গাছ উপহার দেওয়াই তার নেশা, ৬ বছরে লাগিয়েছেন দেড় লাখের বেশি গাছ
'শাল সত্তর গদা আশি
সোনালু কয়, আমি তিরাশি বছর জলে ভাসি।
বাদি কয়, আমি যদি হইতে পারি কাইত,
তয় তোর তিরাশি বছর আমার এক রাইত'
সেদিন গাছ সম্পর্কে এমন তথ্যসমৃদ্ধ ছন্দ শুনলাম 'গাছপাগল' শাখাওয়াত উল্লাহর কাছ থেকে। হ্যাঁ, গাছপ্রেমীর বদলে গাছপাগল শব্দটাই শাখাওয়াত উল্লাহর চরিত্রের সঙ্গে বেশি মানানসই। 'পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না' কথাটাও বেশ বাস্তব মনে হলো তাকে দেখে।
সোনালুর মতো ঝলমলে হাসি, কালো ফ্রেমের চশমা আর সাদামাটা পোশাকের তরুণ শাখাওয়াত উল্লাহ—যাকে মানুষ চেনে তার পাগলামোর জন্য। বিয়ে, জন্মদিন, প্রেম কিংবা বিরহের উদযাপনে চেনা অথবা অচেনা মানুষকে গাছ উপহার দেন তিনি। এমনকি কারও মৃত্যুসংবাদ পেলে মৃত ব্যক্তির স্মরণে গিয়ে গাছ রোপণ করে আসেন শাখাওয়াত।
'এক ছেলে একদিন লাল কদম গাছের সন্ধান করতে লাগল। খুঁজে এনে দিতেই হবে। লাল কদমের বাইরের পাপড়িগুলো সাদা হলেও ভেতরটা হলুদের বদলে লাল, এ প্রজাতির কদম বাংলাদেশে বিরল। বুঝলাম ছেলেটা প্রেমে পড়েছে। প্রেয়সীর আবদার। আমি অনেক খুঁজে লাল কদমের চারা পেলাম। সে এক অ্যাডভেঞ্চার।'
কোনো দুর্লভ বা বিলুপ্তপ্রায় গাছের প্রজাতি যা হাজার খুঁজেও কোথাও পাওয়া যায় না, সেটাও শাখাওয়াত উল্লাহকে বলামাত্র ম্যাজিকের মতো কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যে আপনার দরজায় হাজির হতে পারে।
কিন্তু বিনামূল্যে এ গাছ বিলানোর অর্থটা কোত্থেকে আসে? অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো—শাখাওয়াত তার ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের অর্থে এ গাছ বিলানোর কাজ করেন। সারাদিন চাকরি করে মাসশেষে নিজের খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা রেখে দেন গাছের জন্য। এমন কিছু মানুষের জন্যেই এসব প্রবাদ আজও অচল হয়ে যায়নি।
শুরুটা যেমন ছিল
নোয়াখালীর ছেলে শাখাওয়াত উল্লাহ। তার বাবা মওলানা কেফায়েতউল্লাহ চরবাটা খাসিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে কেফায়েত উল্লাহ ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন, কিন্তু বেশি দূর গড়ায়নি লড়াইটা। পরের বছর ইন্তেকাল করেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর তার প্রিয় ছাত্ররা ও পাড়া প্রতিবেশীরা শাখাওয়াতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। প্রায় সবার মুখেই শাখাওয়াত শুনেছেন একই কথা—তার বাবা প্রত্যেকের বাড়িতে একটা না একটা গাছ লাগিয়েছেন। কেউ কেউ তৃপ্তি করে এখন সে গাছের ফল খান, এমন কথাও শোনেন শাখাওয়াত।
বাবার কেমোথেরাপি চলাকালীন একদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নার্সারি দেখে বাবা গাড়ি থামাতে বলেন। কারণ তিনি কৃষ্ণচূড়া ও সোনালু গাছ কিনতে চান তার স্কুলের পার্শ্ববর্তী ব্রিজের দুপাশে রোপণের জন্য। স্কুল শিক্ষক মওলানা কেফায়েতউল্লাহর বৃক্ষপ্রেমের সঙ্গে নান্দনিক বোধও ছিল। মাঝখানে ব্রিজ, দুপাশে থরে থরে কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু। এমন শোভার কথা ভাবলেই যে কারও চোখ আর প্রাণ জুড়োবে।
কিন্তু শেষমেশ সে কৃষ্ণচূড়ার রোপণ দেখে যেতে পারেননি এ শিক্ষক। বাবার মৃত্যুর পর এ ছোট ছোট ঘটনা শাখাওয়াতকে নাড়া দেয়। তিনি ২০১৮ সালে বাবার স্মৃতিতে নোয়াখালীতে ১০০টি কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করেন।
ওই সময়টাতে নোয়াখালীতে সোনালুর চারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সোনালু ফুল যেমন সুন্দর তেমনি এ গাছ বাঁচে প্রায় ৮৩ বছরেরও বেশি সময়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঢাকার সবুজ বাংলা নার্সারিতে সোনালুর চারা পান তিনি। ঢাকা থেকে সেসব চারা সংগ্রহ করে নোয়াখালীর সুবর্ণচর জুড়ে শাখাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সোনালুর হলদে রঙা হাসি। এভাবেই বাবার স্মৃতি আর ভালো কাজের দৃষ্টান্তে শাখাওয়াত গাছের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করেন গাছের প্রেমে।
