ভারত ও নেপালের সীমান্তবাসী যেভাবে বন্যপ্রাণী-মানুষের সংঘাত ঠেকাতে একসাথে কাজ করছে
দক্ষিণ-পূর্ব নেপালে ভারত সীমান্তঘেঁষা একটি জেলা ঝাপা। এ জেলার বাহুদাঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা শঙ্কর লুইতেল। বছর পাঁচেক আগে প্রতি মাসেই কিছুদিন তাকে কাটাতে হতো বন বিভাগের স্থানীয় অফিসগুলোয়। বন্য হাতির আক্রমণে কেউ আহত বা নিহত হলে, কারো ফসল বা সম্পদের ক্ষতি হলে – গ্রামবাসীদের সরকারি ক্ষতিপূরণ পেতে তিনিই সহায়তা করতেন।
না, আজো পরহিতেই সময় দেন শঙ্কর। তবে আগের মতো ততোটা সময় আর দিতে হয় না তাকে। ভাবতে পারেন, সরকারি ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া তাহলে হয়তো আগের চেয়ে দ্রুত বা সহজ হয়েছে। তা অবশ্য নয়। এখনও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের সুপারিশ ও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে এই প্রক্রিয়া। যেকারণে আগে ছয় মাস থেকে এক বছরও লাগতো ক্ষতিপূরণের টাকা আসতে।
এখন সময়টা কম লাগছে ভিন্ন কারণে। আসলে ভারত ও নেপালের সীমান্তের উভয় প্রান্তেই আছেন শঙ্করের মতো স্বেচ্ছাসেবীরা। কার্যকর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন তারা, যার তৎপরতায় মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাতের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে বাহুদাঙ্গি গ্রামবাসীকেও এই সমস্যায় আগের মতো ততোটা পড়তে হয় না। সংঘাত কমায়, কমেছে বন দপ্তরে ফাইলের চাপ। আর সেটাই স্বস্তির কারণ।
নেপালের বাহুদাঙ্গির অপরপাশেই ভারতের কোলাবাড়ি জঙ্গল। এই অঞ্চলের প্রায় এক ডজন স্বেচ্ছাসেবী মিলে ২০১৮ সালে গড়ে তোলেন 'বন্য হাতির চলাচল ব্যবস্থাপনা দল'। শঙ্কর এই টিমেরই অন্যতম একজন সদস্য। বন্য হাতির পাল যেন মানুষকে আক্রমণ না করে, আবার মানুষও যেন পাল্টা-প্রতিশোধ নিতে হাতিদের ওপর চড়াও না হয় – সেদিকে খেয়াল রাখে এই টিম।
মহানন্দা নদীর একটি উৎস- ভারত ও নেপালের আন্তঃসীমান্ত মেছি নদী। দুই ভূখণ্ডের সীমানাও এ নদী। শঙ্কর বলেন, প্রায় প্রতিদিন সকালেই হাতির পায়ের ছাপ পড়েছে কিনা দেখতে আমি মেছি নদী পাড়ে যাই। ছাপ থাকলে বোঝা যায়, রাতের আঁধারে নদী পেরিয়ে কোনো বুনো হাতি নেপালে ঢুকেছে। আবার পায়ের ছাপ দেখতে গোধূলি লগ্নের আগে সন্ধ্যেবেলা নেপাল ও ভারতের অন্য সহকর্মীদের সাথে যাই কোলাবাড়ি জঙ্গলে।
এই অঞ্চলটি আসলে হাতিদের চলাচলের প্রাকৃতিক করিডর। সীমান্তের দুই পাশের আবাসস্থলে এদিক দিয়েই যাতায়াত করে অন্তত ১০০টি বুনোহাতি। করিডরের অধিকাংশ এলাকায় বনভূমি, তবে ভারতীয় অংশে বেড়ার ঘের দেওয়া কিছু চা-বাগানও আছে। ভারতীয় অংশে মানুষের উপস্থিতি কম। ফলে বুনোহাতি- মানুষের সংঘাত তেমন নেই। অন্যদিকে, নেপালের অংশে কৃষিজমি ও মানব বসতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় হাতিদের। তাই এখানে সংঘাতের ঘটনাও বেশি।
বন্ধুত্ব ও সহযোগিতারও মাধ্যম
নেপাল সীমান্তের ওদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়ি জেলা। এ জেলার পাঁচজন স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকারকর্মীর সাথে কাজ করেন শঙ্কর। তাদেরই একজন হচ্ছেন ঋত্বিক বিশ্বাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই ছাত্র থাকেন নক্সালবাড়ি গ্রামে।
