টাইটানিকে বেঁচে গিয়ে বিরূপ অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয় বিস্মৃত চীনা যাত্রীদের
১৯১২ সালে প্রথম সমুদ্রযাত্রাতেই ডুবে যায় আরএমএস টাইটানিক। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ৭০৬ জন। তাদের মধ্যে ছিলেন চীনের ছয়জন যাত্রী, উদ্ধারের পর যাদেরকে যেতে হয়েছে খুবই ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
যাত্রী তালিকা থেকে দেখা যায়, টাইটানিকে চীনা বংশোদ্ভুত যাত্রী ছিলেন আটজন । তাদের মধ্যে ছয়জন বেঁচে ছিলেন। তাদের নাম লি বিং, চ্যাং চিপ, চুং ফু, লিং হি, ফ্যাং ল্যাং এবং আহ লাম। তারা ছিলেন নাবিক এবং কাজের জন্য ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন।
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার সময় মাত্র ২০টি লাইফবোটে যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়। একটি লাইফবোট যখন বেঁচে থাকা লোকদের সন্ধান করছিল তখন ফ্যাং ল্যাংকে একটি ভাসমান কাঠের দরজায় পাওয়া যায়। তিনি বেঁচে থাকার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
ধারণা করা হয়, ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত চলচ্চিত্র টাইটানিক-এ রোজের (কেট উইন্সলেট অভিনীত চরিত্র) ভাসমান দরজায় বেঁচে থাকার দৃশ্য এই চীনা যাত্রীর ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত।
চীন বিরোধী মনোভাব
এলিস দ্বীপের অভিবাসন পরিদর্শন স্টেশনে পৌঁছানোর পর বেঁচে থাকা চীনা যাত্রীদের অবিলম্বে ফেরত পাঠানো হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্টকে। ১৮৮২ সালে প্রণীত এই ফেডারেল আইনের মাধ্যমে চীনা অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এই আইনটি মূলত ১০ বছরের জন্য অভিবাসনপ্রত্যাশী চীনাদের নিষিদ্ধ করার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়নি।
কেবল অবিলম্বে ফেরত পাঠানো হয়েছে এমন নয়, সেই সময়ে চীন বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির কারণে তারা গণমাধ্যমেও বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
দুর্ঘটনার পরে একটি প্রতিবেদন 'অ্যাংলো-স্যাক্সন নাবিকদের বীরত্ব' উত্থাপন করা হয়। সেখানে জীবিত চীনাদের 'প্রাণী' বলে সম্বোধন করে লেখা হয়, তারা লাইফবোটের আসনের নিচে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে গোপনে টাইটানিকে ওঠা এবং লাইফবোটে জায়গা সুরক্ষিত করার জন্য নারীদের পোশাক পরার মতো অভিযোগ তোলা হয়। তবে বিবিসি জানায়, ইতিহাসবিদেরা এসব অভিযোগের অনেকগুলোই মিথ্যা প্রমাণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পর কিছুদিন কিউবায় অবস্থান করেন তারা। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নাবিক সংকট দেখা দিলে তারা যুক্তরাজ্যে ফেরত যান। চ্যাং চিপ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং ১৯১৪ সালে মারা যান। বাকিরা যুদ্ধে অবদান রাখা সত্ত্বেও ১৯২০ সালে যুক্তরাজ্যের নিজেদের প্রিয়জন এবং অর্জিত সম্পদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর জীবিত থাকা বাকি যাত্রীদের মধ্যে অনেকে হংকং, ভারত, কানাডা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। তবে চীনা ছয়জনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জোরপূর্বক স্থানান্তর ও বিদেশি হিসেবে যে শত্রুতার মুখোমুখি হয়েছেন, তা শতবর্ষ ধরে বলা টাইটানিকের গল্পে কখনোই উঠে আসেনি।