শাখাওয়াত উল্লাহ ২০১৯ সালের দিকে ঈদের ১০ দিনের ছুটিতে ১০ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। দিনরাত গাছ লাগালে হয়তো ১০ হাজার না হলেও কয়েক হাজার গাছ রোপণ করা সম্ভব হতো, তবে তা বাঁচানো যেত না। শেষ পর্যন্ত সে বছর তিনি মাত্র ১২০–১২৫টি গাছ লাগাতে পেরেছিলেন।
এ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন, প্রচুর গাছ লাগানোর চেয়ে কম গাছ লাগিয়ে সেগুলো টিকিয়ে রাখাটাই বেশি কার্যকর। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে ছুটি পেলেই শাখাওয়াত গ্রামের দিকে ছুটে যান, সংগ্রহ করেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। বৈচিত্র্যময় ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির গাছের প্রতি তার টানটা একটু বেশিই।
দুর্ঘটনা…!
২০২০ সালে কোভিড-১৯-এর কারণে হোম অফিস তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। হোম অফিসের সুবাদে তিনি গাছদের আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। সে সময় তিনি রাস্তার পাশাপাশি এলাকাবাসীর প্রতিটি বাড়িতে এমন গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন, যে গাছ সেসব বাড়িতে নেই।
এ উদ্দেশ্যে তিনি কম দামে গাছের চারা বিক্রি করে এমন নার্সারি খুঁজছিলেন। কারণ অনেক গাছ কেনার জন্য তার সঞ্চয় সামান্য ছিল। সদিচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। শেষে জুলাই মাসের দিকে চট্টগ্রামের এক সংস্থার সন্ধান মেলে, যারা নামমাত্র মূল্যে গাছের চারা দেয়। পাঁচ হাজার গাছ আনার জন্য একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়।
চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে শাখাওয়াত সুবর্ণচরে চারাগুলো রাখার জন্য একটি অস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন এবং কোথায় কীভাবে গাছ লাগাবেন তার একটি খসড়াও তৈরি করেন। চট্টগ্রামে পৌঁছে পাঁচ হাজার গাছের চারা সংগ্রহের আনন্দে শাখাওয়াত যেন অন্য মানুষ হয়ে যান। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে ট্রাকে চারা তোলার কাজ চলে।
ফেরার পথে শাখাওয়াত প্রথমে ট্রাকে ফিরবেন না বলে ঠিক করেছিলেন, তবে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ট্রাকেই ফেরেন। ট্রাকটি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পৌঁছালে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ট্রাকের চালক গুরুতরভাবে আহত হন, এবং শাখাওয়াতের দুই পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রায় তিন মাস চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের পর এখন তিনি লাঠি নিয়ে হাঁটতে পারেন। দুর্ঘটনার দিন প্রায় হাজারখানেক গাছের চারা চুরি হয়ে যায়। বাকি চারা অক্টোবর পর্যন্ত শাখাওয়াতের সুস্থতার অপেক্ষায় ছিল। সেই টানেই তাকে নোয়াখালীতে ফিরতে হয়।
পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে শাখাওয়াত আর ঠিকভাবে মাটিতে বসে গাছ লাগাতে পারেন না। নিজের হাতে গাছ লাগানোর সাধ অপূর্ণই রয়ে যায়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। বরং নতুন জীবন পেয়ে পৃথিবীকে সবুজ করার তাগিদ তার মাঝে আরও বেড়ে গেছে।
যে-সব তরুণ গাছ ভালোবাসেন, তাদের নিয়ে তিনি একটি ভলান্টিয়ার দল গড়ে তুলেছেন শাখাওয়াত। দিন দিন এ দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। অনেকের ধারণা, তরুণ প্রজন্ম পরিবেশবান্ধব নয়। তবে শাখাওয়াত জানান, এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়।
