আক্কেল দাঁত কখন তোলা উচিত? সমস্যা শুরু হওয়ার আগে নাকি পরে?
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের বেথেসডার বাসিন্দা এবং হাইস্কুল সিনিয়র, ১৭ বছর বয়সী লিওরা লিভি মেমোরিয়াল ডে'র একদিন আগে মাত্র তার আক্কেল দাঁত তুলেছে। তার আশা ছিল লম্বা ছুটির মধ্যে তার ব্যথা সেরে যাবে। কিন্তু এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যায়, তার দুটি দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখানে ব্যথা রয়েছে। তখন ওরাল সার্জন বলেছিলেন, এখনই তার আক্কেল দাঁত তোলার সঠিক সময়।
কিন্তু যেমনটা ভেবেছিল লিভি, তেমনটা হয়নি। তার দাঁতে পোস্ট-সার্জিক্যাল ইনফেকশন হয় এবং চিকিৎসা করানোর পরেও এই সমস্যার কারণে সে স্কুলে যেতে পারেনি। তবুও লিভির মা এটা ভেবেই খুশি ছিলেন, মেয়ের আক্কেল দাঁত পড়েছে।
লিভির মা বেকি লিভির ভাষ্যে, "অন্তত তাকে পরে এটা নিয়ে ভুগতে হবে না।"
অনেক বাবা-মা ই চান তাদের টিনেজার সন্তানরা কলেজে যাওয়ার আগেই যেন তাদের আক্কেল দাঁত পড়ে যায়, এমনকি দাঁতে ব্যথা শুরু হওয়ার আগেই- সন্তানদের প্যারেন্টাল হেলথ ইনস্যুরেন্সের মেয়াদ থাকতে থাকতেই তারা এই দাঁত ফেলে দিতে চান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আক্কেল দাঁত যখন মুখের ভেতরে বেকায়দায় কোনো জায়গায় ওঠে, ব্যথা, ক্যাভিটি, প্রদাহ, আক্কেল দাঁত সংলগ্ন অন্য কোনো দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, তখন এই দাঁত তুলে ফেলতে হয়। কিন্তু এ ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দেওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আক্কেল দাঁত তুলে ফেলা ভালো কি-না, সে বিষয়ে কেউই একমত নন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেন্টাল অ্যান্ড ক্রানিওফেসিয়াল রিসার্চ-এর সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল রিসার্চ শাখার পরিচালক ডেনা ফিশার বলেন, "ওরাল সার্জনকে আগে ওই জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ও এক্স-রে'র ভিত্তিতে একটি বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক ডেন্টিস্ট হয়তো অন্যভাবে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু আশা করা হচ্ছে, তারা ক্লিনিক্যাল ক্লু এর ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেন।"
উইজডম টিথ, যা 'থার্ড মোলার' নামেও পরিচিত, আর বাংলায় যাকে বলে 'আক্কেল দাঁত'- সাধারণত একটি শিশুর টিনেজ বয়সের শেষভাগে, মুখের ভেতরে একেবারে দূরবর্তী শেষপ্রান্তে ৪টি দাঁত ওঠে, 'সেকেন্ড মোলারস' এর পেছনে মুখের উপরের ও নিচের চোয়ালে একটি করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিবছর কী পরিমাণ আক্কেল দাঁত ওঠে রোগীদের, সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই; যদিও কিছু জার্নালের নিবন্ধে বলা হয়েছে প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন রোগীর প্রায় ১০ মিলিয়ন আক্কেল দাঁত আসে।
যারা আগেভাগেই আক্কেল দাঁত তুলে ফেলার পক্ষপাতী, তারা বলেন যে আগে তুলে ফেলাই সহজ, নিরাপদ এবং দ্রুত সেরে ওঠা যায়, যখন কিনা রোগীর বয়সও কম থাকে- ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে; যদিও সবগুলোতেই সার্জারির প্রয়োজন হয় এবং যেমনটা লিভি পরিবার দেখেছে- এতে ঝুঁকিও থাকে। এদিকে ডেন্টিস্টরা বলছেন, রোগীদের বয়স যখন কম থাকে, তখন তাদের দাঁতের গোড়া ছোট থাকে এবং দাঁত তুলে ফেলা সহজ হয়।
আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের একজন মুখপাত্র লুইস রাফেতো বলেন, "একটা গাছের কথা চিন্তা করুন, মাটিতে এর শেকড় ভালোমত গেঁথে যাবার আগেই তো গাছটা তুলে আনা ভালো। তেমনই নার্ভস, সাইনাসের মধ্যেও এরকম শেকড় গেঁথে যাওয়ার ব্যাপার থাকে। তাই দাঁতগুলো পূর্ণরূপ পাওয়ার আগেই এগুলো তুলে ফেলতে চান অনেকে, সাধারণত বয়স যখন বিশের কোঠার মধ্যভাগে থাকে।"
আবার এর বিরোধী মত যাদের, যেমন- আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, এরকম 'রোগ-প্রতিরোধী' উপায়ে আগেভাগে দাঁত তুলে ফেলা মানে একটা অপ্রয়োজনীয় সার্জারির মধ্য দিয়ে যাওয়া। অন্তত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, আক্কেল দাঁত ওঠায় কোনো সমস্যা বা ব্যথা না থাকা সত্ত্বেও এটা তুলে ফেলার কোনো স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নেই। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ কনসেনসাস কনফারেন্সে আক্কেল দাঁত আগেভাগে তুলে ফেলার বিরোধিতা করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায়ও বলা হয়েছে, এমনটা করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস হেলথ মেডিকেল সেন্টার-এর ডেন্টাল পরিষেবা বিষয়ক পরিচালক উইলিয়াম লাভ বলেন, "আমার মনে হয় দন্তচিকিৎসায় আমরাও কখনো কখনো এই ফাঁদে পড়ে যাই, 'একটা যদি তুলে ফেলতে হয়, তাহলে ভাবি, সবই তুলে ফেলা যাক'; একটার মধ্যে যদি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে তারা ধরে নেওয়া হয় বাকিগুলোতেও সমস্যা আছে।"
এমনটা ভাবার আরেকটি কারণ হলো, জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়ার ফলে চারটা দাঁতই একবারে তুলে ফেলার কাজ সহজ হয়। "সেটা ঠিক আছে, কিন্তু রোগ পরীক্ষার ভিত্তিতে যদি ওষুধ দেওয়া হয়, বাকি তিনটা দাঁতও সেই একই পরীক্ষার ভিত্তিতে তুলে ফেলা উচিত নয়। আর চারটা দাঁতেই যখন কোনো উপসর্গ থাকে না, তখন এ প্রশ্ন করাই যায়, তাহলে দাঁত তুলে ফেলছি কেন?"
"তবে কোনো উপসর্গ নেই মানেই যে কোনো সমস্যা নেই তাও নয়", বলেন ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যাডাম'স স্কুল অব ডেন্টিস্ট্রি এর ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি শাখার অধ্যাপক রেমন্ড হোয়াইট জুনিয়র। তার ভাষ্যে, "অধিকাংশ মানুষেরই এই দাঁত নিয়ে সমস্যা হয় এবং সেটা তুলে ফেলতে হয়। বেশি বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে আক্কেল দাঁত তুলে ফেলার পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে তরুণদের তুলনায় বেশি সময় লাগবে। স্বাভাবিকভাবে মুখ খুলে খাবার খাওয়ার অভ্যাসে ফিরে যেতেও সময় লাগবে।"
২০১৪ সালে এডিএর একটি গবেষণায় বলা হয় যে, আক্কেল দাঁতে কোনো উপসর্গ দেখা না দিলেও সেগুলো যে রোগমুক্ত বা সমস্যামুক্ত- তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আগেভাগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই দাঁত তুলে ফেলাই যে ভালো, তারও যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
২০১৬ সালে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জনস- এর আক্কেল দাঁত বিষয়ক একটি প্রতিবেদনেও একই কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয় যে, সব আক্কেল দাঁতই তুলে ফেলার প্রয়োজন নেই, তবে যদি সেখানে কোনো সমস্যা তৈরি হয় তাহলে যত দেরি করবে, রোগীর জন্য সেই দাঁত তোলা ততই কষ্টকর হয়ে উঠবে এবং সেরে উঠতেও সময় লাগবে। কিন্তু যাদের আক্কেল দাঁত উঠলেও কোনো সমস্যা হয় না, তারা হয়তো এই দাঁত না তুলেও বাকি জীবন পার করতে পারবে।
রাফেতো বলেন, "এটা অবশ্যই ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে আলোচনার বিষয় যে দাঁত তুলে ফেলার ক্ষেত্রে কী কী ঝুঁকি বা উপকারিতা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কখন এই দাঁত তোলার সবচেয়ে ভালো সময়?"
