দুর্দান্ত, লাক্সারি সব বাস সড়কে, কিন্তু যাত্রীসেবা? কী বলেন বাস লাভাররা
'দেশে ভালো মানের বাস টার্মিনাল কেবল সিলেটেই আছে। চট্টগ্রামের মতো মহানগরীতেও নেই। একটা পেট্রল পাম্প ধরে আশপাশে দাঁড়িয়ে গেলেই তৈরি হয় টার্মিনাল। অথচ স্বীকার করতে হয়, বাংলাদেশের রাস্তায় যত ভালো মানের বাস চলে, তা ভারতেও চলে না। পাকিস্তান বা নেপালে তো নয়ই,' বলছিলেন ফজলে রাব্বী। তিনি পেশায় কনস্ট্রাকশন ফার্মের অংশীদার কিন্তু নেশায় বাস লাভার।
বিডি বাস লাভার গ্রুপের অ্যাডমিন ফজলে রাব্বী। মনে করিয়ে দিলেন, দেশে একসময় যাত্রীসেবার মান আরও ভালো ছিল। অনেকের মনে পড়বে, কিছু গাড়িতে বডি মাসাজ সুবিধা ছিল। কিছু গাড়িতে পড়ার জন্য সাময়িকী থাকত, অনেক গাড়িতে একাধিক দৈনিক পত্রিকা পাওয়া যেত, ড্রিংকস ও স্ন্যাকস দেওয়া হতো। এখন গাড়ির বাইরেটা উন্নত হয়েছে কিন্তু ভেতরের অবস্থা দায়সারা।
বেসরকারি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি গত দুই-আড়াই দশকে অনেক বেড়েছে, রুট সংখ্যা বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। এখন দেশের প্রায় সব উপজেলা, বড় হাট-বাজারে অবধি নামী কোম্পানিগুলো যাত্রীসেবা দিয়ে থাকে। এজন্য সড়ক প্রশস্ত হওয়া, নতুন নতুন সড়ক তৈরি হওয়ার অবদান রয়েছে। দেশে এখন জাতীয় মহাসড়ক ৬৬টি, আঞ্চলিক ১২১টি আর জেলা সড়ক ৬৩৩টি।
১৯৭২ সালে শুরু
সোহাগ পরিবহনের প্রতিষ্ঠা ১৯৭২ সালে। বেডফোর্ড কোম্পানীর বাস দিয়ে যাত্রী পরিবহন শুরু সোহাগের। ঢাকা-খুলনা ছিল রুট। ইউনুস তালুকদার তার বড় ছেলে সোহাগের নামে এর নাম রেখেছিলেন।
আশির দশকে দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গেও সোহাগ যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ১৯৯৩ সালে তাদের বহরে যুক্ত হয় হিনো ১৭২। তখন বাসটিতে কিচেন, স্মোকিং জোন ছিল। বাসের ক্রুদের নেমট্যাগ ছিল, ম্যাগাজিন ও চকলেট সরবরাহ করা হতো যাত্রীদের। প্রতি যাত্রীর নিজের পছন্দমতো হেডফোন দিয়ে গান শোনার ব্যবস্থা ছিল।
সোহাগ প্রথম লাক্সারিয়াস বাস সুইডিশ ভলভো নিয়ে আসে ২০০৪ সালে। একসঙ্গে ৪০টি ভলভো যুক্ত হয়েছিল তাদের বহরে। সোহাগ ক্লাসিক রাখা হয়েছিল নাম। এগুলোর সিট ছিল সোফার মতো, বাটন পুশ করে সিটের অবস্থান পরিবর্তন করার সুযোগ ছিল। বিজনেস ক্লাসের প্রতি সিটের সঙ্গে একটি সবুজ ও একটি সাদা বাটন ছিল। সবুজটি দিয়ে সিট ভাইব্রেট করা যেত আর হোয়াইট বাটন দিয়ে চালানো যেত পার্সোনাল স্ক্রিন মনিটর প্যানেল।
২০১০ সাল পর্যন্ত সোহাগের ভলভো সেবা নিয়মিত ছিল। ২০১১ সালে সোহাগ নতুন চমক নিয়ে হাজির হয়। আরেক সুইডিশ কোম্পানি স্ক্যানিয়ার বাই এক্সেল বাস দিয়ে সেবা দেওয়া শুরু করে সোহাগ। এগুলোর ছিল বাহারি পেইন্ট, সোহাগ প্রিমিয়াম নাম চলত, এখন এলিট নাম দিয়ে চলে।
২০১৬ সালে স্ক্যানিয়ার মাল্টিএক্সেল বাস যুক্ত হয় সোহাগ বহরে। মোটমাট ৪৩টি স্ক্যানিয়া আছে এখন সোহাগের। এর নন-এসি বহরে আছে ১১০টির বেশি বাস। এর মধ্যে ২১টি অশোক লেল্যান্ড আর বাকিগুলো হিনো একেওয়ানজে।