ভারত সীমান্তের এপাড়ে হাতিদের গতিবিধির ওপর নজর রাখেন ঋত্বিক। তিনি বলেন, "সীমান্তের উভয় পাড়ে (ভারত ও নেপাল) আমরা মোট ১০ জন আছি। সবাই একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত। এছাড়া, আমাদের সাথে আছেন স্থানীয় সরকারের জনাকয়েক কর্মকর্তা, স্থানীয় সমাজপতিসহ সংশ্লিষ্ট আরো ১৫ অংশীজন। যখনই আমরা হাতির চলাচল লক্ষ করি, তার ছবি বা ভিডিও গ্রুপে পোস্ট করি। তখন সীমান্তের অপর পাড়ে থাকা নেপালি গ্রুপ মেম্বাররা তাদের গ্রামবাসীকে হাতিদের আসার কথা জানাতে পারে। গ্রামবাসীও তখন সময়মতো তাদের সম্পদ সরিয়ে নিতে বা পাহারা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে।"
ঋত্বিক মনে করে, নেপালি ও ভারতীয়দের মধ্যে এক সুসম্পর্কের বন্ধন গড়ে দিচ্ছে এই সহযোগিতা। তৈরি হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টা, যার সুফল ভারতীয় পক্ষও পায়। "নিয়মিত নাহলেও, মাঝেমধ্যে নেপাল থেকে আমাদের এদিকে হাতি এসে তাণ্ডব করে যায়। তাই এখানকার স্থানীয়দের জন্যেও এই সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।"
মানুষ ও হাতির সংঘাত এড়াতে বহুমুখী পদক্ষেপ
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত কমাতে কাজ করায় অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশি ভারী শঙ্কর লুইটেলের। ২০১৮ সালে তার হাতেই সংঘবদ্ধ দল গড়ে ওঠে এবিষয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে। তাদের মূল কাজ তথ্য আদান-প্রদান এবং সতর্কতা সৃষ্টি।
তবে কার্যক্রম দেখলে বোঝা যাবে এই দুটি কাজই নানান উপায়ে করে গ্রুপ সদস্যরা। শঙ্কর বলেন, "এ কাজগুলো বহুমুখীভাবে করা হয়। হাতির আক্রমণ থেকে নিজেদের এবং সহায়-সম্পত্তি কীভাবে রক্ষা করতে হয়– আমরা স্কুলের শিশুদের সেই শিক্ষা দেই। কেন হাতিদের ওপর পাল্টা-আঘাত করাও অন্যায়, সেটাও বোঝাই ওদের। আবার গ্রামের কোনো সড়ক নির্মাণ বা পানির ব্যবস্থা করা নিয়ে যখন কোনো বৈঠক হয়, সেখানেও আমরা বন্য হাতিদের আন্তঃসীমান্ত চলাচলের ঝুঁকি ও রক্ষার উপায় সম্পর্কে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়াটাও আমাদের দায়িত্ব।"
নেপালের এই অঞ্চল থেকে বেশ দূরে যেসব এনজিও কাজ করে, এখন তাদের কাছেও সাড়া জাগিয়েছে এই উদ্যোগ। সহযোগিতা দিচ্ছে তারাও। যেমন বেশ দূরের বারিদিয়া এলাকার কিছু এনজিও সহায়তা দিচ্ছে।
শঙ্কর জানান, "উজায়লো নেপাল (বারিদিয়া-ভিত্তিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা) একটি সাইরেন ব্যবস্থা পরিচালনায় সাহায্য করছে, সীমান্ত চৌকির কাছাকাছি অবস্থিত আর্মড পুলিশ ফোর্সের স্টেশনগুলোর সাহায্যে আমরা এটি পরিচালনা করছি। যখনই আমরা কোনো হাতি দেখি, তাদেরকে জানাই। সীমান্ত কর্মীরা তখন সাইরেন বাজিয়ে আশেপাশের এলাকার মানুষকে সতর্ক করে দেয়। আবার একটি মোবাইল অ্যাপে ম্যাসেজ পাঠিয়েও স্থানীয়দের সতর্ক করা হয়।"
সাইরেনের শব্দ লোকালয় থেকে হাতিদের দূরে রাখে। এই হট্টগোল তারা এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করে। তবে হাতি চলাচলের করিডরের সম্পূর্ণ এলাকায় নেই সাইরেন ব্যবস্থা। তাই অন্যান্য মানব বসতির এলাকায় ট্রাক্টর চালান স্বেচ্ছাসেবকরা। ট্রাক্টরের জোরালো শব্দের কারণেও দূরে থাকে হাতিরা।
বাহুদাঙ্গি গ্রাম পড়েছে মেছিনগর পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের আওতায়। ওয়ার্ড কমিটি মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত এড়াতে আগামী অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ নেপালি রুপি বা ১৫ হাজার ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। এই টাকায় স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপটির ট্রাক্টরের জ্বালানি কেনা হবে বলে জানান ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান অর্জুন কার্কি।
