জামিল’স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস: সুপারহিরোদের আশ্চর্য জগৎ!
আশি বা নব্বইয়ের দশকে যাদের বেড়ে ওঠা তাদের শৈশব কেমন ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেলাম নানা ধরনের উত্তর। সেসময় কারো কাছে শৈশব ছিল প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠার আনন্দ। কারো কাছে খোলা মাঠে ছুটে বেড়ানোর উল্লাস। আবার কারো কাছে শৈশবের অর্থ দুপুরে তড়িঘড়ি করে ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কমিকস পড়া; স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে নতুন নতুন কমিকসের বই কেনা। সে যুগে কোনো স্মার্টফোনের নেশা ছিল না। বরং যারা নিয়মিত কমিকস পড়তো, তাদের মধ্যে ছিল নতুন নতুন কমিকস পড়ার নেশা।
কমিকসের সাগরে বুঁদ হয়ে থাকা এমনই একজন মানুষ ছিলেন একেএম আলমগীর খান ওরফে জামিল। বেড়ে ওঠা আশির দশকে হওয়ায় জীবনের অনেকটা জুড়েই ছিলো কমিকসের আনাগোণা। সেই ভালোবাসা থেকেই ২০১০ সালে তৈরি করেন কমিকস বইয়ের স্টোর। নিজের ডাকনাম জামিল অনুসারে স্টোরের নাম দেন 'জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস'। যেখানে হাত বাড়ালেই খুঁজে পাওয়া যাবে আমেরিকান কমিকসের সুবিশাল ভাণ্ডার।
জামিল নিজে যেভাবে বড় হয়েছেন, চেয়েছিলেন সেই স্মৃতি তার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে। ২০০৮ সালে মেয়ের জন্মের পর নিজের রঙিন শৈশবের রঙে মেয়েকেও রাঙিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সুপারহিরোর কমিকসের আবহে বড় হওয়া জামিল তাই শখের বশেই শুরু করেন আমেরিকান কমিকসকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ক্যাপ্টেন মার্ভেল কিংবা ডক্টর স্ট্রেঞ্জ- কমিকসের দুনিয়ার চরিত্রগুলোকে মানুষের সামনে এনে দিতেই নিয়েছেন এমন উদ্যোগ।
২০১০ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস-এর। সুপারহিরোর কমিকস দিয়ে শুরু করেছিলেন পথচলা। সাথে অবশ্য আর্চি-সহ আরো কিছু কমিকসও ছিল। ২০০৯ সাল থেকেই জামিল শুরু করেছিলেন প্রস্তুতি। দফায় দফায় আমেরিকার কমিকসের হোলসেলারদের সাথে আলোচনার পর ২০১০ সালে উন্মোচন করেন জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস-এর দ্বার।
রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ইউএই মৈত্রী কমপ্লেক্সের ৩য় তলায় জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস-এর অবস্থান। দৈর্ঘ্য প্রস্থের হিসাবে স্টোরের আকার খুব বেশি বড় না হলেও নানা রকমের আমেরিকান সুপারহিরো কমিকস ও সুপারহিরোদের ফিগারে ঠাসা স্টোরটি যেকোনো কমিকসপ্রেমীর মন ভালো করতে সক্ষম।
আমেরিকান কমিকসের কথা উঠলেই ডিসি ও মারভেলের কথা সর্বাগ্রে উঠে আসে। ডিসি কমিকস আমেরিকা অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন কমিক বই কোম্পানি। ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি যুগের পর যুগ কমিকসপ্রেমীদের মনে স্থান দখল করে রেখেছে। মারভেল কমিকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। স্ট্যান লি, জ্যাক কার্বি সহ অনেক বিখ্যাত শিল্পী যুক্ত ছিলেন মারভেল কমিকসের সাথে।
আইডল সুপারহিরো যখন কমিকসের স্টোরে
জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস-এ সুপারহিরোকেন্দ্রিক কমিকসই বেশি পাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকেই জামিলের সুপারহিরোর প্রতি দুর্বলতা থাকায় স্টোরেও সুপারহিরোর চরিত্ররাই ঠাঁই পেয়েছে বেশি।
সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান, ওয়াচম্যানসহ ডিসি কমিকস এবং স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান, ওলভেরাইন, ক্যাপ্টেন আমেরিকা সহ মারভেল কমিকসের বিভিন্ন চরিত্রকেও এখানে খুঁজলে পাওয়া যাবে। ডিসি ও মারভেল ছাড়া অনেকসময় জাপানিজ কমিকস মাঙ্গাও এখানে পাওয়া যায়। তবে আসল কভারের মাঙ্গার দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এবং দেশীয় প্রিন্টের মাঙ্গা সহজলভ্য হওয়ায় জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলসে মাঙ্গার চাহিদা তুলনামূলক কম বলেই জানান জামিল।
সরাসরি আমেরিকা থেকেই কমিকস বই নিয়ে আসেন জামিল। জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস- কে ব্যবসা বলতে নারাজ তিনি। এটিকে শখের কাতারেই রাখতে চান। আমেরিকা থেকে প্রত্যেক শিপমেন্টে যে পরিমাণ কমিকস আসে, তার বেশকিছু অংশ প্রথমে নিজের সংগ্রহে রাখেন জামিল। বাকি অংশ নিয়ে রাখেন স্টোরে। প্রত্যেক বছর ২ থেকে ৩টি শিপমেন্টে বই আসে আমেরিকা থেকে।
শখের বশে কমিকসের স্টোর খোলায় মুনাফা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান না জামিল। জামিলের কাছে এই কমিকস স্টোরটি একটি ফুলের মতো, যার সুবাস তিনি বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান।
২০০৯ সালে যখন প্রথম আমেরিকা থেকে কমিকসের বই আমদানি করেছিলেন, তখন ২ লাখ কমিকস বইয়ের জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিলেন তিনি। ২ লাখ কমিকস আনার জন্য বেশ ভালো পরিমাণ মুলধনই সে যাত্রায় রাখতে হয়েছিলো। প্রথম দফার বই ২০১০ সালের শুরুতে এসে পৌঁছায়। এরপর থেকেই শুরু হয় নিয়মিতভাবে বই আসা। বর্তমানে প্রতি শিপমেন্টে ১০০০ থেকে ৩০০০টির মতো বই আসে। নির্দিষ্ট পরিমাণে বই আসলেও প্রথম দফায় আসা অনেক বই এখনো জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস- এর সংগ্রহশালায় রয়ে গেছে।
গ্রাহকের পছন্দ- করে না দামের তোয়াক্কা!
কিশোর বয়স থেকে শুরু করে ৩০ থেকে ৪০ এর কোঠায় বয়স যাদের- তারাই মূলত জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস- এর গ্রাহক। তবে দুটি শ্রেণীর গ্রাহকের বয়সভেদে পছন্দের তালিকা ভিন্ন। জামিল বলেন, 'গত ১০/১৫ বছরের মধ্যে সুপারহিরোকেন্দ্রিক মুভি এবং টিভি শো এর জন্য একটি নতুন ফ্যানবেস তৈরি হয়েছে। ওরাও আমাদের এখানে আসে। তাছাড়া যারা মাঙ্গার অরজিনাল প্রিন্ট নিতে চায় তারাও আসে।'
সুপারহিরো কমিকসের মধ্যে ব্যাটম্যান ও স্পাইডারম্যান বিষয়ক কমিকস গ্রাহকদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে। তাছাড়া জাস্টিস লিগ, ফ্ল্যাশও অনেকের পছন্দের তালিকায় আছে। এগুলো ছাড়া ক্ল্যাসিক কমিকসও অনেক গ্রাহকের পছন্দ। গ্রাহকের পছন্দকে সবসময় গুরুত্ব দেন জামিল। তাই কম থেকে বেশি, সবরকম দামের কমিকস পাওয়া যায় জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস-এ। এখানে আমেরিকান কমিকসের দাম ১২০ টাকা থেকে শুরু হয়। অধিকাংশ কমিকসের দাম এমনই থাকে। ১ ডলার থেকে ৪০ ডলার দামের কমিকসই এখানে বেশি পাওয়া যায়। ট্রেড পেপারব্যাক, সফট কভার ও হার্ডকভারের বই এখানে পাওয়া যায়।
তবে ডলারের দামের ওঠানামার সাথে শিপমেন্ট অনুযায়ী দামেরও কিছুটা হেরফের হয়। জামিল বলেন, 'আমরা পার ডলার আগে চার্জ করতাম ১০০ টাকা। নতুন শিপমেন্টে বেড়ে হবে ১১৫ টাকা। একইভাবে ২০ ডলারের একটি কমিকের দাম পড়বে ২৩০০ টাকা। এভাবে বিভিন্ন ভ্যারাইটির কমিক আমাদের স্টোরে আছে।'
আমেরিকায় সাধারণত নতুন কোনো কমিকসের সিরিজ বের হওয়ার আগে প্রথম ইস্যু প্রচারণার উদ্দেশ্যে প্রমোশনাল দামেই বাজারে ছাড়া হয়। সেই কমিকসগুলো প্রমোশনাল দামে ১/২ ডলারে পাওয়া যায়। এই সুযোগটি নেন জামিল। দাম কিছুটা সহজলভ্য হওয়ায় এই দামের কমিকসেরই গ্রাহক বেশি থাকে।
দেখা মেলে শৌখিন ক্রেতারও!
জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস- এ অনেক শৌখিন ক্রেতা আছেন, যারা অপেক্ষাকৃত ভালো কভারের বই কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন সবসময়ই। সাধারণত সফট কভার ও হার্ড কভার বইয়ের দাম ভিন্ন হয়। জামিল বলেন, 'আমি প্রথমদিকে সবসময় সফট কভারের বই আনতাম। যেহেতু এটা সস্তা। তখন দেখলাম কিছু কাস্টমার আমাকে অনুরোধ করেছে যে ২৫ ডলারের হার্ড কভারের বই আনার জন্য।'
কমিকস বইয়ের ভেতরের অংশ যেহেতু একই, তাই বেশি দাম দিয়ে কিনে হার্ড কভারের বই মানুষ পড়বে কি না এটা নিয়েও কিছুটা সন্দিহান ছিলেন জামিল। তাই প্রাথমিকভাবে গ্রাহকদের পছন্দ যাচাইয়ের জন্য ৫-৬ টি হার্ড কভারের বই এনে দোকানে রাখেন। কিন্তু গ্রাহকেরা জামিলকে এক্ষেত্রে চমকে দেন। হার্ড কভারের কমিকসের বই ২/৩ দিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। এবার জামিলের মনে কিছুটা বল আসে। ভালো কভারের বইয়ের চাহিদাও যে আমাদের এখানে আছে, সেটা বুঝতে পারেন তিনি।
জামিল বলেন, 'এরপর কিছু কাস্টমার আমাকে অনুরোধ করা শুরু করে হার্ড কভারের চাইতেও ভালো যে এডিশন বের হয়, এবসলিউট এডিশন, সেটা আনার জন্য। এবসলিউট এডিশনের দাম তখন ছিলো ১০০ ডলার, এখন এর দাম ১২৫ ডলার। এই বইগুলো নরমাল কমিক বইয়ের তুলনায় আকারে বেশ বড়। পেপার কোয়ালিটি ও প্রিন্টিং কোয়ালিটিও খুব সুন্দর। এটাও প্রতি শিপমেন্টে ২/১ জন অর্ডার দেওয়া শুরু করে।'
যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যে তারা মূলত একটু বেশি দামের কমিকস কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
হারিয়ে যাচ্ছে ছোটবেলার কমিকস
জামিলের ভাষ্যে, আমেরিকার কমিকসের অনেকাংশ সুপারহিরোর কমিকস হিসেবেই পরিচিত। আর্চি কমিকস এখনো প্রকাশিত হলেও, তাদের মার্কেট শেয়ার অনেক ছোট বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ছোটবেলায় পড়া অনেক কমিকসের বই এখন চাইলেও পাওয়া যায় না, এমন আক্ষেপও জামিলের রয়েছে। তিনি বলেন, 'ছোটবেলায় অনেক ভ্যারাইটির কমিকস আমি পড়তাম। সেগুলো এখন প্রকাশিতই হয় না। ছোটদের জন্য যে মজার মজার কমিকসগুলো ছিল যেমন: রিচি রিচ, স্যাড স্যাক, ক্যাসপার- এমন বেশকিছু কমিকস আগে ছিলো, যেগুলো এখন প্রকাশিতই হয় না।'
একই কথা তিনি ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডকে কেন্দ্র করেও বলেন। মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, গুফি, উইনি দ্য পুহ প্রভৃতি চরিত্রগুলো ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের নিজস্ব ছিলো। যেগুলো নিয়ে কমিক তৈরির কাজও অনেককাল আগে বন্ধ হয়ে গেছে। জামিল বলেন, 'ডিজনি এখন মারভেলের স্বত্বাধিকারী। কিন্তু ডিজনির নিজস্ব যেসব চরিত্র সেগুলো নিয়েও কমিকস বের হয় না।'
নতুন প্রজন্মের মধ্যে কমিকস পড়ার আগ্রহ কিছুটা কমে গেছে বলে জানান জামিল। তার মতে, এখনকার ইয়ং জেনারেশন কমিকসের পরিবর্তে অন্যান্য জায়গায় বেশি খরচ করে। জামিল বলেন, 'আমাদের মার্কেটে ইন্টারেস্টেড ফ্যানবেস অনেক বড় কিন্তু রিয়েল কাস্টমারের বেস অতটা বড় না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।'
বর্তমানে জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস- এর অনলাইন পেজটি জামিল নিজেই দেখাশোনা করেন। অনলাইন পেজ ছাড়াও জামিলকে সাহায্য করার জন্য আরো দুজন রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে পড়াশোনা করা জামিল বর্তমানে কমিক স্টোরের পাশাপশি একটি সিরামিক কোম্পানির কনসাল্টিং ডিরেক্টর হিসেবে যুক্ত আছেন। তাছাড়া ডেলটা সিএনজি নামে একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনও তার রয়েছে।
'জামিল'স কমিকস অ্যান্ড কালেক্টিবলস' স্টোরের নতুন কোনো শাখা খোলার পরিকল্পনা আপাতত নেই। বনানীতে অবস্থানরত শাখা নিয়েই কাজ করে যেতে চান অবিরত।