ঢাকা-মাগুরা-যশোর-খুলনা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-বেনাপোল, ঢাকা-সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম-বেনাপোল, চট্টগ্রাম-খুলনা ইত্যাদি সোহাগের উল্লেখযোগ্য রুট।
স্কুটার বিক্রি করে বাস
সোহাগের প্রায় সমসাময়িক আরেকটি পরিবহন সংস্থা শ্যামলী। ১৯৭৩ সালে রামেন্দ্রনাথ ঘোষ নিজের স্কুটারটি বিক্রি করে একটি বাস কেনেন। রাজশাহী-নগরবাড়ি রুটে প্রথম যাত্রীসেবা দেওয়া শুরু করে শ্যামলী। পরে ১৯৭৯ সালে ঢাকা-পাবনা রুট দিয়ে আন্তঃজেলা যাত্রী পরিবহনে নাম লেখায়।
প্রায় ১,০০০টি এসি/নন-এসি বাস আছে শ্যামলীর বহরে। ৪০টি জেলায় যাত্রী পরিবহন করে শ্যামলী। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা, আগরতলা, শিলিগুড়ি, শিলং ও গৌহাটিতে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করে শ্যামলী। এখন এটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম পরিবহন সংস্থা। শ্যামলীর বহরে হিনো আরএম২, হুন্দাই, স্ক্যানিয়া, টাটা আছে।
গ্রিনলাইন মানে লাক্সারি
ফজলে রাব্বী জানান, যদিও সোহাগ বা শ্যামলীর মতো প্রাচীন নয় কিন্তু এটা মানতে হবে বাংলাদেশে লাক্সারি কোচের টেস্ট প্রথম দেয় গ্রিন লাইন। ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হিনো এসি বাস দিয়ে। সড়কপথে এসি বাস পরিশেবা চালু করার কৃতিত্ব গ্রিনলাইনকে দেওয়া হয়।
গ্রিন লাইন ভলভো আনে ২০০৩ সালে। আর তার দুই বছর পরেই স্ক্যানিয়া বাস আমদানি করে। ২০১৩ সালে স্লিপার কোচ পরিষেবা দেওয়াও শুরু করে। জার্মানি থেকে মান কোম্পানির ডাবল ডেকার বাস তারা আমদানি করে ২০১৮ সালে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, টেকনাফ, খুলনা, বেনাপোল ও রাজশাহী রুটে এবং চট্টগ্রাম থেকে সিলেট ও বেনাপোল যাত্রী পরিবহন করে গ্রিনলাইন।
ফজলে রাব্বী বলেন, 'গ্রিন লাইন আগাগোড়াই তাদের মান ধরে রেখেছে। গেল ৩৩ বছরে তারা বড় কোনো বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি আর যাত্রীসেবায় আপসও করেনি। সোহাগের মতোই তাদেরও বাঁধা যাত্রী আছে, যারা গ্রিনলাইনে ভ্রমণে স্বচ্ছন্দ, তা ভাড়া যতই হোক।'
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুট দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট। একটা সময় ছিল যখন নাইট টু নাইট গাড়ি চলত, দিনের বেলা চলত না বলাই ভালো। এখন ঐতিহ্যবাহী ও নামী কোম্পানিগুলো পরস্পরের সঙ্গে নিয়মিত পাল্লা দিচ্ছে। হিনো তো আছেই, হুন্দাই, স্ক্যানিয়াও অনেক পরিবহনেরই শোভা বর্ধন করে চলেছে।
এ রুটের হেভিওয়েট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সোহাগ, শ্যামলী, গ্রিনলাইন ছাড়াও আছে সৌদিয়া, এস আলম, ইউনিক, হানিফ, সেন্ট মার্টিন পরিবহন ইত্যাদি। আরও আছে এনা, লন্ডন এক্সপ্রেস, রিলাক্স পরিবহন, সিল্প লাইন।