তিনি আরো জানান, স্থানীয় সরকার দ্রুত সাড়া দিতে পারে এমন একটি টিম গঠন করেছে। এর সদস্য ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী। এরা কোনো সংঘাতের ঘটনার সময় মূল ভলান্টিয়ারদের সহায়তা করবেন। দলের সদস্যদের সরঞ্জাম হিসেবে রয়েছে মেগাফোন ও মশাল। আন্তঃসীমান্ত ভলান্টিয়ারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন তারা।
বাঘের আক্রমণ ঠেকাতেও আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা
ভারত-নেপাল সীমান্তে বন্যপ্রাণী ও মানুষের মধ্যে সংঘাতের আরেকটা জায়গা খাতা টাইগার করিডর। এই করিডর দিয়ে দক্ষিণপশ্চিম নেপালের বারদিয়া জাতীয় উদ্যান এবং ভারতের কাতারনিয়াঘাট অভয়ারণ্যের মধ্যে বাঘেরা চলাচল করে।
ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার তরাই ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রধান অনিল কুমার বলেন, "বাঘ বা চিতাবাঘ দেখলেই মানুষজনের আতঙ্কিত হয়ে সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা কীভাবে প্রতিহত করা যায়, তা আমরা সীমান্তে বসবাসকারী নেপালিদের জানাচ্ছি। বিনিময়ে নেপালের বারদিয়ার অধিবাসীরা আমাদের বন্যপ্রাণী রক্ষার টহলে সাহায্য করছে। এতে প্রাণীগুলোকে রক্ষার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে।"
তিনি জানান, নেপালি স্বেচ্ছাসেবীরা ক্যামেরার ফাঁদ পাততে সাহায্য করছে তার সংস্থাকে। এতে এই করিডর দিয়ে চলাচলকারী বাঘগুলোর আচার-আচরণ আরো ভালোভাবে বোঝার সুযোগ পাচ্ছেন তারা। "নতুন করে স্থাপিত ক্যামেরাগুলোর কল্যাণে, এই বছরের এপ্রিলে আমরা মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দুটি বাঘের শাবককে তাদের মায়ের কাছেও ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।"
বারদিয়ায় বাঘ চোরাশিকার প্রতিরোধে গড়ে উঠেছে একটি যুব সংঘ। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন অনীল। স্থানীয় বাসিন্দাদের এই উদ্যোগে জড়িত প্রায় ৩,৩০০ জন। এমনটাই জানান স্থানীয় সমাজপতি হেমন্ত প্রসাদ আচার্য।
তিনি বলেন, "আমরা চোরাশিকার নিয়ন্ত্রণে বেশি গুরুত্ব দেই। কিন্তু, বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের সংঘাতের ঘটনা বাড়তে থাকায়– নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন সীমান্তের অন্য পাশের সহযোগী সংস্থার সাথে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছি।"
হেমন্ত প্রসাদ আরো জানান, বাঘের আন্তঃসীমান্ত চলাচলের তথ্য বিনিময় করতে ভারতীয় সংস্থাগুলোর সদস্যদের সঙ্গে প্রায়ই সাক্ষাৎ করেন তার টিমের সদস্যরা। যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপেও করা হয়।
"একত্রে কাজ করে আমরা স্থানীয়দের বেড়া ও দেওয়াল স্থাপন করতে বলি তাদের বাড়ি ও ক্ষেতখামারের চারপাশে। এছাড়া, প্রয়োজনে কীভাবে সরকারি ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে সেসম্পর্কেও আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি।"
নেপালের জাতীয় উদ্যান ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা (ডিএনপিডব্লিউসি)-র মহাপরিচালক মহেশ্বর ঢাকাল জানান, স্থানীয়-পর্যায়ের এই অংশীদারত্ব খুবই সহায়ক বলে দেখতে পারছেন নেপালের বন কর্মকর্তারা। এই প্রক্রিয়া বেগবান করতে এখন তারাও উদ্যোগ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, "পার্সা, চিতওয়ান ও শুক্লাফান্থা জাতীয় উদ্যানের কর্মীরা স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিবেশী ভারতের স্থানীয়দের সাথে একত্রে কাজ করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রাথমিক যে সাফল্য পাওয়া গেছে, তাতে আমরা খুবই আশাবাদী।"