এখনও কি সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ হয়!
এবার ঈদের কাপড় বানাতে গিয়ে দর্জি হাফিজ মিয়াঁর কথা মনে হচ্ছিল অনেকবার। এই দর্জির কথা পড়েছিলাম পারিতোষ সেনের 'জিন্দাবাহার' বইটিতে। তিনি নাকি জামার মাপ না নিয়ে, কাস্টমারকে একবার দেখেই নিখুঁত পোশাক বানিয়ে দিতে পারতেন।
অথচ, হাফিজ মিয়াঁর সময় যন্ত্রপাতি বলতেও কিছু ছিল না তেমন। নীল চক, কাঁচি আর সুঁই- সুতো। তখন তো আর সেলাই মেশিন আসেনি। পোশাকের এত চাহিদাও ছিল না, এত সহজলভ্যতাও ছিল না। ছিল না রেডিমেড পোশাকের চল। কামিজ বলি, শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফ্রক, পায়জামা যাই বলি, সব কাপড়ই হাতে বানানো হতো। দর্জির কাছে মাপ নিয়ে জেনে নিতে হতো কোন কাপড়ে কতটুকু কাপড় লাগবে। এরপর সে অনুযায়ী বাজার থেকে কাপড় এনে দর্জির কাছে দেওয়া হতো। বাসায় মায়েরাও কাজের ফাঁকে এই সেলাই নিয়ে বসতেন। ছেলেবুড়োর জন্য কাপড় বানিয়ে দিতেন।
রুচি প্রকাশ পেত বাড়ির নারীদের সুচিশিল্পের মাধ্যমে
একটা সময় ছিল যখন এদেশে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত নির্বিশেষে অধিকাংশ পরিবারেই ঘরে সেলাইয়ের চল ছিল। সেলাই বা বুননের কাজ পারে না এমন পরিবার কমই ছিল। এ নিয়ে গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, 'আমি যখন ছোটো ছিলাম, এমন বাড়ি খুব কমই দেখেছি, যাদের বাসায় সিঙ্গার সেলাই মেশিন ছিল না।'
যেকারণে পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমাতেও সেলাই মেশিনের উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের শাবানাকে তো আমরা সেলাই মেশিনে দেখেই অভ্যস্ত। আবার সত্যজিৎ রায়ের 'মহানগর' ছায়াছবিতে দেখা যায়, নায়িকা মাধবী মুখার্জি একটি নিটিং মেশিনের কোম্পানিতে সেলস গার্লের চাকরি করছেন।
এছাড়া কোনো বাড়ির রুচি প্রকাশ পেত বাড়ির নারীদের সুচিশিল্পের মাধ্যমে। বিভিন্ন কাপড়ে রঙিন সুতোয় ফুল লতাপাতার ছবি আঁকতেন বাড়ির গৃহিণীরা। দৈনন্দিন পোষাক থেকে শুরু করে, গৃহসজ্জার প্রধান উপকরণ (যেমন-ওয়ালম্যাট, রুমাল, কুশন, পর্দা) সবেতেই ছিল নানাধরণের সুচিশিল্প। 'চারুলতা' সিনেমায় চারুলতাকে দেখা যায়, নিপুণ সুঁই আর রঙবেরঙের সুতোর গুঁতোয় রুমালে ফুটিয়ে তুলছেন নকশা। এছাড়া ছিল কুশিকাটার লেস বোনা, উল বোনা। সেলাই দেখেই বাড়ির গৃহিণীর রুচির পরিচয় যেমন পাওয়া যেতো। তেমন, বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ করতেও রেওয়াজ ছিল রান্না ও গানের পাশাপাশি সেলাইয়ের নমুনা দেখা। যা আমরা এ যুগের শিলাদিত্য মৌলিকের ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা 'সোয়েটার' এ-ও দেখি।
পোশাকের ব্যাপারে পরিমিতিবোধ নেই
সেলাই বা সুচিশিল্পের সে যুগ আমরা পার করে এসেছি। এখন সেলাই জানা মানেই অনেকে ভেবে বসেন, গার্মেন্টস কর্মী! একবিংশ শতাব্দীতে পোশাকের যে বাজার তৈরি হয়েছে, তাতে এরকমটা ভাবা ভুলও না। কেননা নতুন প্রজন্মের কাছে সেলাই মানেই 'ওল্ড ফ্যাশন' আর 'প্রয়োজন পড়ে না' ধরনের কাজ। কেনই বা দরকার হবে, যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি কাপড় উৎপাদন হচ্ছে!
