মহাবিশ্ব পেরিয়ে: ঢাকার জুবায়ের অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি দিয়ে যেভাবে মন জয় করছেন
জুবায়ের কাওলিনের মাঝে বহু আগে থেকেই জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে এক অনন্য দক্ষতা ছিল। আর এটিকে কেন্দ্র করেই তিনি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
দক্ষতাটি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইমেজিং নামেও পরিচিত। যেখানে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বস্তু, মহাকাশীয় ঘটনা বা রাতের সুদূর আকাশের নানা ছবি তোলা হয়।
অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের ছবি তোলার জন্য খুব বিশেষ ও সম্ভবত ব্যয়বহুল সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। তবে জুবায়ের বিষয়টির দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। নিজেই তৈরি করেছেন টেলিস্কোপ।
এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি ফেসবুকে জুবায়ের ওরিয়ন, ঈগল ও রোসেট নেবুলার কিছু ছবি পোস্ট করেছেন। ছবিগুলি বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষজন তার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকেন। কেননা তিনি বিশেষ করে নিজ যন্ত্র ব্যবহার করে সেই সমস্ত ছবি তুলেছিলেন।
পোস্টে জুবায়ের বলেন, তিনি বহু বছর ধরে ফেসবুক থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি নিজের অন্যান্য শখ নিয়ে কাজ করেছেন; যার মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা একটি। সেক্ষেত্রে তিনি গত পাঁচ বছর করে নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশের ছবি তুলছেন।
বিশ্বের নানা দেশে বহু প্রতিভাবান অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার রয়েছে। সেক্ষেত্রে ঢাকার বাসিন্দা জুবায়েরও তাদের মতোই একজন। পাশাপাশি তিনি একজন পেশাদার অ্যানিমেটর ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি বিজ্ঞান ও শৈল্পিকতার এক চিত্তাকর্ষক মিশ্রণ। যা আমাদের বিশেষ ফটোগ্রাফিক কৌশলের মাধ্যমে মহাবিশ্বের শ্বাসরুদ্ধকর বিস্ময়গুলিকে ক্যামেরাবন্দি করার সুযোগ করে দেয়। দূরবর্তী নীহারিকাগুলির ইথারিয়াল আভা থেকে শুরু করে শনি গ্রহকে দেখতে দক্ষতাটি অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পেশাদার ফটোগ্রাফার উভয়কেই সহায়তা করে। যা কি-না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়।
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির বিশেষ দিক হলো এটি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ঘটনাগুলির অত্যাশ্চর্য ভিজ্যুয়াল রেকর্ড তৈরির পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অবদান রাখে। এক্ষেত্রে মহাজাগতিক নানা পরিবর্তন ও আবিষ্কারগুলিকে খুঁজতে সাহায্য করে। একইসাথে বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্ময় সৃষ্টি করে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে গত ৯ নভেম্বর জুবায়েরের সাথে সাক্ষাৎ করা হয়। সেখানে তার এই কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করা হয়।
আপনি ছবিগুলো শেয়ার করার পর থেকে মানুষজনের কাছ থেকে যে আগ্রহ ও প্রশংসা পাচ্ছেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
জুবায়ের বেশ হাসিমুখে উত্তর দিলেন, "এটা বেশ আনন্দদায়ক।"
তিনি বলেন, "আমি একটা সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সক্রিয় ছিলাম। তবে এরপর আমি ফেসবুক চালানো থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ এটিতে প্রচুর সময় ব্যয় হয়। সেখানে একসাথে অনেক কিছু ঘটে এবং অনেক বেশি মানুষ সেগুলো শেয়ার করে। বিপরীতে আমি ইনস্টাগ্রামকে খুব প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছি। কারণ আমি সেখানে আমার জন্য উপযুক্ত কমিউনিটি পেয়েছি। যারা কি-না ছবি তোলায় উৎসাহী। তখন আমি সেখানে পোস্ট করা শুরু করলাম। সেখান থেকে আমি বিভিন্ন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফারের সাথে পরিচিত হতে শুরু করি। কাজের ক্ষেত্রে তাদের নৈপুণ্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তারা সকলেই বিদেশি। আমি তখন ভালোভাবে কাউকে চিনতাম না। এখন আমার বেশিরভাগ দর্শকই বিদেশি।"
"অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ জায়গা ছিল দূরবর্তী আকাশ। আমি গ্যালাক্সি ও নীহারিকাগুলির আরও বেশি করে ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। এভাবেই সবকিছুর শুরু। পাঁচ বছর ধরে আমি এই কাজটি করছি। আমি ২০১৯ সালে কাজটি শুরু করেছিলাম। শুরু থেকেই আমি এটি সম্পূর্ণভাবে আমার নিজের তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে করেছি। কারণ আমার কাছে এটি একটি ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জের মতো ছিল। সেই চ্যালেঞ্জই আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমি ওল্ড স্কুল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। যাদের মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের নিজস্ব যন্ত্রপাতি তৈরি করতে হয়েছিল।"
জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কারা?
