বিশ্বজুড়ে দাপটে রাজত্ব করা আমেরিকান কমিক্সকে যেভাবে হটিয়ে দিল জাপানিজ মাঙ্গা!
আমেরিকার কমিক্স এবং গ্রাফিক উপন্যাস ভক্তদের কারণে এখন দুটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল আছে কমিক্স দুনিয়াতে। এর একটি হলো 'ওয়েস্টার্ন কমিক্স' (বিশেষত ডিসি কমিক্স এবং মার্ভেল কমিক্স)। আর আরেকটি জাপানিজ মাঙ্গার' বিশাল দুনিয়া।
মাঙ্গা মূলত কমিক্সেরই জাপানিজ সংস্করণ। তবে এর রয়েছে বিশেষ চিত্রশৈলী; যা মাঙ্গাকে দিয়েছে অনন্য এক রূপ। কয়েক দশক ধরে জাপানের 'মাঙ্গা' এবং 'কমিক্স' কে সমান সমান হিসেবে ধরা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাঙ্গা বিক্রয় এবং সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতার দিক থেকে টেক্কা দিয়েছে কমিক্সকে।
এমনকি পাশ্চাত্যে (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে) কয়েক বছর ধরে কমিক্স মূলধারার বিনোদন হিসেবে প্রচলিত থাকলেও মাঙ্গা দখল করে নিয়েছে সেই জায়গা। একই ধরনের গল্প এবং দামসহ বেশকিছু কারণে কমিক্সকে 'মাঙ্গা' থেকে নিচে রাখা হয় এখন।
'অ্যাকশন ফিগার' এবং 'মার্ভেলের সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স' এর জনপ্রিয়তাও এখন নিম্নগামী। প্রতিটি ভোক্তার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকায় ঠিক কী কারণে 'মাঙ্গা' বনাম 'কমিক্স' যুদ্ধে এগিয়ে আছে মাঙ্গা তা বলা মুশকিল। তবে 'মাঙ্গা' যে তার দর্শকদের জন্য 'কমিক্স' থেকে ভালো কিছু উপহার দিচ্ছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
মাঙ্গা এবং কমিক্সের এই দ্বন্দ্ব শুরু হয় ৮০'র দশকের আমেরিকায় জাপানিজ মাঙ্গা প্রবেশ করলে। তবে ২০০০ সালের দিকে মূল জনপ্রিয়তা পায় মাঙ্গা। এর মধ্য দিয়েই আমেরিকার 'পপ কালচারে' প্রবেশ করে 'অ্যানিমে' এবং 'মাঙ্গা'।
'ডেমন স্লেয়ার', 'জুজুতসু কাইশেন', 'ওয়ান পিস' 'মাই হিরো একাডেমিয়া'র মতো আরো অনেক অ্যানিমে নিয়মিত উঠে আসে 'বেস্ট সেলার' তালিকায়। পাবলিশার্স উইকলির মতে, ২০২২ সালে বিক্রিত সকল ধরনের কমিক্সের মধ্যে মাঙ্গা প্রায় ৪৬ শতাংশ। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অসংখ্য শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়লেও মাঙ্গা এবং অ্যানিমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি বাঁচিয়ে রেখেছিল এই শিল্পকে।
বিজনেস ইনসাইডারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে কমিক্স বিক্রিতে রেকর্ড করেছিল প্রতিষ্ঠানগুলো৷ ২.০৭৫ বিলিয়ন ডলারের এই রেকর্ড পরিমাণ উপার্জনের মধ্যে ১.৪৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে 'মাঙ্গা' থেকে। ২০২১ সালের 'বেস্ট সেলিং' মাঙ্গা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল 'অ্যাটাক অন টাইটান'। অন্যদিকে মূলধারার কমিক উপার্জন করেছিল মাত্র ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্য দিয়ে মাঙ্গার জনপ্রিয়তা আরও স্পষ্ট হয়।
হিসাবের খাতায় মাঙ্গা এবং কমিক্স যুদ্ধে জয়ী মাঙ্গা। তবে একটা বড় কারণ হিসাবে মূল্য এবং প্রাপ্যতাকে ধরে নেয়া যেতে পারে। ২২ পাতার একটি কমিক বইয়ের দাম ৫ ডলার এবং ১০০ পাতার গ্রাফিক উপন্যাস বা সমগ্রের মূল্য ১০ ডলার। দামের দিক থেকে যেকোনো ক্রেতার কাছে মাঙ্গা এগিয়ে থাকবে। মাঙ্গার 'সাদা কালো' পাতা 'রঙিন'' কমিক বইকে পেছনে ফেলে দেয়। মাঙ্গার এই ব্যাপক জয়ের পেছনে আরও একটি কারণ হিসেবে এর সহজলভ্যতা।
কমিক বই সাধারণত এক ধরনের বিশেষ 'শৌখিন' বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়। 'গিকি' হিসেবে পরিচিত এসব দোকানগুলোতে দেখা পাওয়া যায় নির্দিষ্ট ধরনের ক্রেতাদের। কমিক বইয়ের দোকানগুলোতে সাধারণত পুরুষ কিংবা বাচ্চাদের বেশি দেখা যায় বলে ধারণা রয়েছে। অ্যানিমে জগতে কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকলেও, 'মাঙ্গা' হয়ে উঠেছে সার্বজনীন।