কেজ ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ডেন্টাল মেডিসিন-এর একজন অধ্যাপক, ফয়সাল এ কুরেশি মনে করেন, যখন রোগীদের বয়স কম থাকে তখনই সবচেয়ে ভালো সময় আক্কেল দাঁত তোলার। তিনি বলেন, "এবারের গ্রীষ্মে আমরা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২৪ জন রোগীর সার্জারি করেছি এবং সব বাচ্চারাই তখন ছুটিতে ছিল, তাই তারা সেরে ওঠার সময় পেয়েছে।"
তিনি এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করে বলেন যে, হাজার বছর ধরে মানুষের চোয়াল আস্তে আস্তে শুধুই সংকুচিত হয়েছে, ফলে মুখের ভেতরে আক্কেল দাঁতের জন্য কমই জায়গা থাকে। সেইসঙ্গে আজকাল ক্যাভিটিও কম হচ্ছে মানুষের, তাই দাঁতও কম পড়ে। ফলে আক্কেল দাঁতসহ মুখের ভেতরে সবগুলো দাঁতের এঁটে উঠতে একটা সমস্যা তৈরি হয়।"
"আমাদের মুখের ভেতর এখনো আগের মতোই দাঁত ওঠে, অথচ চোয়াল হয়ে গিয়েছে চাপা। তাই আক্কেল দাঁত গজানো শুরু করলে এগুলো এমন এক জায়গায় ওঠে যে এগুলোকে পরিষ্কার রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে। সেখান থেকে আবার ঘাড়ে এবং গলায়ও ইনফেকশন হতে পারে, যার ফলে কিনা জরুরি অবস্থা তৈরি হতে পারে", বলেন তিনি।
সম্ভাব্য ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো 'অ্যালভিওলার নার্ভ' এর ক্ষতি, 'যা আপনার মধ্যে অনুভূতি জাগায়', বলেন উইলিয়াম লাভ। "নিম্নদেশে থার্ড মোলারের উপস্থিতি প্রায়ই ওই নার্ভের কাছাকাছি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে 'পারেস্থেশিয়া' (সূচ বা পিনের খোঁচার মত ব্যথা বা প্রদাহ) হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। তবে রোগীর বয়স যত কম থাকে, এই সমস্যা তত অস্থায়ী হয়। কিন্তু বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটা স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়", যোগ করেন তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামার একজন অধ্যাপক, জোয়ানা কানহা-ক্রুজ ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলেছেন, "প্রতিরোধমূলকভাবে আক্কেল দাঁত তুলে ফেলার ফলে যেসব ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, যেমন- রক্তপাত, ইনফেকশন এবং ড্রাই সকেট।" ড্রাই সকেট হলো এমন একটি অবস্থা যখন দাঁত তুলে ফেলার পর সেরে উঠতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া যথাযথভাবে হয় না এবং সেখানে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, ফলে হাড় ও নার্ভগুলো বাতাসের সংস্পর্শে চলে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাবা-মা এবং ক্লিনিশিয়ানদের আক্কেল দাঁতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, মুখের ভেতরে আক্কেল দাঁতের অবস্থান ও সেটা কী অবস্থায় আছে, তা মূল্যায়ন করা জরুরি। রোগী কখন ডেন্টিস্টের কাছে যাবে এবং ঘরে দাঁতের যত্ন নেবে, যেমন- নিয়মিত ব্রাশ করা ও ফ্লসিং- এ বিষয়গুলোর দিকেও নজর রাখতে হবে।
কেউ যদি দাঁতের যত্নে অবহেলা করে তাহলে ক্যাভিটি হতে পারে- শুধুমাত্র আক্কেল দাঁতেই নয়, এর পাশের অন্যান্য দাঁতেও। তখন হয়তো দাঁতটা তুলে ফেলাই উত্তম মনে হবে। কিন্তু সকালে-রাতে নিয়মিত ব্রাশ করলে এবং দাঁত পরিচ্ছন্ন রাখলে, আর মুখের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে আক্কেল দাঁত না তুলেও ভালো থাকা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।