জাপানে থাকা ভারতীয় বিপ্লবীদের সম্পর্কে যেমন ছিল ব্রিটিশ গুপ্তচরদের মূল্যায়ন
১৯১৬ সালে টোকিও স্কুল অভ ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ-এ হরিহরনাথ থুলাল অটলকে উর্দু শিক্ষক হিসেবে পাঠায় ভারতের ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ। ওই সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। তবে এক বছরের মধ্যে পাল্টে যায় দৃশ্যপট।
তখন টোকিওর ব্রিটিশ দূতাবাস ও ইয়োকামার কনস্যুলেট কর্তৃক নজরদারিতে থাকা 'ভারতীয় রাষ্ট্রদ্রোহীদের' একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। সেখানে ছিল অটলের নাম।
পি এবং কিউ নামে চিহ্নিত দুই ব্রিটিশ গুপ্তচর অটলকে নজরদারিতে রাখেন। তাদের দায়িত্বই ছিল জাপানে সম্ভাব্য ভারতীয় রাষ্ট্রদ্রোহীদের ওপর নজর রাখা।
ইয়োকোহামার ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল সিজে ডেভিডসন ১৯১৭ সালের ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে লেখেন, 'বিপ্লবীদের প্রতি এবং এ দেশে তাদের প্রচারণায় হিন্দুস্তানি ভাষা শিক্ষকের মনোভাব অসন্তোষজনক বলে উল্লেখ করেছেন এজেন্ট কিউ। তিনি কেশো রাম এবং বকশীর মতো ব্যক্তিদের সাথে ক্রমাগত মেলামেশা তো করছেনই, তার অভিব্যক্তি স্পষ্টতই ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নেতিবাচক। তার উপস্থিতিতে করা ওসব ব্যক্তির হিংসাত্মক কিংবা নৈরাজ্যবাদী বক্তব্যের প্রতিবাদও করেন না তিনি।'
তবে ব্রিটিশ নজরদারির প্রধান লক্ষ্য ছিলেন না অটল। এজেন্ট পি এবং কিউ-এর প্রাথমিক কাজ ছিল সন্দেহভাজন গদর বিপ্লবীদের কার্যকলাপ জেনে ব্রিটিশদের অবগত করা। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে এই গদর পার্টি গঠন করা হয়েছিল।
ভারতীয় বিপ্লবীরা
১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনে ভারতীয় প্রবাসীদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত গদর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সহিংস উপায়ে ব্রিটিশদের উৎখাত করা। প্রথমে তাদের কার্যকলাপ বেশিরভাগ উত্তর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আন্দোলনটি জাপানসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্র ও বিপ্লবীদের কলকাতায় পাঠানোর জন্য জাপানকে আদর্শ জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জাপানে থাকা অনেক লোককে ব্রিটিশরা গদর সদস্য বলে সন্দেহ করেছিল। ১৯১৭ সালে জাপান ও লন্ডনের ব্রিটিশ কূটনীতিকদের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠিতে দেখা যায়, নাথ দাস, কুরেশি, বকশী, জন কুরে এবং রাজ রত্নমসহ কয়েকজনকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্রিটিশ কূটনীতিকদের কাছে পাঠানো একটি গোপন চিঠিতে এজেন্ট পি তার মূল্যায়নে বকশী সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাকে 'খুবই ধূর্ত' এবং 'ব্রিটিশ সরকারের তিক্ত বিদ্বেষী' বলে উল্লেখ করে পি লিখেছেন, তিনি একজন গদর ভক্ত এবং গদর আন্দোলনকে আখ্যায়িত করেন 'ভারতের স্বাধীনতার প্রভু' হিসেবে।
এজেন্ট পি-এর মতে, বকশী কেবল ব্রিটিশদের জন্য হুমকি ছিলেন না। পি লেখেন, আমি মনে করি তার মতাদর্শ জাপানের জন্যও বিপজ্জনক। তিনি ধনীদের হত্যা করে তাদের সম্পদ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে যুবকদের প্ররোচিত করেন।
এজেন্ট পি কুরেশিকে একজন 'প্রভাবশালী' ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেন, যিনি ভারতীয়দের অস্ত্র সরবরাহ করতেন। এই এজেন্ট লেখেন, কুরেশি তার ছেলেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল, সে চায় তার ছেলে ভারতের জন্য জীবন দিক।