"প্রথম দিকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা; যাদের মধ্যে রয়েছে গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানেস কেপলার, উইলিয়াম হার্শেল, চার্লস মেসিয়ারসহ আরও অনেকে। তাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবুও প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা জ্ঞানের সীমানা অতিক্রম করেছিলেন। তারা নিজেরাই টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন। এই ব্যাপারটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই আমি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই এবং মহাবিশ্ব ও এতে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে বুঝতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে চাই।"
তাহলে আপনার অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির শুরু কীভাবে হল?
"আমি ছোটবেলা থেকেই সাধারণত ফটোগ্রাফিতে আগ্রহী ছিলাম। এই আগ্রহটা আমার মাঝে সবসময়ই কাজ করতো। আমি এখন পর্যন্ত পেশাদার ইমেজিং নিয়ে কাজ করছি। অ্যানিমেশন, কম্পিউটার গ্রাফিক্স ও ফিল্মমেকিং মূলত ইমেজের বিভিন্ন ফরম্যাট নিয়ে কাজ করে। এই সবকিছুই আন্তঃসংযুক্ত। অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি আমি সম্প্রতি আগ্রহী হয়েছি। কিন্তু এটি এখন একটি নেশায় পরিণত হয়েছে।"
আপনি কি এই দক্ষতা অর্জনে কোনো পেশাদার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন?
"আমার সম্পর্কে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমি একজন অ্যাকাডেমিক বিমুখ মানুষ। আমার একাডেমিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। তবে আমার কাছে মনে হয়, আপনি যদি আগ্রহের সাথে কিছু শিখতে চান কেবল তখনই আপনি তা শিখতে সক্ষম হবেন। আপনাকে শুধু জানতে হবে আপনি কী শিখতে চাইছেন। আমি স্কুলে কম নম্বর পাওয়ায় বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে পারিনি। যার ফলে আমাকে ব্যবসায় শিক্ষায় শাখায় পড়তে হয়েছিল।"
জুবায়ের বলেন, "অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির উপর আমার একেবারেই কোনো প্রশিক্ষণ নেই। আমি নিজে থেকে সব শিখেছি। এই সম্পর্কে তথ্য সবজায়গায়ই আছে।"
আপনার নিজের তৈরি টেলিস্কোপের গল্পটা কী? কেন আপনি নিজেই এটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
"এটা আমার নিজের কাছে করা প্রতিশ্রুতি থেকে এসেছে। আমি ১৯৯৮ সালে প্রথম টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলাম। যখন আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। আমি ঐ বয়সেই অনেক কিছু চেষ্টা করেছিলাম। আমি তখন আমার নিজের সঞ্চিত অর্থ এবং আমার মায়ের সাহায্যে নিয়ে প্রথম কম্পিউটার পেয়েছিলাম। আমার অ্যানিমেশন ও কোডিংয়ের প্রতি আগ্রহ সেই বয়স থেকেই। আমি বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলি পড়তাম; যা আমাকে মহাবিশ্ব, টেলিস্কোপ ও লেন্সের বিষয়ে জানতে সহায়তা করেছিল। লেন্সের ক্ষেত্রে ফোকাল লেন্থের গাণিতিক হিসাব আমার কাছে সহজ মনে হয়েছিল ও আকৃষ্ট করেছিল। সেক্ষেত্রে আমি আমার বাড়ির পাশের চশমার দোকানে গিয়ে টেলিস্কোপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় লেন্সগুলি নিয়েছিলাম। তারপর আমি আমার মায়ের কাছ থেকে কাগজের টিউব সংগ্রহ করেছিলাম। কেননা তিনি ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে কিছুটা কাজ করতেন। এরপর আমি রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে কাগজের টিউবগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী কেটে একত্রে সেলাই করতাম। ফলে ঘরে তৈরি এই টেলিস্কোপের মধ্যে দিয়ে তাকালে দূরের বস্তু আরও কাছে দেখতে পেতাম। একইসাথে আমি যখন কৃত্তিকার দিকে তাকাতাম তখন আমি খালি চোখের দেখার চেয়ে আরও বেশি কিছু সেখানে দেখতে পেতাম। তখনি আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমি বড় হয়ে আরও ভালো টেলিস্কোপ তৈরি করব।"
"এখন যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি যে, এমন সংকল্প আমি শুধু ছবি তোলার জন্য নেইনি। বরং আকাশের রহস্য উদ্ঘাটনে আমার সম্পূর্ণরূপে ইচ্ছা ছিল।"
"আমি বিদেশি ফটোগ্রাফারদের নিজ বাড়ির উঠোন থেকে তোলা গ্যালাক্সি ও নীহারিকাগুলির তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকাতাম। আমি তখন অবাক হতাম যে, সেই আগেরকার জেমস ওয়েবের সময়ে এমনটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল যখন তেমন কিছুই ছিল না। এটি আমাকে দূরবর্তী আকাশের ছবি তোলার কথা ভাবতে বাধ্য করে। সেক্ষেত্রে ফটোগ্রাফির এই ধারা সম্পর্কে আমি ইন্টারনেটে যা পেয়েছিলাম একেবারে সবই দেখে ফেলেছিলাম।"
"অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে আমি বলব ৭০ ভাগ হল কৌশল আর ৩০ ভাগ হল যন্ত্রপাতি৷ আমি গ্যালাক্সিগুলির সেই অবিশ্বাস্য ছবি ধারণের পেছনের কৌশল শিখতে অনেক সময় ব্যয় করেছি৷ সেই জাদুকরী ছবিগুলি তোলার পেছনে যে জটিল বিষয়বস্তু রয়েছে তা অসামান্য।"
"আমি ২০১৯ সালে টেলিস্কোপ তৈরি শুরু করি। ২০১৭ থেকে আমি পেশাদারভাবে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের সাথে কাজ করছি। ২০১৮ থেকে আমি ইলেকট্রনিক্স নিয়ে করছি। যেহেতু আমি ইতিমধ্যে থ্রিডির সাথে পরিচিত ছিলাম, তাই ক্যাডের মতো সফটওয়্যারগুলি নিয়ে কাজ করা অন্য যেকোন সফটওয়্যারের মতই আমার জন্য সহজ ছিল।"
"আমি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯; এই নির্দিষ্ট দিনের কথা কখনই ভুলব না। আমি সবেমাত্র আমার প্রথম টেলিস্কোপ তৈরির কাজ শেষ করেছি। সেদিন আমি ছাদে গিয়ে সবসময়ের মতো আকাশের দিকে তাকালাম। তখন সকাল ৭টা। আমি বুঝতে পারলাম দিনের আলোর উজ্জ্বলতা বেশি ছিল না। অর্থাৎ তখন আংশিক গ্রহণ ছিল। আমি তাৎক্ষণিকভাবে ক্যামেরায় আমার নতুন তৈরি টেলিস্কোপ স্থাপন করি। যদিও তখন ফোকাস নিয়ে আরও কাজ করার প্রয়োজন ছিল। তবে আমি সেই মুহূর্তে এসব ফ্যাক্টর উপেক্ষা করে সেই আংশিক গ্রহণের কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম।"
জুবায়ের ঠিক এভাবেই সেদিনের স্মৃতিচারণ করেন। সেই ছবিটি শুরুতে অনেক দিন ধরে তার প্রোফাইল পিকচার হিসাবে ছিল। ছবিটি এখনও তার অ্যাকাউন্টে পাওয়া যাবে।"
জুবায়ের তখন তার আরেকটি ফেসবুক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।
"ফেসবুকে 'স্টার পার্টি বাংলাদেশ' নামে একটা ছোট গ্রুপ রয়েছে। লোকজন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সময় আকাশ, তারা, গ্যালাক্সির ছবি তুলে সেখানে পোস্ট করে। সেখানে আমিও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ওরিয়ন নেবুলার ছবি পোস্ট করি। যা মুহূর্তেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।"