আসলে আমরা এখন বিশ্বাস করি, এক কাপড় বেশিদিন পড়া যায় না। আগে ঈদে একটি জামা হলেই হতো, আর এখন ঈদ মানেই বেলায় বেলায় জামা বদলানো। আবার, আগে উল দিয়ে সোয়েটার বানিয়ে দিতেন নানী-দাদী, মায়েরা। এই সোয়েটারগুলো বানানো হতো বংশপরম্পরায় পরার কথা মাথায় রেখেই। একজন মাত্র এক বছর পরবে এমন চিন্তা করে বোনা হতো না। একটু বড় মাপের সোয়েটার বানানো হতো, যেন দু-তিন বছর পর লম্বায় বাড়লেও সোয়েটারটা পরা যায়। সেই সোয়েটার ছোট হয়ে গেলে ছোট ভাইবোনরা আবার পরতে পারে।
পোশাকের ব্যাপারে পরিমিতিবোধের এই ধারণাটা এখন আর নেই। চাইলেই সামর্থ্যের মধ্যে পোশাক কেনা যায় এখন। আবার এক-দু'বছর পর সেগুলো বাতিলও করা যায়। অনলাইনে একটা মেসেজেই এখন ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে পছন্দের জামাটি।
এই সহজলভ্যতা, সেইসাথে জীবনের ব্যস্ততা দুটোই আসলে নারীদের সুই-সুতো থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সুচিশিল্প বা কাপড় বানানো দূরে থাক, সামান্য সেলাই বা বোতাম লাগানোর মতো টুকটাক কাজগুলোও এখনকার অনেক মেয়েই পারে না। যেমন পারেন না সুরমা ও তার বান্ধবী। দু'জনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। গাউসিয়ায় কাপড়ের জন্য লেস কিনতে এসেছিলেন। সেলাই পারেন কি-না জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, তারা তো সেলাই পারেনই না, তাদের মায়েরাও পারেনা। নিজেদের সময় হয়ে ওঠে না। আর কখনো ইচ্ছেও জাগেনি।
জিজ্ঞেস করা হয়, কোনোকিছু ছিঁড়ে গেলে বা ছুটে গেলে কী করা হয়। হেসে জানান, টুকটাক সেলাইয়ের কাজ থাকলে, একসাথে অনেকগুলো জমিয়ে সেগুলোও দর্জিদের কাছে দিয়ে আসেন। খরচও তো বেশি না।
বোতাম লাগাতেও দৌড়াতে হয় দর্জির কাছে
এবার আসি দর্জিদের কথায়। কয়েক বছর আগেও ঈদের আগে দম ফেলার সুযোগ পেতেন না দর্জিরা। জামা তৈরি করে সময়মতো কাস্টমারদের হাতে তুলে দেওয়াই ছিল তখন চ্যালেঞ্জের বিষয়। রেডিমেড পোশাকের চেয়ে নিজস্ব ডিজাইন ও পছন্দের কাপড়ে পোশাক তৈরি করতে পছন্দ করতেন অনেকে। কিন্তু করোনার পর এ স্রোতে ভাটা পড়ে। অনলাইনে কিংবা শপিংমলে গিয়ে হালফ্যাশনের রেডিমেড পোশাক কেনাই এখন নতুন প্রজন্মের কাছে ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে কথা হয় গাউসিয়া মার্কেটের অজন্তা টেইলার্সের মোহাম্মদ মাসুদের সাথে। ২০ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি এখানে। তিনি জানান, আগে যে অর্ডার আসতো, তার তিনভাগের দুইভাগ এখন আসে। এক ভাগ নাই। রেডিমেড কাপড়ের দিকে ঝুঁকছে অনেকেই। অনেকে আবার বাসার কাছেই কোনো দর্জির কাছে জামা বানাচ্ছে। এত জ্যাম ঠেলে আসতে চায় না।