ফজলে রাব্বীর ধারণা, দিনরাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৪০ হাজার গাড়ি চলাচল করে। এর মধ্যে যাত্রীবাহী গাড়ির সংখ্যা ১৫-২০ হাজার। সড়কটি ৪ লেনে উন্নীত করা হলেও যাত্রার সময় কিন্তু সেভাবে কমেনি। এর বড় কারণ গাড়িগুলোর স্টপেজ সংখ্যা। শুধু চট্টগ্রাম শহরেই কোনো কোনো পরিবহনের ৩০-৪০টি কাউন্টার। শহর পেরোতেই গাড়িগুলোর ১ ঘণ্টার বেশি চলে যায়। সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব মোটে ২৪৮ কিলোমিটার। ৩ ঘণ্টা সময়ে এটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারলে সড়ক প্রশস্ত করাটা কার্যকরী ফল আনতে পারত, কিন্তু লেগে যায় ৫-৬ ঘণ্টা।
উত্তরের চলাচল
এবার আসা যাক দেশের উত্তরাঞ্চলের যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থার কথায়। হানিফ পরিবহনকে বলা হয় উত্তরবঙ্গের রাজা আর শ্যামলীকে রানি। ছোট ছেলে হানিফের নামেই জয়নাল আবেদীন গড়ে তুলেছিলেন হানিফ এন্টারপ্রাইজ।
একটি ট্রাক নিয়ে শুরু হয়েছিল সাভারের জয়নাল মহাজনের পথচলা। এটা ছিল তেমন সময় যখন দূরপাল্লার রাস্তাও বেশি ছিল না, পরিবহন সংস্থাও ছিল হাতেগোনা।
ধান-চালের ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন ট্রাক কিনেছিলেন মাটি ফেলার কাজ করতে গিয়ে। স্বাধীনতার কিছু পরের কথা। সংসদ ভবন আর মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় ছিল ধানের খেত। সেখানে সাব-কন্ট্রাক্টে মাটি ফেলার কাজ করতে থাকলেন জয়নাল। এ কাজের প্রয়োজনেই তিন-টনি একটি ট্রাক কিনতে হলো। কয়েকটি ট্রাক ভাড়াও নিলেন।
ঠিকাদার মাটি ফেলার জন্য অগ্রিম হিসাবে বেশ ভালো পরিমাণে টাকা দিয়েছিলেন জয়নালকে। তা দিয়েই দুটি হিনো কোচ কিনে হানিফ এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠা করলেন। ঢাকা-বগুড়া ছিল প্রথম রুট।
সে ধারাবাহিকতায় এখন হানিফ পরিবহনে বাসের সংখ্যা হাজারের বেশি। তাদের বহরে আছে হিনো একেওয়ানজে, মিৎসুবিশি ফুসো, হিনো আরএমটু, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আইশার, অশোক লিল্যান্ড, ভলভো মাল্টি ইত্যাদি।
ফজলে রাব্বী বললেন, 'হানিফ পরিবহনের কথা না বললে বাংলাদেশের পরিবহন সেবার কথা অসমাপ্তই থেকে যায়। তবে উত্তরের রুটে বেশি জনপ্রিয় ধরা হয় নাবিল ও এসআর পরিবহনকে। আরও আছে শাহ আলী পরিবহন। প্রথমবারের মতো উত্তরবঙ্গে স্লিপার বাস যুক্ত হয় তাদের মারফত। হিনো আরএমটু, হুন্দাইসহ অনেকগুলো নন-এসি বাস আছে তাদের বহরে। ঢাকা-রংপুর-লালমনিরহাট-বুড়িমারি, ঢাকা-কুড়িগ্রাম-চিলমারি-ভুরুঙ্গামারি ইত্যাদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ রুট। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটেও তারা যাত্রীসেবা দিয়ে থাকে।'
এদিকে ঢাকা-গাইবান্ধা রুটের অভিজাত অপারেটর আল হামরা। সেবা দিয়ে আসছে ১৯৮০ সাল থেকে। প্রথম বাস হিসাবে যমুনা সেতু অতিক্রম করার গৌরব অধিকার করেছে আল হামরা। তাদের বহরে হিনোর ৫ ইউনিট এয়ারকন্ডিশন্ড কোচ ও ১৬ ইউনিট নন-এসি কোচ আছে।
