মহাকাশে স্পেসস্যুট ছাড়া কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন নভোচারীরা?
আমাদের অনেকেই হয়তো মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পরিদর্শন এমনকি হয়তো নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের কথাও কল্পনা করেছি। তবে মহাকাশ ভ্রমণ সহজ কোনো বিষয় নয়। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আর প্রতিকূল পরিবেশে সেখানে টিকে থাকতে হয়। তাই আগেই পৃথিবীতে একই রকম পরিবেশ তৈরি করে নেওয়া হয় প্রস্তুতি ।
স্পেসসুটগুলো একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বায়ু,পানি, চাপ এবং শারীরিক সুরক্ষা প্রদান করে। কিন্তু এই উন্নত স্যুটগুলো যদি না থাকে? তখন কি কি সমস্যা হবে এসব কথাই থাকছে এই প্রতিবেদনে।
'২০০১: এ স্পেস ওডিসি' এবং 'দ্য এক্সপেন'-এর মতো সাইন্স-ফিকশন ছবি ও শো-গুলোয় মহাকাশে স্পেসস্যুট ছাড়া নভোচারীদের পরিণতির দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। কোথাও তো মানুষের বিস্ফোরিত হওয়া দৃশ্য দেখানো হয়েছে। তবে বিষয়টি সত্য নয়।
তাহলে বাস্তবে মহাকাশের বিশাল শূন্যতায় স্পেসস্যুট ছাড়া একজন ব্যক্তি কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে? সংক্ষীপ্ত উত্তর হল-দীর্ঘক্ষণ নয়।
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) এর মানব এবং রোবোটিক অনুসন্ধান বিষয়ক সমন্বয়কারী সিনিয়র স্ট্র্যাটেজি অফিসার স্টেফান ডি মে বলেন, খুব অল্প সময়, ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে নভোচারী অজ্ঞান হয়ে যাবে।
মহাশূন্যের অন্ধকারে, আমাদের টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা অক্সিজেনের অভাব শরীরে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ডি মে বলেন, 'আপনার ফুসফুস প্রসারিত হতে থাকবে এবং ফেটে যেতে শুরু করবে। একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর এতে আপনার রক্ত ফুটতে শুরু করবে এবং বুদবুদ সৃষ্টি হবে। যা অবিলম্বে এমবোলিজম সৃষ্টি করবে এবং আপনার শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ডুবুরিরা যখন গভীর থেকে উঠতে থাকে তখন পানির চাপ কমে গেলে একই ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়।
চাপের সম্পূর্ণ অভাবও অবিলম্বে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে। শারীরিক তরল, যেমন লালা এবং অশ্রু ফুটতে শুরু করবে। মানবদেহও প্রসারিত হবে, তখন চাপের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে ত্বকও প্রসারিত হবে।
ডি মে বলেন, চলচ্চিত্রে মানুষের বিস্ফোরিত হওয়ার যেরকম দৃশ্যায়ন হয় তা সঠিক নয়। আপনার রক্তপ্রবাহে অক্সিজেন শেষ হওয়ার আগে আপনি কয়েক সেকেন্ড সময় পাবেন। প্রথমে আপনি অজ্ঞান হবে এবং এরপর মৃত্যু ঘটবে। কারণ এই পরিস্থিতি পাল্টানোর কোন সুযোগ নেই। যদি না আপনাকে তখন উদ্ধার করে মহাকাশযানের চাপযুক্ত ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ পরিবেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অক্সিজেন এবং চাপ প্রদানের পাশাপাশি, স্পেসসুটগুলি নভোচারীদের অন্যান্য বিপদ এবং ক্ষতি থেকেও রক্ষা করে। ডি মে বলেন, 'মহাকাশে তাপমাত্রাজনিত সমস্যা এবং বিকিরণ ও মাইক্রোমেটিওরয়েডের হুমকি বিদ্যমান। স্পেসস্যুটগুলি মহাকাশে এসব থেকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো করে তৈরি করা হয়েছে।
একজন নভোচারী সূর্যের আলোতে থাকুক বা সূর্যের ছায়ায় থাকুক না কেন, পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (এলইও) মাইনাস ১৫০ থেকে ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত চরম তাপমাত্রা অনুভব করবে। এই অবস্থায় মানুষ পুড়ে যাবে বা জমে যাবে। যদিও জমে যাওয়াটি তাৎক্ষণিক হবে না, কারণ শূন্যে শরীর সহজে তাপশূন্য হয় না।
স্পেসসুটগুলি বিভিন্ন ধরণের বিকিরণ থেকেও রক্ষা করে। সূর্য থেকে আসা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের মধ্যে বেশি সময় থাকলে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে বিকিরণগত অসুস্থতা এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অতিবেগুনী রশ্মি ত্বক পুড়িয়ে ফেলে। আর এ সময় সৌর শিখা থেকে আসা কোনো কণা সমস্যাগুলো আরো বাড়িয়ে তুলবে।
মাইক্রোমেটিওরয়েড এবং মহাকাশের কোন বস্তুর ধ্বংসাবশেষ আরো বিপদ ডেকে আনে। এগুলো প্রতি সেকেন্ডে দশ কিলোমিটারের আশেপাশের গতিতে ভ্রমণ করে এবং স্যাটেলাইট, মহাকাশযান ও স্পেসওয়াক বা অন্য কাজে থাকা নভোচারীদের জন্য হুমকি তৈরি করে। যদিও মহাকাশে স্বল্প সময় অবস্থানকালে এ ধরনের বস্তু বা কণার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। তবুও, স্পেসসুটগুলি একাধিক স্তর দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে, যা নভোচারীদেরকে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা সম্ভাব্য মাইক্রোমেটিওরয়েড বা মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
এ ধরনের ইভিএ স্যুট ছাড়া মহাকাশে থাকা খুব মারাত্মক। খুব, খুব দ্রুত মৃত্যু ঘটবে। যদি কেউ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে চায় তাহলে তাকে নিশ্বাস বন্ধ রাখতে হবে এবং সেকেন্ডের মধ্যে একটি মহাকাশযানের সুরক্ষায় ফিরে যেতে হবে। অথবা কয়েক মিনিটের মধ্যে উদ্ধার এবং পুনরুজ্জীবিত হওয়ার আশায় থাকতে হবে।