধ্যে ঠিক কী নিয়ে কথা হয়েছে, তা হয়তো অজানাই থেকে যেত; কিন্তু সেখানেই ত্রাতা হিসেবে এলেন নিনা।
টিকটকে পোস্ট করা ভিডিওতে নিনা ডেলিঙ্গার দেখান যে, জেনিফার বলেছেন, 'প্রুভ ইট' (প্রমাণ কর)। এরপর সামান্য বিরতি…তারপরের অংশে মিসেস অ্যাফ্লেককে সত্যিই বলতে শোনা যায়, 'প্রুভ ইট'। নিনা ডেলিঙ্গারের এই ভিডিওতে ভিউ উঠে ১২ মিলিয়নেরও বেশি।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিনা বলেন, "আমি ভাবতেও পারিনি এতো বেশি সংখ্যক মানুষ একে গ্রহণ করবে।"
টিকটকে লাখো ফলোয়ারের কাছে তার পরিচয় এখন 'লিপ রিডিং গার্ল' হিসেবে হলেও নিনার মন পড়ে আছে আসলে অন্য কিছুতে। ২৬ বছর বয়সী নিনা তার স্বপ্নের ক্রুজ কোম্পানির ব্যবসা খুলতে দেড় বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বেলিজে স্থানান্তরিত হন।
'লিপ রিডিং' এর আসলে বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যাখ্যা নেই; বরং পুরো বিষয়টাই হলো অনুশীলন আর দক্ষতা নির্ভর। বিশেষজ্ঞ লিপ রিডার জেরেমি ফ্রিম্যান (৪৯) একে একটি দক্ষতা হিসেবেই বর্ণনা করেছেন যা যথেষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্তে আনা সম্ভব। যৌন নিপীড়ন, বীমা জালিয়াতি এবং অন্যান্য গুরুতর বিষয়ের কেস সমাধানে ডাক পড়ে লন্ডনভিত্তিক লেখক ফ্রিম্যানের। জন্মগত বধির ফ্রিম্যানের মধ্যে এই অভ্যাসটি বড় হওয়ার সময় সহজাতভাবেই গড়ে উঠেছে।
শুধু ঠোঁট নয়, ক্ষেত্রবিশেষে শরীরী ভাষা (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ), সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রভৃতি বিষয়গুলোও ব্যক্তির কথোপকথন বুঝতে সাহায্য করে বলে জানান ফ্রিম্যান; সাথে কাজে লাগাতে হয় নিজের অনুমানকেও।
"তবে শতভাগ সঠিক ঠোঁট পড়তে পারি, এমন দাবি আমি করবোনা। স্কটিশ কৌতুক অভিনেতা বিলি কনোলির কথা বলতে পারি…তার ঠোঁট দেখে কী বলছেন তা বুঝতে পারাটা রীতিমতো অসম্ভব।"
শুধু কি নির্ভুলতা, ব্যক্তির ঠোঁট নাড়ানো দেখে তিনি কী বলছেন তা জানার চেষ্টা করা কি ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘনেরও সামিল নয়?
ফ্রিম্যানের মতে, কেউ বাড়িতে বসে কিছু বললে তিনি অবশ্যই তার কথা খুঁজে বের করতে যাবেন না। কিন্তু ব্যক্তি যদি কোনো তারকা হোন, বা কোনো লাইভ ইভেন্ট যেমন রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকে তিনি গণমাধ্যমের জন্য যে ভাষ্য দিচ্ছিলেন,সেসব প্রেক্ষিতে লিপ রিড করাটা সঙ্গত।
টিকটকের আরেকজন জনপ্রিয় লিপ রিডার ক্রিস্টিন কালভয় (২৫) বলেছেন, তিনিও এমন কোনো ভিডিওর মধ্য দিয়ে যাবেন না, যেখানে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ক্রিস্টিনও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী।
তারকাদের ভিডিও থেকে আদৌ লিপ রিড করতে পারবেন কী-না , এ নিয়ে শুরুতে সংশয় ছিল তার মনে। কারণ এগুলোর অধিকাংশই লাইভ ইভেন্ট থেকে নেওয়া আর সরাসরি মুখের পরিবর্তে তারকাদের বিভিন্ন পার্শ্ব থেকে শ্যুট করা। কিন্তু নিনা ডেলিঙ্গারের মতো তিনিও শেষ পর্যন্ত এই ধরনের ভিডিও পোস্ট করে ইতিমধ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ কামিয়েছেন!
ক্রিস্টিনের অবশ্য রোজকার জীবনেও এই লিপ রিডিংয়ের অবদান অনেক। প্রতিদিন চলতে ফিরতে এই দক্ষতা তাকে কাজে লাগাতে হয়। যদিও আগের চেয়ে পরিস্থিতি এখন কিছুটা প্রতিকূল হয়ে উঠেছে এই শ্রবণ-প্রতিবন্ধীর জন্য।
"আজকাল সবাই শুধু ফোনের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে। অথচ আমার প্রয়োজন আই কনট্যাক্ট…যোগাযোগের জন্য আমার মানুষের চোখের, মুখের দিকে তাকাতে হয়, বুঝতে হয়…।"