তবে এখন দৈনন্দিন কাপড়ের চেয়ে অনুষ্ঠানে পরার জামা, বিয়ের শাড়ি, ব্লাউজ, লেহেঙ্গার অর্ডার আসে বলে জানান মাসুদ।
অন্যদিকে গলির ভিতরের টেইলার্সগুলোতে বড় কাজ থেকে একবারে ছোটো কাজের অর্ডারও আসে বলে জানান স্থানীয় দর্জিরা। জামাকাপড় তো বটেই, অনেক সময় নাকি ছেঁড়া, বোতাম লাগানো এরকম টুকটাক কাজও পান তারা।
অথচ এ কাজগুলো আগে ঘরেই করতেন নারীরা। ছিঁড়ে যাওয়ার পরও রিপু বা তালি দিয়ে আরও অনেক বছর চালাতেন।
চাইলেই পোশাকের আয়ু বাঁচানো যায়
আবার এখন একটি পোশাক মেরামতে যে খরচ তার চেয়ে সেটা বাতিল করে নতুন কেনার দিকেই আগ্রহ বেশি। ছিঁড়ে গেলে তো বটেই, এখন একটি কাপড়ের বয়স বেশিদিন হলেই তা আর পরতে ইচ্ছে হয় না। আবার, চলতি ফ্যাশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে না চললে বা কেবল ইচ্ছে হয় না বলেও ফেলে দিই অনেক পোশাক। তবে ব্যতিক্রম আছে। এমন একজন হলেন অনুরাধা সাহা রায়। এ যুগের মেয়ে হয়েও সেলাই করতে ভালোবাসেন। অবসর সময়ে ইউটিউব দেখে দেখে অনেক ফোঁড় শিখেছেন। নিজের মাকে একটা জামার হাতায় কাজ করে দিয়েছেন। দু'দিন আগেই পুরোনো জিন্স দিয়ে একটা স্কার্ট বানানোর কাজ শুরু করেছিলেন, নিজের ছেলের জন্য কাঁথাও বানানো শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততায় কাজগুলো আটকে আছে।
অনুরাধার মতো অনেকেই একটি কাপড় একবার ব্যবহার করে ফেলে না দিয়ে তাকে আর কিভাবে ব্যবহার করা যায় তা খুঁজে বের করেন। শাড়ি কেটে জামা, পাঞ্জাবি, কাঁথা বানানো এগুলো তো হয়েই থাকে। আবার কয়েকটি পুরোনো কাপড় কেচে শুকিয়ে লুসনি, ব্যাগ, টেবিল ম্যাট, পাপোষ প্রভৃতি বানানো যায়। জামা মাঝ দিয়ে কেটে কোটি বানানো যায়। বা শাড়ির আঁচল দিয়ে তৈরি করা যায় ব্লাউজ। এভাবে একটি পোশাককে ভিন্ন রূপে ব্যবহার করা যায়, যা একটি কাপড়ের স্থায়িত্ব এবং বিবিধ ব্যবহার এনে দেয়।
আবার ছিড়ে গেলে রিপু ছাড়াও নতুন বা আলাদা কাপড় নিয়ে ছেঁড়া অংশের সাথে জুড়ে দিয়ে এমনভাবে সেলাই করা যেতে পারে, যেন সেটা ঠিক জোড়াতালি মনে না হয়। বরং পুরো কাপড়টির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন নকশা এনে দেওয়া যায়।
কাপড়ের সাথে জড়িত আবেগ, মমতা, ভালোবাসা