কুরে নামে একজনের কথা তুলে ধরেন গুপ্তচর পি। সিলন থেকে জাপানে এসে দীর্ঘদিন থাকা কুরে সাবলীলভাবে জাপানি ভাষা বলতে পারতেন। তিনি ভারতীয় বিপ্লবী এবং জাপানে যারা ভারতের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাদের মধ্যে দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন।
তারক নাথ দাস উত্তর আমেরিকায় যাওয়ার আগে ১৯০৫ সালে জাপানে বসবাস করতেন। এই বিপ্লবী ১৯১৬ সালে আবারও জাপানে ফিরে আসেন এবং ব্রিটিশরা তার ওপর নজর রাখা শুরু করে। চিঠিতে কনসাল জেনারেল ডেভিডসন লেখেন, এজেন্ট পি বিশ্বাস করে তারক দাসকে জাপান সরকার সুরক্ষা দিচ্ছে।
দাসের ইজ জাপান আ মেনেস ফর এশিয়া? বইটি প্রকাশের পর ব্রিটিশ কূটনীতিকরা আশঙ্কা করেন যে, এটি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জাপানে ব্যাপক সমর্থক তৈরি করবে।
বিপ্লবীদের মধ্যে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাজ রত্নম। ভারতের কোচিতে বড় হওয়া রত্ম দোভাষী কুরের সঙ্গে জাপানে বসবাস করতেন। রত্নম ১০ বছর ভারতের বাইরে ছিলেন। বেশিরভাগ সময় ছিলেন সিঙ্গাপুরে — সেখানে তিনি স্বাধীনতার জন্য আগ্রহী স্বদেশীদের সাথে দেখা করেছিলেন।
গুপ্তচর পি লেখেন, সিঙ্গাপুরে বিদ্রোহের গল্প বলার সময় রত্নম ইউরোপীয়দের হত্যাকে ভালো কাজ বলে মন্তব্য করেন।
সন্দেহজনক মিত্র
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ কূটনীতিকদের মধ্যকার চিঠিপত্র থেকে বোঝা যায়, বিপ্লবীরা জাপান সরকারের গোপন সমর্থন পাচ্ছে — এই ভয় তারা পেয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জাপান ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়াকে সমর্থন করার পরও কূটনীতিকদের গভীর সন্দেহ ছিল টোকিওর প্রতি। এ সময় জাপান এশিয়ার মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ছিল অগ্রগামী ছিল এবং ১৯০৪-০৫-এর যুদ্ধে রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে হারানোর পর ইউরোপীয় দেশগুলো জাপানকে সম্মানের চোখে দেখত।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপানের জয়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল অতিজাতীয়তাবাদী ও শক্তিশালী আমুর রিভার সোসাইটি। ব্ল্যাক ড্রাগন হিসেবে বেশি পরিচিত এই গোষ্ঠী ভারতীয়দের সমর্থন করেছিল। ব্ল্যাক ড্রাগনের প্রতিষ্ঠাতা তোয়ামা মিৎসুরু ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
এজেন্ট পি ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত। তিনি তোয়ামার বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে ১৮৯৯ সালে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওকুমা শিগেনোবু হত্যায় জড়িত তোয়ামার এক শিষ্যের তৈলচিত্র দেখতে পান পি।
এজেন্ট পি লেখেন, 'তিনি মন্তব্য করেছিলেন, কোনো খারাপ সরকারের মন্দ দিকগুলো একমাত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। কীভাবে নিজেদের সরকার গঠন করা যেতে পারে? এ বিষয়ে তোয়ামা বলেন, প্রথমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, ভারতকে স্বাধীন করতে হবে। এরপর সে অনুযায়ী যথাযথ কাজ কর হবে। বর্বররা দীর্ঘদিন টিকতে পারে না।'
ভারতীয়দের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো আটকানোর ক্ষেত্রে জাপান সরকারের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ছিল তোয়ামার। ১৯১৭ সালের এপ্রিলে ব্রিটিশ কূটনীতিকের কাছে পাঠানো চিঠিতে এজেন্ট পি উল্লেখ করেন, কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া জাপানের সব কর্তৃপক্ষেরই ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে। এ সমর্থন দিন দিন বাড়ছে।