'বার্ন্স এন্ড নোবেল' এর মতো জনপ্রিয় বইয়ের দোকানগুলোতে অরায় সবসময়ই চোখে পড়বে মাঙ্গা বইগুলো। শুধু নির্দিষ্ট কোন কমিক বইয়ের ভক্ত না হলেও যেকোনো বইপ্রেমীর কাছেই প্রিয় হয়ে উঠবে পেপার ব্যাক বা হার্ড ব্যাক কভারের এই মাঙ্গা বইগুলো।
তবে মাঙ্গা পড়তে গেলে ছোটখাটো যে সমস্যায় পড়তে হয় তার মধ্যে একটি হলো মাঙ্গার গল্পগুলো কমিক্সের তুলনায় বেশ ধীর গতিতে এগোয়। মাসিক ভিত্তিতে বেরোনো কমিক্সের বিপরীতে জাপানে মাঙ্গা প্রকাশিত হয় প্রতি সপ্তাহে। এ কথা মাথায় রেখেই গল্পের গতিবিধি কিংবা এর কাহিনি আবর্তিত হয়।
যেকোনো মাঙ্গা একটি সোজা গল্প বা কাহিনিকে অবলম্বন করে এগোতে থাকে। প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড এবং তৃতীয় খণ্ডের বইগুলো পূর্বের গল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই চলতে থাকে।
অপরদিকে কমিক্সের গল্পগুলোতে 'রিবুটেড ইউনিভার্স', 'অল্টারনেট ইউনিভার্স' এবং নতুন কাহিনি যুক্ত হয়ে বেশ জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যা নতুন পাঠকদের জন্য কমিক্স শুরুর আগেই বেশ ভীতিকর এবং দুর্বোধ্য অবস্থায় ফেলে দেয়। মাঙ্গা এদিক থেকে পাঠকদের বিভ্রান্তিতে ফেলে না।
'ড্রাগন বল'' বা 'মোবাইল সুইট গুন্ডাম' ব্যতিক্রম হলেও 'স্পন' বা 'ওয়ান্ডার ওম্যান' এর মতো গল্পের এত শাখা প্রশাখা সাধারণত মাঙ্গাতে দেখা যায় না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে দলগত কমিক্সগুলোর গল্পের বিস্তৃতি তো বলাই বাহুল্য।
মাঙ্গার কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তুতে প্রাসঙ্গিকতা এবং সহজগম্যতা এর জনপ্রিয়তার অন্যতম আরেকটি কারণ হতে পারে। এর বিপরীতে 'সুপার হিরো' কিংবা মারদাঙ্গা চরিত্র পছন্দ করে এমন ব্যক্তিরাই কমিক্স ভক্ত হয়ে থাকে। তবে সম্প্রতি কমিক্সগুলো 'বৈচিত্র্যময়' শিল্পীদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসছে এবং একইসাথে তারা নতুন করে তাদের পাঠক নির্বাচন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।
৯০ দশক থেকে ২০১০' দশকের শেষ দিকে 'ইন্ডি কমিক্সের' বেশ জনপ্রিয়তা দেখা গেলেও তা মূলধারার কমিক্সের সাথে টক্কর দিতে পারেনি। মাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিতেও আছে নিজস্ব কিছু সমস্যা। কিন্তু ভিন্ন ধারা এবং গল্পের মধ্য দিয়ে মাঙ্গা ও অ্যানিমে তাদের এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠবে বলে ধরে নেয়া যায়।
একেবারে নিবেদিত ভক্তরাই ডিসি বা মার্ভেলের একই গল্পের 'বিবুটের' পেছনে এতো সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে চাইবে। অন্যদিকে, প্রাত্যহিক জীবন, রোমান্স এবং মানুষের জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক বা কমেডি ঘরানার মাঙ্গা যে কাউকেই আকৃষ্ট করবে।
মাঙ্গারও রয়েছে অ্যাকশন ঘরানার বেশ কিছু সিরিজ। 'সোনেন জাম্প', 'ভ্যাগাবন্ড' এবং 'বার্সার্ক', অ্যাকশনধর্মী এই মাঙ্গা সাধারণত ছোটদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। সকল বয়স এবং চাহিদা অনুযায়ী মাঙ্গার রয়েছে বিশাল ভক্তকুল। সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছতে পারা, যেকোনো বইয়ের দোকানে দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা এবং সঠিক মূল্য মাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। তাই বলা যেতেই পারে, মাঙ্গা এবং কমিক্স যুদ্ধে, নিশ্চিতভাবেই মাঙ্গা বিজয়ী।
অনুবাদ: জেনিফার এহসান