আগমনী এক্সপ্রেসও রংপুর রুটের পুরনো অপারেটর। দীর্ঘদিন শুধু হিনো এসি কোচ দিয়েই সার্ভিস দিয়েছে আগমনী। তাদের বহরে এখন চার ইউনিট স্ক্যানিয়া, কিছু নন-এসি কোচও আছে। ঢাকা-রংপুর-নীলফামারী-দেবীগঞ্জ তাদের প্রধান রুট।
উত্তরের আরেকটি নামকরা অপারেটর এসআই এন্টারপ্রাইজ। সিরাজগঞ্জ কেন্দ্র করেই বাসসেবা দিয়ে থাকে তারা। সেসঙ্গে সিরাজগঞ্জ-কক্সবাজার, নওগাঁ-কক্সবাজার, নওগাঁ-নোয়াখালি, নওগাঁ-সিলেট রুটেও সেবা দিয়ে থাকে। তাদের বহরে হিনো, মিৎশুবিশি, ইসুজু আছে। কিছুদিন হলো তারা দেশের সবচেয়ে বড় পথ পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার এবং ঠাকুরগাঁও থেকে কক্সবাজার যাত্রীসেবা দিতে শুরু করেছে। এ পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার।
এবার রাজশাহী, খুলনা হয়ে সিলেট
রাজশাহীর দিকে নজর ফেরালে আমরা পাই ন্যাশনাল ট্রাভেলসকে। ২০০০ সালের শুরুতেই এই পরিবহন সংস্থা ৪টি হিনো একে১৭৩ দিয়ে যাত্রা শুরু করে। ঢাকা-রাজশাহী তাদের প্রথম রুট। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত রুটটি সম্প্রসারিত করে। ২০০৫ সালে তারা এসি সার্ভিস শুরু করে। তবে বড় রকমের পরিবর্তন আসে ২০১২ সালে। ব্রান্ড নিউ হিনো আরএম২ এসি বাস যুক্ত হয় তাদের বহরে। ২০১৬ সালে তারা ৩টি স্ক্যানিয়া যুক্ত করে আবার চমকে দেয়। এ সংস্থার মোট বাস সংখ্যা ৪২টি। দেশ ট্রাভেলসও ঢাকা-রাজশাহী রুটের পরিচিত নাম এখন। ২০১২ সালে তারা ন্যাশনাল ট্রাভেলস থেকে আলাদা হয়। সম্প্রতি এই রুটে যুক্ত হয়েছে একতা ও গ্রামীণ পরিবহন।
এরপর ঢাকা-যশোর-খুলনা রুটে আছে ঈগল পরিবহন। দক্ষিণে একটা জনপ্রিয় পরিবহন ছিল আজমিরী পরিবহন। মাঝখানে হারিয়ে যাওয়ার পর এখন আবার নিয়মিতই দেখা মিলছে। গাংনী-মেহেরপুর রুটের ফাতেমা স্পেশালের কথাও বললেন ফজলে রাব্বী। ওই রুটের বেশ পুরানো এবং ছিমছাম এক অপারেটর ফাতেমা। ঢাকা-পাংশা-কুমারখালী রুটে আছে লালন শাহ পরিবহন। চট্টগ্রাম থেকে শাহী পরিবহন যাত্রী সেবা দিয়ে থাকে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। ১৯৮৯ সাল থেকে তারা যাত্রী সেবা দিয়ে আসছে। তাদের বহরে ৮ ইউনিট এসি কোচ আছে। ঢাকা-গোপালঞ্জ, ঢাকা-পিরোজপুর, ঢাকা-বাগেরহাট-রায়েন্দা রুটে বাস অপারেট করে সেবা গ্রিনলাইন। চুয়াডাঙ্গাবাসীর কাছে পরিবহন খাতে জনপ্রিয় এক নাম চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স। তিন দশকের বেশি সময় ধরে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও মাগুরায় যাত্রীসেবা দিয়ে আসছে।
ঢাকা থেকে সিলেট যাত্রাপথে সবচেয়ে বেশি যে পরিবহন সংস্থার বাসের দেখা মেলে তার নাম এনা। এছাড়াও গ্রিনলাইন, হানিফ, ইউনিক, লন্ডন এক্সপেস, শ্যামলী পরিবহনের বাসও দেখা যায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়।
সড়ক তুমি কার?