জুবায়ের জানান, তার কাজের মাধ্যমে মানুষ ছায়াপথ, নীহারিকা ইত্যাদি সম্পর্কে আরও আলোচনা করছে। যা তার কাছে বেশ আনন্দদায়ক এক অনুভূতি। মানুষজন এগুলোর ডাইমেনশন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে, যা তার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল।
"আমি ভেবেছিলাম এখানকার (গ্রুপটির) লোকেরা চাঁদের ছবিগুলোকে আরও বেশি পছন্দ করবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ বরং নীহারিকার ছবিগুলিতে বেশি মুগ্ধ হয়েছিল৷ এটি আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল৷ আমার বিদেশি দর্শকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি বরং উল্টো ঘটেছে।"
প্রজেক্টটির আর্থিক দিক সম্পর্কে কথা বলি। আপনার এটির ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে?
জুবায়ের বলেন, "আমি এখনও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছি। আসলে দিন শেষে আমি একজন শিল্পী। বিষয়টি হচ্ছে, ব্যবসায় 'উত্থান-পতন' থাকে। আমার চাকরি নেই। আমি ২০১০ সাল থেকে আমার নিজস্ব অ্যানিমেশন স্টুডিও, অগ্নিরথ স্টুডিওস চালাচ্ছি। আমরা ভিএফএক্স ও অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করি। আমার গল্পের সেই অংশটা হয়ত অন্যদিন শেয়ার করব। তাই সবসময়ই কমবেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। আমার প্রথম মাউন্ট কিনতে আমাকে সঞ্চয় করতে হয়েছিল। কোভিড মহামারি চলাকালীন আমরা বড় অ্যানিমেশন প্রকল্পের কাজ পেয়েছিলাম। এটি আমাকে বড় কেনাকাটা যেমন ট্র্যাকিং মাউন্ট, ক্যামেরা এবং আরও অনেক কিছু কিনতে সাহায্য করেছিল। সুতরাং আমার পেশাগত কাজ আমাকে আমার আগ্রহী প্রজেক্টে অর্থায়নে সাহায্য করেছে। সত্যি বলতে, আমি এই আগ্রহী প্রজেক্টগুলো থেকে খুব বেশি আয় করতে পারি না। এমনকি কেউ যদি আমার একটি ছবি কেনেও তবুও আপনার সাথে এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য যথেষ্ট অর্থ আসবে না। আমি আমার কয়েকটি ছবি বিক্রি করেছি। কিন্তু এটি আমার জন্য লাভজনক ছিল না। সুতরাং, আর্থিকভাবে আমাকে সর্বদা স্বাবলম্বী হতে হবে।"
জুবায়ের সম্প্রতি টেলিস্কোপ বিক্রির জন্য অর্ডার পেয়েছেন। তিনি বলেন, "আমি এমনকি অচেনা লোকদের কাছ থেকে টেলিস্কোপের জন্য অর্ডারের অনুরোধও পাচ্ছি। যেহেতু আমি ব্যক্তিগতভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করছি, আমি জানি এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। লোকেরা মনে করে যেহেতু এটি একটি ডিআউওয়াই প্রকল্প; তাই এটি সস্তা হবে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। বরং এটি একটি নতুন টেলিস্কোপ কেনার চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল হতে পারে। কারণ তখন এটিকে ব্যবসা হিসেবে ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে এই ব্যবসা চালানোর জন্য আপনি বেইজ প্রাইজে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না৷ তখন এর উৎপাদন খরচও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তখন আগ্রহী গ্রাহকদের জন্য ডিআইওয়াই প্রকল্প ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে আমি জানি না বিষয়টি কেমন হবে। তবে আমরা যদি এই জিনিসগুলিকে আরও স্থানীয়ভাবে তৈরি করতে পারি, তবে সম্ভবত একটি ভালো সুযোগ রয়েছে। আমাদের সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।"
আপনি আপনার যন্ত্রপাতি কোথা থেকে যোগাড় করেন? এগুলো সব স্থানীয়ভাবে সংগ্রহকৃত?
