নিরাপদ পানি সংকটের যে পরিণতি অন্য দেশগুলোকেও ভোগ করতে হতে পারে
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। হিমালয় থেকে নির্গত হয়ে আসা নদীগুলো বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় ভাগ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মেশে। অনেকটাই কৃষি নির্ভর এই দেশের বড় চালিকা শক্তি নদী, জলাধার কিংবা পুকুর। তবে এখন বাংলাদেশের বড় হুমকিও এই পানি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। লবাণাক্ত পানিও চলে আসছে উপকূলীয় লোকালয়ে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে অর্ধেকই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত। প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগ থেকে বাঁচতে মানুষজন যা কিছু সম্ভব করছে। তবে সেগুলোও যথেষ্ট নয়।
বিষয়টি পুরো বিশ্বের জন্যও গুরুত্ববহ। কারণ ১৭ কোটি মানুষের এই জনাকীর্ণ দেশে বাসিন্দারা আজ যা কিছু প্রত্যক্ষ করছে তা হয়তো আগামীকাল অন্যদের মোকাবেলা করতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ উজানে ভারী বর্ষণের খবর পেলেই ধান কাটার জন্য ছুটছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষ ভাসমান শাকসবজি চাষ শুরু করেছে। যেখানে চিংড়ির খামারের কারণে ফসলি জমি লবণাক্ত হয়ে উঠছে, সেখানে মানুষ প্লাস্টিকের বাক্সে জৈব সার দিয়ে চাষ করছে। যেখানে বসত বাড়ি ভেসে যাচ্ছে, সেখানে মানুষ অন্য গ্রামে বা শহরে চলে যাচ্ছে। যেখানে পান করার মতো মিঠা পানির অভাব সেখানে মানুষ বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা পান করতে শিখছে।
সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনায় বলেন, এটা এমন যে একটি ড্রামে সাতটি ফুটো আছে। আর আপনার তো হাত দুটো। তখন কি করবেন? এটা (পরিস্থিতি সামাল দেওয়া) সহজ বিষয় নয়।
বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার সময় মৃতের সংখ্যা কমাতে পেরেছে। তবে মোকাবেলা করার মতো আরো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমন উপকূল বরাবর লাখ লাখ মানুষের জন্য পানীয় জলের নতুন উৎস খুঁজে বের করা, শস্য বীমা প্রসারিত করা, গ্রামাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত লোকজনের জন্য শহর প্রস্তুত করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে আবহাওয়ার তথ্য ভাগাভাগি করার জন্য সুসম্পর্ক গড়ে তোলা।
জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশে ধনী দেশগুলোর প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে। কারণ কম দায় থাকা সত্তেও বেশি ভোগান্তি সহ্য করছে দেশগুলো। কারণ এখনো পর্যন্ত সহায়তা হিসেবে যে অর্থ দেওয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অধীনে ধনী দেশগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে দেশগুলো।
একটি প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা
এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে সতর্কবার্তা যায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রকিবুল আলমের কাছে। তাকে বলা হয়েছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেখান থেকে পানি ঢুকে সুনামগঞ্জে বন্যা দেখা দিতে পারে।
এসময় রকিবুল আলমের কাজ ছিল স্থানীয় কৃষকদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমি থেকে যতটা সম্ভব ধান তুলে নিতে রাজি করানো। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা হলো কৃষকদের মনস্তত্ত্ব। এমনকি আকস্মিক বন্যা প্রবণ এলাকায়, কৃষকরা তাদের ক্ষুদ্র জমি থেকে যতটা সম্ভব ধান উৎপাদন করতে চায়।
জনাব আলম বলেন, 'সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়ার আশায় শস্য শতভাগ পাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় কৃষকরা।
উচ্চ পর্যায় থেকে সতর্কবার্তা পাওয়ার পর স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন রকিবুল আলম। কৃষক সংগঠনগুলোতে কল দেওয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবীরা ঘরে ঘরে গিয়ে সতর্ক করে আসে। ইমামরা মসজিদের মাইক দিয়ে সবার কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়। সবার কাছে বার্তা ছিল; আকস্মিক বন্যা আসতে পারে। ধান প্রায় প্রস্তুত হলে কেটে ফেলুন। স্বস্তির বিষয় হলো, কৃষকরা এই বার্তা শুনেছে। বিশ্রামহীন কাজ করে ২৫ এপ্রিলের আগেই তারা ফসল ঘরে তুলে ফেলে।
তবে সৌভাগ্যক্রমে এবার অত ভারি বৃষ্টিপাত হয়নি এবং আকস্মিক বন্যাও দেখা দেয়নি। ফসলও রক্ষা করা গেছে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের আগে উপকূলীয় এলাকায় এভাবে সতর্কতা জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এবার বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে এ পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে।
সরকার নদীতে ড্রেজিং ও সমুদ্রের পানি প্রবেশ বন্ধে বাঁধ নির্মাণের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা করছে। তবে এগুলোর অনেকগুলোই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সমালোচকরা বলছেন, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে সম্ভাবনায় পরিকল্পনাগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