ফজলে রাব্বী জানান, বর্তমান সময়ে বিলাসবহুল গাড়ির তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ওপরের দিকে স্থান করে নিয়েছে। কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিস্থিতির সঙ্গে এটি সহজেই মানিয়ে নেয়। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও তুলনামূলক সহজ আর চমৎকার পারফরম্যান্স। এর আউটলুক যেমন, তেমনি ইন্টেরিয়রও আকৃষ্ট করে।
রাব্বীরা মান ও গুণ যাচাই করে পরিবহন সংস্থাগুলোকে কয়েকটি গ্রেডে ভাগ করেন। ঠিক সময়ে ছাড়া ও পৌঁছানো, মাঝপথে যাত্রী না ওঠানো, লাগেজ সুবিধা পর্যাপ্ত হওয়া, চেসিস কোন প্রতিষ্ঠানের ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে নম্বর দেওয়া হয় এবং 'এ' গ্রেড বা 'বি' গ্রেডে ভাগ করেন।
রাব্বীরা তাদের এসব পর্যবেক্ষণ কোম্পানি মালিকদের জানান। 'আমরা বড় কোনো প্রেশার গ্রুপ নই, মালিকরা সহজেই আমাদের ওভারলুক করতে পারেন। তবে অনেক যাত্রী যেহেতু আমাদের ফলো করেন, তাই আমাদের বিচার-বিবেচনার কিছু মূল্য রয়েছে,' বলেন তিনি।
রাব্বী বলছিলেন, 'এটা মেনে নেওয়া ভালো যে যাত্রীরা নয়, মালিকরাই সড়ক নিয়ন্ত্রণ করেন। মালিকরা নিজেদের কথাই ভাববেন, সেটা স্বাভাবিক—কিন্তু যাত্রীদের কথা বেমালুম ভুলে যাবেন, তা নিশ্চয় অস্বাভাবিক। আমরা বাস লাভাররা মূলত যাত্রীদের কথা মালিকদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসাবে কাজ করি। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের রাস্তায় ভালো মানের গাড়ি চলে। কিন্তু এটাই একমাত্র বিচার্য বিষয় নয়। অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে মিললে তবেই ভালো যাত্রীসেবা বলা যেতে পারে। যেমন ধরুন, বাস কর্মীদের আচরণ, টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি না করা, কাউন্টারগুলোর টয়লেট পরিচ্ছন্ন থাকা, বাসের বাইরে দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে বসার ব্যবস্থাও সুন্দর হওয়া, বাস চালনা নির্বিঘ্ন করা ইত্যাদি।'
রাব্বী একটা বড় সমস্যার ওপর আলো ফেললেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের চৌদ্দগ্রামে আজকের চাকচিক্যময় যে হোটেলগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলো মূলত ২০০৩-২০০৪ সালের দিকে। আগে এ হোটেলগুলোর জায়গায় ছিল কিছু ড্রাইভারস হোটেল যেগুলোর খাবার ছিল ভালো, দামেও ছিল সস্তা। এখনকার রয়্যাল হোস্ট, টাইমস স্কয়ার বা নূরজাহান নামের হোটেলগুলোয় খাবার যেমন-তেমন, দাম অত্যধিক।
রাব্বী বলেন, 'কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে এতটাই উদাসীন যে আমাদের অবাক হতে হয়। এরপর টার্মিনালগুলোতে ভালো ওয়াশরুম, রেস্ট রুম, প্রেয়ার রুম এবং ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টার থাকার চিন্তা করাটা যেন অপরাধ।'
তিনি আরও বলেন, 'বাস মালিকদের সঙ্গে আমাদের মাঝেমধ্যেই দেখা-সাক্ষাৎ হয়। নতুন কোনো বাস আমদানি করলে বা নতুন বাস পথ চলতে শুরু করলে তারা আমাদের দাওয়াত করেন। এছাড়া আমরা বাস লাভাররা রমজান মাসে ইফতার পার্টির আয়োজন করি। সেখানে মালিকদের দাওয়াত দিই, সবাই আসার সুযোগ পান না, তবে যারা আসেন তাদের কাছে সামগ্রিক পরিস্থিতি উপস্থাপন করি। সাধারণত বাস মালিকরা নিজেদের পক্ষে যায় এমন পরামর্শ সহজেই গ্রহণ করেন আর যেসব বিষয় তাদের লাভজনক মনে হয় না সেগুলোর ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। তবু কিছু না হওয়ার চেয়ে একটু কিছু হওয়া আমাদের আশান্বিত করে, মনে হয় সামনে সুদিন আসবে।'