জুবায়ের বলেন, "সম্পূর্ণভাবে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করি না। টেলিস্কোপ তৈরির ক্ষেত্রে আমার যে প্রধান উপাদানটির প্রয়োজন ছিল তা হল অবজেক্টিভ লেন্স; অর্থাৎ টেলিস্কোপের সামনের লেন্সটি। আমি একটি চীনা অনলাইন স্টোর থেকে ১০২ মিমি অ্যাপারচার ৯০০ মিমি ফোকাল লেন্থ অবজেক্টিভ লেন্সটি কিনেছি। কারণ আমার এটা নিজের তৈরি করার কোন উপায় ছিল না। যতদূর মনে পড়ে, এটা কিনতে আমার প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ডলার খরচ হয়েছিল। আমি গলির নীচে একটি হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে ৪" ও ৫" পিভিসি পাইপের মাধ্যমে টেলিস্কোপ টিউব তৈরি করেছি। স্থানীয় অনলাইন দোকান থেকে বেশিরভাগ ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করেছি। এগুলি ছাড়া আমার বেশিরভাগ জিনিসপত্র আমার নিজের তৈরি। যেহেতু আমি এখানে আমার থ্রিডি প্রিন্টিং দক্ষতা অনেক বেশি ব্যবহার করি, তাই এটি আমার জন্য প্রক্রিয়াটিকে অনেক সহজ করে তোলে। আমি ডেস্কটপ থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করি যা আমি ঢাকা থেকে কিনেছি। ফিলামেন্টগুলি এখানেও পাওয়া যাবে। আমি ফিউশন৩৬০-এ ডিজাইন তৈরি করি; যা বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায় এমন ক্যাড সফটওয়্যার। তারপর আমি আমার থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করে সেগুলো প্রিন্ট করি। টেলিস্কোপে আমার সমস্ত ডিজাইন থ্রিডি মুদ্রণযোগ্য। তাই শুধু লেন্সগুলিই আমাকে কিনতে হয়েছিল।"
"যদি আমি শুধু ব্যবহৃত উপাদানের খরচের হিসাব নিই, তাহলে তা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা হবে। এর একটি বড় অংশ অবজেক্টিভ লেন্স এবং ইলেকট্রনিক্সে ব্যয় হয়েছে।"
জুবায়ের বলেন, "আমি টেলিস্কোপ ছাড়াও একটি মোটামুটি মানের রোবোটিক ট্র্যাকিং মাউন্ট ব্যবহার করি। যা স্থানীয়ভাবে পাওয়া না যাওয়ায় আমাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হয়েছিল৷ তবে আমি ২০১৯ সালে নিজস্ব রোবোটিক ট্র্যাকিং মাউন্ট তৈরির কাজ শুরু করেছি। কিন্তু অলসতার কারণে এটি কখনই শেষ করা হয়নি৷ আশা করছি কোনো এক সময় এটির কাজ শেষ করতে পারবো।"
"যখন আমি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি শুরু করি, তখন আমি একটি সস্তা সেকেন্ড হ্যান্ড ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনেছিলাম। দূর আকাশের বস্তুগুলি ক্যাপচার করার জন্য এটিকে অ্যাস্ট্রো-মডিফাই করেছিলাম।"
জুবায়ের বলেন, "আমি ইতিমধ্যে মিরর গ্রিন্ডিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছি। আমি একটি মেশিন তৈরির কাজ করছি যেটি রিফ্লেকটর লেন্স তৈরি করবে। কিন্তু এটি এখনও প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে। তাই এটির কাজ সফলভাবে শেষ হলে এই সম্পর্কে জানাবো।"
টেলিস্কোপের ক্ষেত্রে এলিমেন্ট যত বেশি থাকবে সেটি তত ভালো কাজ করবে। যদি তিনটি এলিমেন্ট থাকে, তবে টেলিস্কোপটি তিনটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্যাপচার করবে। তবে ছবিতে খুব বেশি রঙের বিকৃতি হবে না। আমার টেলিস্কোপে দুটি উপাদান আছে। তাই টেলিস্কোপটি লাল ও সবুজ রংকে পুরোপুরি ক্যাপচার করে। অন্যদিকে নীল রঙটি কিছুটা ডিফোকাস হয়ে যায়। এটি আমার টেলিস্কোপের একটি সীমাবদ্ধতা। যেটি আমি ছবির পোস্ট-প্রসেসিংয়ে ঠিক করি। আমাকে ইমেজ প্রসেসিংয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়। আমি অন্যান্য টেলিস্কোপ নিয়েও কাজ করছি যা আমার বিদ্যমান যন্ত্রের সমস্যা দূর করতে পারে। সেক্ষেত্রে আমি রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ তৈরির চেষ্টা করছি। আমার বর্তমানটি একটি রিফ্রাকটর টেলিস্কোপ। এই দুটি ধরনের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আমি এটি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজ করছি। আমি কিছুটা অলস তাই এখনও এটি শেষ করতে পারিনি। আমি কখনই ভাবিনি যে, আমার কাজ হঠাৎ এত মনোযোগ আকর্ষণ করবে।"
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাথে কাজে যুক্ত হলেন?
একদিন ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির পক্ষ থেকে জুবায়েরের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তখন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্মে আপনার কাজ যুক্ত করতে চাই।' জুবায়ের খুশিমনেই তাতে রাজি হয়ে যান।
তিনি বলেন, "আমি আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাদের জন্য একটি লেখা লিখেছিলাম। এটি অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ছিল।"
তিনি জানান, সনি ও নাসার মতো অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও তার কাজ প্রদর্শন করেছে। যা তার আগ্রহকে আরও বাড়িয়েছে।
জুবায়ের বলেন, "মানুষ আমার কাজ নিয়ে আগ্রহ দেখায় এবং সেগুলো শেয়ার করে। এটি আমার কাজ চালিয়ে যেতে ও আরও বেশি ছবি তুলতে অনুপ্রাণিত করে।"
বর্তমানে আপনার ব্যবহৃত টেলিস্কোপটির ক্ষেত্রে আপনি কোন ধরণের প্রযুক্তিগত বাধার সম্মুখীন হন?
"আমি যে ধরনের লেন্স ব্যবহার করি সে সম্পর্কে পূর্বে বলেছি। যেটি একটি রিফ্রেকটর লেন্স; রিফ্লেকটর লেন্স নয়। রিফ্লেকটর লেন্স রঙের বিভ্রান্তি দূর করে এবং ছবিটিকে আরও নয়েজমুক্ত করে। সুতরাং, এই মুহূর্তে আমি যেসব প্রযুক্তিগত বাধার সম্মুখীন হচ্ছি তার মধ্যে এটি একটি। এরপর ছবি তুলতে আমি যে ফিল্টারটি ব্যবহার করি সেটি একটি ন্যারো ব্যান্ড ফিল্টার। যা নীহারিকার শুধু হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অংশ ক্যাপচার করে। হাইড্রোজেন বলতে রঙের লাল বর্ণালি এবং অক্সিজেন বলতে রঙের নীল ও সবুজ বর্ণালি বোঝায়। এই দুটির সংমিশ্রণ আমাকে শুধু নীহারিকার যথাযথ ছবি তুলতে সহায়তা করে। অন্যদিকে ছায়াপথের ছবি তোলা ঢাকা থেকে কঠিন। কারণ এর জন্য একটি বিস্তৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা রঙের বর্ণালি প্রয়োজন। এছাড়াও বর্ণবিকৃতি ও আলো দূষণের মতো কিছু বিষয় রয়েছে। যার ফলে এখান থেকে ছায়াপথের পরিষ্কার ছবি তোলা কঠিন হয়ে যায়।"
আলো দূষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে জুবায়ের আলোচনা শেষ করেন। তিনি বলেন, "আমি আলোক দূষণের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছি। এই সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে চাই। এটি শুধু অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির জন্য নয়; বরং বন্যপ্রাণী, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। রাত হওয়ার কথা অন্ধকার; আর দিন হওয়ার কথা উজ্জ্বল, বিপরীত কিছু নয়।"
"দিনের বেলায় আমরা আমাদের সমস্ত জানালা ঢেকে রাখছি। আর রাতে আমরা সমস্ত কিছু আলোকিত করে ফেলছি। এর পেছনের যুক্তি আমি বুঝি না। আমরা কীভাবে আমাদের পরিবেশ, শহর ও গ্রামীণ জায়গাগুলিকে আলোকিত করব সে সম্পর্কে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমি সম্প্রতি কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সেখানে ইনানী বীচে আমি দেখলাম যে, সমস্ত বড় বড় স্থাপনাগুলি আলোয় আলোকিত। সেখানে আমি একবার গিয়ে জোনাকি দেখেছিলাম। এখন রাতের আশেপাশে একটাও জোনাকি দেখা যায় না। একটা সময় ছিল যখন আমি সেখানে মেরিন ড্রাইভে গিয়েছিলাম। তখন ড্রাইভ করার সময় আমি আকাশে অজস্র তারা দেখতে পেতাম এবং রাস্তায়ও জোনাকি দেখতে পেতাম। এখন আমি এর কিছুই দেখি না। যদি কখনো এমনটা দেখে থাকি তবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।"
জুবায়ের বলেন, "প্রত্যেকেরই এই সমস্যাটিকে খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে আমরা হোয়াইট লাইটের ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারি। আমরা শহরের রাস্তায় আলোর উপরে শেড ব্যবহার শুরু করতে পারি। যাতে আলো শুধু নিচের দিকেই যায়। অন্যদিকে আলো যাতে উপরের দিকে না যায় কেননা সেখানে এটির প্রয়োজন নেই। আমাদের শহরের রাস্তার ধারের ডিজিটাল বিলবোর্ডের তীব্রতা ও উজ্জ্বলতা কমাতে হবে। এতে একইসাথে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, খরচও বাঁচবে। ব্যক্তিগত বাসস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের বেশিরভাগ সময়ের জন্যই রাতে ছাদে হোয়াইট লাইটের ব্যবহার করা এড়িয়ে চলা উচিত। এক্ষেত্রে ওয়ার্ম লাইটের ওপর শেডের মাধ্যমে ব্যবহার করলে সেটি ভালো হবে। একইসাথে জঙ্গলে লাইট ব্যবহার করা উচিত নয়। এটা বন্যপ্রাণী ও অন্যান্য প্রাণীদের ওপর নির্যাতনের মতো। রাতে কেউ আপনার মুখে আলো রাখলে আপনি কী ঘুমাতে পারবেন?"
"আসুন আমরা বর্তমানে দায়িত্বশীল হই। তাহলেই ভবিষ্যতে আমাদের শিশুদের আকাশের তাকিয়ে নক্ষত্রপুঞ্জ ও ছায়াপথ সম্পর্কে জানতে বলত পারবো। লাখ লাখ বছর ধরে আকাশ ও মানবজাতির মধ্যে একটা পারস্পরিক সংযোগ রয়েছে। শুধু আলোর নিচে নিজেদের জুতা দেখার জন্য এই সংযোগ নষ্ট হলে আমি তা মেনে নিতে পারবো না। তাই আমি বিনীতভাবে সবাইকে আলোক দূষণের বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হতে অনুরোধ করব।"