অনেকে জাপান সরকারকে ব্রিটিশদের সঙ্গে মিত্রতা পূনর্বিবেচনারও পরামর্শ দেন। ১৯১৭ সালে সাংহাইয়ের সেন্ট জনস ইউনিভার্সিটির আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক সুং সুং ফং একটি নিবন্ধে ব্রিটেনের সঙ্গে জাপানের জোটকে 'সবচেয়ে বড় ভুল' বলে অভিহিত করেন। এই নিবন্ধটি টোকিওর ব্রিটিশ দূতাবাসে সংরক্ষিত আছে। নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান সফরকালের দেওয়া এক উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: 'ইউরোপীয় দেশগুলো পৃথক সত্তা হলেও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা এক। অ-ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ কোনো মহাদেশের মতো নয় বরং একক দেশের মতো। যদি মঙ্গোলিয়ানরা ইউরোপের এক টুকরো ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেয়, ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের প্রতিহত করার জন্য এক হয়ে লড়তে কোনো না কোনো কারণ খুঁজে নেবে।'
নিরাপদ আশ্রয়
জাপানে ব্রিটিশদের অন্যতম প্রধান ভারতীয় লক্ষ্যবস্তু ছিলেন রাসবিহারী বসু। তিনি ১৯১৫ সালে গদর ষড়যন্ত্রের প্রধান সংগঠক ছিলেন। তার পরিকল্পনা ছিল, ব্রিটিশদের উৎখাত করতে ভারতীয় সেনাদের মধ্যে সর্বভারতীয় বিদ্রোহ জাগিয়ে তোলা। বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়, কিন্তু বসু জাপানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখানে ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটির সুরক্ষায় ছিলেন তিনি।
বসু সেখানে পিএন ঠাকুর পরিচয়ে থাকতেন। ব্রিটিশরা তাকে ধরে ভারতে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। ১৯১৭ সালে পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়, ব্রিটিশ গুপ্তচর এবং কূটনীতিকরা তার প্রতিটি পদক্ষেপে নজরদারি করত।
ডেভিডসন একটি চিঠিতে বসু সম্পর্কে লিখেছেন, এই ভারতীয়র সাথে তিন জাপানি নারী বসবাস করছেন। একজনকে তার উপপত্নী হিসেবে মনে হচ্ছে, একজন তার বোন হতে পারে আর আরেকজন তাদের সেবিকা। নারীদের মধ্যে একজনের নাম তামুরা মাসা। আর বাসা তার নামে ভাড়া নেওয়া। ইচ্ছাকৃতভাবে নেমপ্লেটে মাসার বিপরীতে মাসামি লেখার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে কোনো নারী নয়, একজন পুরুষ এই বাড়ির মালিক।'
ডেভিডসন লেখেন, বাড়িটি নির্জন স্থানে ছিল। কোনো ব্যবসায়ীকে বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো না। নারীরাই বাজার থেকে শুরু করে বাহিরের সব কাজ করতেন।
গদর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হও্রয়ার পর এর সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করা হলে বসু জাপানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি'র মূল সদস্যদের একজন ছিলেন। ততদিনে অবশ্য ভারতে হাওয়া বদলাতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মহাত্মা গান্ধী জনসাধারণকে একত্রিত করতে সক্ষম হন এবং স্বাধীনতার জন্য অহিংস আন্দোলন শুরু করেন। স্বাধীনতার জন্য ভারতে তখন গান্ধীবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৭ সালের নথি থেকে জানা যায়, ব্রিটিশরা হরিহরনাথ থুলাল অটলকে ভারতে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল। সে বছর মার্চে ভারতের ভাইসরয় ফ্রেডেরিক থিসিগারকে লেখা চিঠিতে জাপানের রাষ্ট্রদূত কনিংহাম গ্রিন লিখেছেন, 'দূতাবাস পরিদর্শনের সময় অটল তার আনুগত্য জারি রাখার, স্বদেশীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব রাখার এবং বিপ্লব থেকে তাদের দূরে রাখার প্রচেষ্টার কথা ব্যক্ত করেছেন।'
সেখানে আরও বলা হয়, অটল কখনো অন্য কোন ভারতীয় সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেননি। তবে এজেন্ট পি একজন বিপ্লবী বলে ধারণা ছিল তার।
গুপ্তচরেরা ব্রিটিশ দূতাবাসকে জানিয়েছিল, অটল জাপানের নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যেখানে ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটি তাকে সাহায্য করতে পারত। অটল ১৯২১ সালের ১৪ জুন টোকিওতে আত্মহত্যা করেন বলে জানা যায়। তার জীবন ছিল পি-এর মতোই — রহস্যময়!