কাপড়কে কিভাবে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সে নিয়ে অভিজ্ঞতা জানান পেশায় চিকিৎসক, জান্নাত ইসলাম (২৯)। তিনি বলেন, 'ছোটোবেলায় আমি আমার খালা, মায়ের শীতকালীন সোয়েটার, ফেলালুনের ফ্রক পরতাম। আর আমার ভাই আমার মামাদের সোয়েটার পরতো। এখনো আমি নানুবাড়ি গেলে প্রায়ই নানুর পুরোনো ট্রাংক ঘাটাঘাটি করি। নানুর অনেক শাড়ি, শাল এখন আবার ট্রেন্ডি হয়ে উঠছে।'
আসলে খেয়াল করে দেখব, পুরোনো দিনের ফ্যাশনগুলো বারবারই ফিরে আসে। দাদী, নানী বা দাদা, মামাদের টেকসই কাপড়্গুলো যদি যত্ন করে রেখে দেওয়া যায়, অনেক সময়ই দেখব, সেই কাপড়ের ডিজাইনগুলো আবার ফিরে এসেছে। তখন পূর্বসূরীদের কাপড়গুলো আবার ব্যবহার করা যায়।
তবে সেই কাপড় কি শুধুই ফ্যাশনের পুনরাবৃত্তির জন্য পরা হয়? এর উত্তরে নিজ মতামত জানান দীপান্বিতা সাহা। যিনি পেশায় একজন উন্নয়নকর্মী। তিনি জানান, কাপড়ের সাথে আবেগ, মমতা, ভালোবাসাও জড়িত। দীপান্বিতার বিয়ের দশ বছর হলো। প্রথমবার জন্মদিনে শ্বাশুড়ি নিজের একটি শাড়িই উপহার করেছিলেন দীপান্বিতাকে। এরপর আরও অনেক নতুন নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু দীপান্বিতার ঐ প্রথম শাড়িটিই সবচেয়ে প্রিয়। তিনি বলেন, 'আমার খুব ভালো লাগে বড়দের পুরোনো শাড়ি পরতে। কেমন একটা মায়া মায়া গন্ধ থাকে শাড়িগুলোতে।'
সেলাই এখন সেকেলে
আমরা বর্তমানে এমন একটা বিশ্বে বাস করছি, যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি পোশাক উৎপাদন করা হয়। ফলে এক পোশাকে যেন বেশিদিন মন টিকছেনা আমাদের! কেনার কিছুদিন পরেই পোশাকগুলোর জায়গা হচ্ছে ফেলনার ঝুড়িতে। এভাবেই পোশাকের গড় আয়ুকাল কমছে তো কমছেই। বিশ্বও একটু একটু পরিণত হচ্ছে ফ্যাশন বর্জ্যের ভাগাড়ে। আমরা ঢুকে পড়েছি সীমাহীন পোশাকের বাজারে।
তাই যেখানে নাগালের মধ্যেই অজস্র কাপড় পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এই সেলাইয়ের কোনো বাজারমূল্য নেই। এছাড়া সেলাই এককালে নারীমনে যে শখের জায়গাটি নিয়েছিল তা এখন 'ওল্ড ফ্যাশন' এবং পুরোপুরি 'মেয়েদের কাজ' বলে পরিচিত। যেকারণে, ছেলেরাও আগ্রহী নয় তেমন। তবে কি নতুন প্রজন্ম সৃজনশীল কাজ করছে না? করছে শখ থেকে তারা অনেককিছুই করছে। নিত্যনতুন উদ্ভাবন দিয়ে প্রতিভাবান, সৃজনশীল, মেধাবী হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। কিন্তু সেলাই যেন একটু সেকেলেই রয়ে গেছে।