যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত হওয়ার পর, বাংলাদেশে আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে চাপ বাড়বে
গৌতম আদানি এবং আদানি গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অভিযোগ ওঠার পর, বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার পথ সংকুচিত হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গৌতম আদানিসহ তার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়া এবং প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। গত বুধবার নিউইয়র্কে এসব ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ঢাকার হাইকোর্ট আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরেই এই আইনি জটিলতা শুরু হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে আদানি গ্রুপকে তার গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করার অনুমতি দেওয়া হয়।
বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, "আদানি এবং শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে চুক্তিটি বিতর্কিত ছিল। কারণ এটি টেন্ডার আহ্বান করার মাধ্যমে হয়নি। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের পর, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ নিয়ে আরও চাপ আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে, এটি চুক্তির ভবিষ্যতও সংকটে ফেলবে।"
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও আদানি পাওয়ারের পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারত চুক্তির আওতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সরকার নতুন কোনো ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করবে না।
আদানি গ্রুপের একটি শাখা আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল) ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঝাড়খণ্ডে ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা। কারণ বাংলাদেশের তখন একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব ছিল এবং কয়লা আমদানির জন্য আদানির প্রস্তাবটি সুবিধাজনক মনে হয়েছিল।
ড. হোসেন বলেন, "আদানি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাংলাদেশ সুবিধাজনক মনে করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সমালোচকরা অভিযোগ করে যে ভারতে সরকারি ভর্তুকি পেয়ে সুবিধা নেওয়া আদানি, বাংলাদেশে সেই সুবিধা দেয়নি।"
শেখ হাসিনার সরকারের সময়েও প্রকল্পের দাম নিয়ে বিতর্ক ছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকায় তারা সে বিতর্ককে পাত্তা দেয়নি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) আদানিকে দামের সংশোধন চেয়ে একটি চিঠি দেয়। আদানি প্রতি মেট্রিক টন ৪০০ মার্কিন ডলার দাম নির্ধারণ করলেও, বিপিডিবি দাবি করে, এর মূল্য ২৫০ মার্কিন ডলারের নিচে হওয়া উচিত, কারণ অন্য কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য তাদের মূল্য ছিল কম।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালের বিদ্যুৎ চুক্তি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। আওয়ামী লীগের পতনের পর, বেশ কয়েকটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যালোচনার আওতায় আসে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এক বিশেষ কমিটি গঠন করে হাসিনা সরকারের অধীনে হওয়া চুক্তিগুলোর পুনঃমূল্যায়ন শুরু করা হয়, যার মধ্যে আদানির সঙ্গে করা চুক্তিও ছিল।
এদিকে, ড. মোহাম্মদ ইউনুসের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সংলাপ বজায় রেখেছিল, যদিও তারা একসময় বকেয়া বেতনের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থগিত করার হুমকি দেয়। তবে পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য এক হাজার ৪৫০ কোটি রুপি দিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
সর্বশেষ পদক্ষেপ অনুসারে হাইকোর্ট এই চুক্তির বিষয়ে উচ্চ-পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আশা করা হচ্ছে এটি ঢাকাকে পুরো চুক্তিটি পুনঃমূল্যায়ন করার সুযোগ দিবে এবং আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে।