ডিএনসিসি-র গাছের দায়িত্বে তরুণ দল; কারা এই ট্রি গার্ডিয়ান?
ভাবুন তো, একদিন সকালে ঘুম ভেঙে জানলেন পৃথিবীতে একটা গাছও আর অবশিষ্ট নেই। বিশাল বৃক্ষ সব কাটা পড়েছে মানুষের প্রয়োজনে, চারাগাছগুলো মরেছে অযত্নে-অবহেলায়। প্রকৃতির যে অভিভাবকের ভরসায় এতদিন নির্বিঘ্নে বেঁচে ছিলেন, তারাই বিলীন হয়েছে অভিভাবকহীনতায়। বৃক্ষশূন্য সেই পৃথিবীতে কয়দিন টিকে থাকতে পারবেন?
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন দশকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে সবুজ এলাকার পরিমাণ কমেছে ৬৬ শতাংশ। গত ৯ মে মার্কিন জার্নাল পিএলওএস সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশনে প্রকাশিত 'প্রোসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অভ অ্যাচিভিং সাস্টেইনেবল আরবান গ্রিন স্পেসেস: আ কেস স্টাডি অভ আরবান গ্রিনিং ইন ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), বাংলাদেশ' শীর্ষক সেই গবেষণায় জানা যায়, ১৯৯২ সালে ঢাকার উত্তর অঞ্চলে ৯২.২১ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল গাছপালা, যা ২০২২ সালে এসে প্রায় ৬৬ শতাংশ কমে ৩১.৪০ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে।
এই হারে গাছপালা কমতে থাকলে কল্পনার সেই বৃক্ষশূন্য দিনের সম্মুখীন হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। দেশের নানা অঞ্চলে নিয়মিত বৃক্ষ নিধনের খবরে সচেতন নাগরিকদের ক্ষোভ তাই নিরর্থক নয়। তবে শত নিরাশার মাঝেও এবার আশার খবর শোনা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে। মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী দুই বছরে ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় দুই লক্ষ গাছ রোপণ করা হবে। গত ৬ জুন তেজগাঁওয়ের মেয়র আনিসুল হক সড়কে ১২১টি গাছ রোপণের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই উদ্বোধন হয়েছে এই কর্মসূচির।
পাঠকেরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, গাছ রোপণের ঘোষণা আর নতুন কী! বছর বছর এমন কত ঘোষণাই তো আসে। ঘটা করে বৃক্ষরোপণও চলে। কিন্তু আদতে তাতে লাভ হয় না কিছুই। বেশিরভাগ সময়ই পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যায় সেসব গাছ। পরিবেশের উন্নয়নে এমন বৃক্ষরোপণের ভূমিকা তাই নেই বললেই চলে।
তবে কার্যকরী ও স্থায়ী উন্নয়নের চিন্তা মাথায় রেখে ডিএনসিসি-র এবারের উদ্যোগ বেশ অভিনব। দুই লক্ষ গাছের চারা রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১০০ জন 'ট্রি গার্ডিয়ান' নিয়োগ করছে তারা। ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০০ জন প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণী দায়িত্ব পালন করবেন এসব গাছের অভিভাবক হিসেবে। নির্দিষ্ট এলাকায় বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত স্থান নির্বাচন থেকে শুরু করে দ্রুত চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়া, বাড়ন্ত গাছের দেখভাল করা ও পুরানো বড় গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও বর্তাবে গাছের এই অভিভাবকদের উপর।
থাকছে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধান
গাছের যত্নে ট্রি গার্ডিয়ানদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রকল্পটিতে পরামর্শক ও প্রশিক্ষণ সহযোগী হিসেবে যুক্ত আছেন গ্রিন সেভার্স সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি। ঢাকা শহরের সবুজ বাঁচিয়ে রাখতে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গাছের রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ মালী গড়ে তুলতে শিক্ষিত তরুণদের উৎসাহী করেন তিনি। প্রশিক্ষিত মালীদের পরিচয় করিয়ে দেন গাছের ডাক্তার হিসেবে। গাছপালার পরিচর্যার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন গাছের হাসপাতালও।
ইতোমধ্যেই ডিএনসিসির বৃক্ষরোপণ প্রকল্পের ট্রি গার্ডিয়ানদের একাংশের প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন আহসান রনি। ট্রি গার্ডিয়ানদের কাজ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঢাকা শহরে দুই লক্ষ গাছ লাগানোর জায়গা বের করাটা কিন্তু চ্যালেঞ্জিং। ট্রি গার্ডিয়ানদের প্রথম দায়িত্বই হলো তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় রাস্তার দুপাশে ফুটপাতে, মিডিয়ানে এবং খোলা জায়গায় গাছ লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বাছাই করা। গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা, সেগুলোর কোনো ক্ষতি হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কাজও করবে তারা।'
'তিন দিনের প্রশিক্ষণে ট্রি গার্ডিয়ানদের সুস্থ-সবল গাছের চারা বাছাই করা, ঠিকমতো গাছ রোপণ করা, পরিচর্যা করা নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণের পর ট্রি গার্ডিয়ানরা তাদের কাজ শুরু করেছে। আরও কয়েক ধাপে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি তো অনেক হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই গাছগুলো অধিকাংশ সময়ই বেড়ে উঠতে পারে না। এই কর্মসূচিতে লাগানো গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের কাজের প্রধান লক্ষ্য,' যোগ করেন আহসান রনি।
এ বিষয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন নেটিজেনরা।
কাজ শুরু ৩০ জনকে নিয়ে, অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালনা
প্রথম ধাপে ৩০ জন ট্রি গার্ডিয়ান নিয়ে শুরু হয়েছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বনবিভাগের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত মালীও আছেন এই দলে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাছাই করা হয়েছে ট্রি গার্ডিয়ান হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী তরুণ-তরুণীদের।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির জন্য ডিএনসিসির বিশেষভাবে নির্মিত 'গাছের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা' নামের অ্যাপের মাধ্যমে ট্রি গার্ডিয়ানদের কাজের রেকর্ড রাখা ও তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। গাছ রোপণের উপযুক্ত জায়গা বেছে অ্যাপে তা এন্ট্রি করে রাখেন গাছের অভিভাবকেরা। কোনো গাছের সমস্যা হলে অ্যাপের মাধ্যমেই নিতে পারেন বিশেষজ্ঞদের সহায়তা। প্রত্যেক ট্রি গার্ডিয়ানের কাজের জন্য নির্ধারিত থাকবে এক কিলোমিটার এলাকা।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, 'চূড়ান্তভাবে ১০০ জন ট্রি গার্ডিয়ানকে নিয়ে কাজ করা হবে। কিন্তু অফিসিয়াল সব কাজ শেষ করতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। গাছ লাগানোর উপযুক্ত মৌসুম যেহেতু এসে গেছে, তাই প্রাথমিকভাবে ৩০ জনকে নিয়েই কাজ শুরু করেছি আমরা। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব বাকিদের নিয়োগ করা হবে।'
বনবিভাগের বিশেষজ্ঞরাও এই কর্মসূচিতে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত আছেন। কোন জায়গায় কী গাছ লাগানো যায়, কীভাবে তাদের ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির তদারকি করছেন ডিএনসিসির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান খান। তিনি জানান, ট্রি গার্ডিয়ান হিসেবে কাজ করতে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ অনেক বেশি। 'দক্ষতার জন্য ট্রি গার্ডিয়ান হিসেবে আমরা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মালী যেমন রাখছি, তেমনি সুপারভাইজার হিসেবে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদেরও নিচ্ছি। কাজটা যেহেতু অ্যাপের মাধ্যমে করতে হবে, তাই কর্মীদের স্মার্ট ফোন ব্যবহারে দক্ষতা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা,' বলেন নুরুজ্জামান খান।
ট্রি গার্ডিয়ান হিসেবে ডিএনসিসির কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছেন মিরপুরের বাসিন্দা তানিয়া খানম রিমা। ইডেন মহিলা কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। গাছপালা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই গাছের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিয়েছেন রিমা। তার ভাষ্যে, 'আমার মতো আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীই এগিয়ে এসেছেন এই কাজে। পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধই আমাদের প্রেরণা। শুরুতে ৫০০ মিটার এলাকা নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক ট্রি গার্ডিয়ানকে। আমি মিরপুর, মোহাম্মাদপুর ও আশেপাশের এলাকায় গাছ লাগানোর জায়গা চিহ্নিত করতে শুরু করেছি।'
আশার আলো দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
শুধু লোক দেখানো বৃক্ষরোপণেই দায়িত্ব শেষ না করে পরিবেশের সুরক্ষায় গাছ বাঁচিয়ে রাখার এই উদ্যোগে আশাবাদী হয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা বলেন, 'এতদিন পর কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে যে শুধু গাছ লাগালেই হবে না, গাছটাকে পরিচর্যা করে বড় করে তুলতে হবে—এটাই অনেক আশার খবর। মানবশিশুদের মতো গাছের চারাকেও যত্ন করে পরিচর্যা করতে হয়। আমিও বহুদিন ধরে এই কথাটা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। এই উদ্যোগের মাধ্যমে যদি রোপণ করা ৬০-৭০ শতাংশ বৃক্ষও বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটাও অনেক ভালো প্রভাব ফেলবে পরিবেশে।'
তবে উন্মুক্ত জায়গার জন্য গাছ নির্বাচনেও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। মেয়রের পরিকল্পনায় ঢাকার ফুটপাতে ছাতিম, বকুল, কাঠবাদাম, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, সড়কের মিডিয়ানে কাঁটা মেহেদী, রঙ্গন, করবী ও বাগানবিলাস, বামন জারুল, রসকাউ আর খালের পাশে আম, জাম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর কথা জানা গেছে।
এ বিষয়ে মিহির লাল সাহা বলেন, 'ছাতিম, বকুল শক্ত জাতীয় গাছ। ফুটপাতের জন্য এগুলো ভালো হবে। মিডিয়ানে বাগানবিলাস, রক্তকরবীও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বেশ ভালো। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া একটু নরম জাতীয় গাছ। দেখতে সুন্দর হলেও এগুলোর গুড়ি খুব একটা শক্ত হয় না। তাই রাস্তায় ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। গাছ রোপণের আগে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।'
এই কর্মসূচিতে শহরের রাস্তার পরিবেশ বিবেচনায় উপযুক্ত গাছ ও জায়গা নির্বাচনে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও স্বাগত জানিয়েছেন এই উদ্যোগকে। তার ভাষ্যে, 'এ ধরনের কাজে তরুণ-তরুণীদের নিযুক্ত করা খুবই ভালো খবর। শুরু থেকেই তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে এই কাজের মাধ্যমে। তাছাড়া যে এলাকায় গাছ লাগানো হবে সেখানকার কমিউনিটিকেই গাছের দেখভালের দায়িত্ব দিলে তাদের মধ্যে কমিউনিটি ওনারশিপও তৈরি হবে। নিজেরা দায়িত্ব নিয়েই গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে আগ্রহী হবেন তারা।'