নোয়াখালীতে নদীভাঙনের কারণে বহু মানুষের জমিজমা ও ঘরবাড়ি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। এসব এলাকায় অর্জুন গাছ নদীভাঙন রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শাখাওয়াত ও তার দল এসব এলাকায় অর্জুন গাছ লাগিয়েছেন। এছাড়াও, তিনি মানুষকে ওষধি গাছ, প্রাচীন প্রজাতির গাছ এবং পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহিত করেন। গাছের চারা কম দামে পেতে হর্টিকালচার সেন্টার ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের নার্সারি নির্ভরযোগ্য, এ কথা শাখাওয়াত সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন।
সাহিত্যের গাছের সন্ধানে
'কুমিল্লায় কমলা রঙা শিমুলের সন্ধান পাই কিছুদিন আগে। কী অপূর্ব রূপ! মনে হয়েছিল, এ ফুল দেখেই কবি জীবনানন্দ দাশ কমলা রঙের রোদের কথা লিখেছেন।'
শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, 'আমি আর আমার স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা উপন্যাসে যে-সব গাছের নাম পড়েছি, সে সমস্ত নাম সংগ্রহ করছি। ঠিক করেছি ঐ প্রজাতির গাছ খুঁজে বের করে রোপণ করব। এতে করে অনেক হারিয়ে যাওয়া গাছের খোঁজ পাওয়া যাবে। সেগুলো আর হারাতে পারবে না।'
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হিজল গাছের কথা এসেছে, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে গন্ধভেজাল [গন্ধভাদালি] লতার কথা উল্লেখ আছে। হিজল গাছের কথা কিছু মানুষ জানলেও গন্ধভেজাল লতার নাম অনেকেই জানেন না। আবার মহুয়া নামের অবতারণায় আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে সুন্দর মেয়ের কথা, কিন্তু মহুয়া গাছের কথা মনে পড়ে না। কারণ অনেকেই জানেন না মহুয়া গাছের নাম, রূপ কিংবা ফুলের কথা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কবি নজরুলের কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ থাকা গাছগুলো লাগানোর জন্য পরিকল্পনা চলছে। শাখাওয়াত বলেন, 'যে কবির বাড়ি যেখানে, সেই জেলায় সেই কবির স্মরণে গাছ রোপণের ইচ্ছেও মনের মধ্যে রেখেছি। ঝালকাঠিতে কামিনী রায়ের বাড়ি, সুতরাং সেখানে কামিনী গাছ ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।'
'যদ্দিন বাঁচব, তদ্দিন গাছ লাগাব'
২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনা ৩৬ বছর পর ফুটবল বিশ্বকাপ জেতে। শাখাওয়াত উল্লাহর জ্ঞান হওয়ার পর এটি ছিল আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়। সে কারণে আর্জেন্টিনার ভক্ত হিসেবে তিনি ২০২২ সালের পর দুই হাজার গাছ লাগিয়েছেন।
তবে শাখাওয়াত ভেবেছিলেন, যদি আর্জেন্টিনা হেরে যায়, তাহলে শোক উদযাপনের জন্য কিছু গাছ লাগাবেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার কাপ জিতে যাওয়ার আনন্দে তার গাছ লাগানোর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
গাছকে ঘিরে শাখাওয়াতের জীবন প্রবাহিত হয়। গাছের মাধ্যমে তিনি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, আবার গাছের ক্ষতির কারণেই কিছু মানুষের সঙ্গে বৈরিতা তৈরি হয়। তার জীবনের অধিকাংশ সম্পর্কই গাছকেন্দ্রিক। শাখাওয়াত মনে করেন, যদি কেউ কারও শত্রু হয়, তাহলে শত্রুকেও গাছ উপহার দেওয়া যেতে পারে।
গত ছয় বছরে শাখাওয়াত প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার গাছ লাগিয়ে ফেলেছেন বলে জানান। এখন আর তিনি মনে করেন না, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ লাগাতে পারলেই তার কাজ শেষ। বরং তিনি বলেন, 'যদ্দিন বাঁচব, তদ্দিন গাছ লাগাব। শুধু রোপণ করব না, গাছকে ভালোবাসার বার্তা ছড়াব। লুপ্তপ্রায় গাছের প্রজাতি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে সে প্রজাতি আর হারানোর সম্ভাবনা থাকবে না।'
এভাবেই শাখাওয়াতের মতোন গাছপ্রেমী তরুণেরা তাদের সবুজ মন নিয়ে এগিয়ে আসছে পৃথিবীকে সবুজ করার উদ্দেশ্যে। যদি এমন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে একদিন পৃথিবী চিরসবুজ হয়ে উঠবে, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সবই থাকবে সতেজ। বসন্তে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে বাড়ির উঠোন কিংবা ছাদ, আর শীতকালে সব পাতা ঝরে গেলেও নতুন বসন্তের অপেক্ষা কখনো শেষ হবে না।
ছবি: সৌজন্যে