ভাসমান বাগান ও লবণাক্ত পানি
গোপালগঞ্জের মতো নিম্নভূমিতে বছরের অর্ধেক সময় জমিগুলো পানির নিচে থাকে। এখানের কৃষকরা তাই ভাসমান বাগানে শাকসবজি চাষ করেন। বংশ পরম্পরায় তারা এই কৌশল শিখে আসছেন। ভাসমান বাগানের সুফল হলো, পানি বাড়তে থাকলে বাগান পানির সাথে সাথে উপরে উঠতে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গোপালগঞ্জের মতো বন্যার ঝুঁকি বাড়তে থাকায় অন্যান্য জেলাতেও এখন ভাসমান বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে সরকার ২৪ জেলায় ভাসমান বাগান তৈরিতে সহায়তা করেছে।
কৃষকরা প্রথমে জলাভূমিতে কচুরিপানা জড়ো করেন। ভাসমান বাগানের দৈর্ঘ্য সাধারণ লম্বা হয়। গ্রীষ্মকালে তরমুজ আর শীতকালে ফুলকপি, বাধাকপি কিংবা অন্যান্য মৌসুমি সবজি চাষ করেন কৃষকরা। যেগুলো তাদের পারিবারিক আয়ের উৎস। রাসায়নিক ছাড়া জন্মানো এসব শাকসবজি স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।
এছাড়া বৃষ্টি আগে আসুক বা পরে, এতে কোন প্রভাব পড়ে না। আর অতি তাপও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না ফসলে।
তবে এখানে একটি আশঙ্কা আছে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি উপকূলে ঢুকে পড়ছে। তার আংশিক কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের এবং জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি। আবার উজানে অনেক নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে মিঠা পানি নিচে কম প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিও বেশি বেশি ব্যবহার হচ্ছে। কৃষকরা লবণাক্ত পানির প্রভাবও দেখতে পেয়েছেন। যেমন পাতা লাল হয়ে যাচ্ছে কিংবা গাছ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
লবনাক্ততার ক্ষতিকারক দিক এখন সুন্দরবনেই বিদ্যমান। ঝড়ের প্রকোপ থেকে বাংলাদেশের রক্ষাকবচ বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এই বন। সুন্দরী গাছের নামে এই বনের নামকরণ। লবণাক্ত কাদা থেকেই এর শেকড় বের হয়। কিন্তু এখন এমন কিছু ঘটছে যা আগে কখনো চিন্তা করা হয়নি। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরী গাছ মারা যাচ্ছে। অন্যান্য ম্যানগ্রোভ প্রজাতি তার জায়গা নিচ্ছে। চিরদিনের জন্য সেখানের দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে।
সুন্দরবনের বন কর্মকর্তার ছেলে, বর্তমানের বনে পর্যটনের সাথে যুক্ত নজরুল ইসলাম বলেন, 'লবনাক্ততা না কমলে সুন্দরী ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি না, এবং লবণাক্ততা হ্রাসের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।'
বৃষ্টির পানি মজুদ
অনুমান করা হচ্ছে, উপকূলের কাছাকাছি বাস করা প্রায় ৩ কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত পানি প্রবেশের সমস্যায় ভুগছেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া এক এলাকায় বাস শিলা বিশ্বাসের। স্থানীয় খাল ও পুকুরগুলো লবন পানিতে ভরে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে তাকে। অথচ ৩০ বছর আগে যখন তার বিয়ে হয় তখন এমন অবস্থা ছিল না।
মূলত চিংড়ি চাষে ঝোঁক বাড়ার পর থেকে লবণাক্ত পানি বাড়তে থাকে। নদী থেকে খালে লবণাক্ত পানি নিয়ে আসেন চাষিরা। এভাবে লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ে। শিলা যে পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করতেন সেটিও এখন অতি লবণাক্ত। যা পান করা যায় না বা ঘরের কাজে ব্যবহার করা যায় না। প্রথমে তিনি পানি কেনার জন্য একটি গাড়ি ভাড়া করেন। তারপর তিনি পানি আনতে যেতেন এক প্রতিবেশীর কাছে, যিনি বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য একটি ট্যাংক বসান।
শিলা বিশ্বাসকে এখনো লবণাক্ত পানিতে গোসল করতে হয়। যা ত্বকের সমস্যা তৈরি করে। স্থানীয় অনেকেই একই সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, এখানের মানুষের উচ্চ রক্তচাপের হার বেশি। তাদের সন্দেহ, রোগীরা অনিচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত লবণ খেয়ে ফেলছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক গত তিন বছরে শিলা বিশ্বাসের মতো চার হাজার ভুক্তভোগিকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য দুই হাজার লিটারের প্লাস্টিক ট্যাংক সরবরাহ করেছে। যার উপরে একটি ফিল্টারও আছে।
এখন চিংড়ি চাষ কিছুটা কমে এসেছে। তবে লবণাক্ততা রয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে এবং অনেক সময় বাঁধ ভাঙন খুব বিপজ্জনক হয়ে পড়তে পারে।
আরও দক্ষিণাঞ্চলে, যেখানে শস্য রোপণের জন্য মাটি খুব লবণাক্ত, নারীরা কম্পোস্ট এবং সার দিয়ে ভরা পাত্রে সবজি চাষ শুরু করেছে। এভাবে মানুষজন জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য ২০২০ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়্। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ দ্রুত এবং নাটকীয়ভাবে কমানো না হলে আমরা যাই করি না কেন তা যথেষ্ট হবে না।