৭৫০ মিলিয়ন ডলার বিলিয়ে দিয়েছেন এই ভারতীয় বিজনেস টাইকুন; যার নিজের নেই কোনো মোবাইল ফোন!
স্বল্প আয়ের ঋণগ্রহীতা যারা ব্যাংক থেকে ঋণ পান না, তাদেরকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে নিজের এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। কর্মীদেরকে তিনি 'মার্কেট ওয়েজ' এর চেয়ে কমই পারিশ্রমিক দেন, তবুও তার ধারণা কর্মীরা বেশ ভালো আয় করছে। আর তিনি তার প্রায় সব সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু কর্মচারীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজে রেখেছেন শুধু ছোট্ট একটা বাড়ি আর ৫০০০ ডলার মূল্যের একটি গাড়ি।
আর থিয়াগরাজনকে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত এক শিল্পপতি ও ফাইন্যান্সিয়ার। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শ্রীরাম গ্রুপ এখন মাল্টিবিলিয়ন ডলারের এক সাম্রাজ্য, কিন্তু এটি অনেক দিক থেকেই বিশ্বের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলেছে।
ভারতের দরিদ্রদের ট্রাক, ট্রাক্টর এবং অন্যান্য গাড়ি ক্রয়ের জন্য ঋণ কার্যক্রমের অন্যতম পথিকৃৎ থিয়াগরাজন চেন্নাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শ্রীরাম গ্রুপকে একটি কনগ্লোমারেটে পরিণত করেছেন, যেখানে কিনা ইনস্যুরেন্স থেকে ধরে স্টকব্রোকিং পর্যন্ত নানা খাতে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮ হাজার মানুষ চাকরি করেন।
বর্তমানে থিয়াগরাজনের বয়স ৮৬ বছর এবং তিনি উপদেষ্টা পদে রয়েছেন। ব্লুমবার্গ নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে থিয়াগরাজন বলেন, তিনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছিলেন এটাই প্রমাণ করতে যে, ক্রেডিট হিস্টোরি বা ঋণগ্রহীতার পূর্বের ঋণ নেওয়ার রেকর্ড কিংবা নিয়মিত আয় ছাড়া ঋণ প্রদানকে যতটা ঝুঁকিপূর্ণ ভাবা হয়, তা আসলে ততটা নয়। তিনি জোর গলায় বলেন, তার যে ব্যবসায়িক নীতি তা মোটেও অদ্ভুত কিছু নয়। আবার তার প্রতিষ্ঠিত শ্রীরাম গ্রুপের যে পরিমাণ সম্পদ তিনি বিলিয়ে দেবেন ঠিক করেছেন, যার বাজারমূল্য ৭৫০ মিলিয়ন ডলার, সেই সিদ্ধান্ততেও ভুল নেই বলে তিনি মনে করেন।
সাম্রাজ্য তৈরি
চেন্নাইয়ে ১৯৭৪ সালে শ্রীরাম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আর থিয়াগরাজন। নিজের শহর থেকেই তিনি বলেন, "আমি একটু বামপন্থী। যাদের ইতোমধ্যেই ভালো সম্পদ আছে বা সুখী জীবনযাপন করছে, তাদের জীবনকে আরও সুখে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি বিশ্বাসী নই। বরং যাদের জীবন নানা সমস্যার আঘাতে জর্জরিত, তাদের জীবন থেকে কিছুটা দুঃখ সরিয়ে দেওয়াতে বিশ্বাসী আমি।"
ভারতের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে প্রচুর মানুষ দিন দিন মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করছে; বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশটিতেই ক্যারিয়ারে সাফল্যের শিখরে উঠেছেন থিয়াগরাজন। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের ব্যাংকিং পরিষেবা আরও সহজলভ্য করার দিকে জোর দিয়েছে, কিন্তু এখনো দেশটির প্রায় এক-চতুর্থাংশ নাগরিক তাদের প্রচলিত অর্থব্যবস্থার অংশ হতে পারছে না। যাদের ব্যাংক একাউন্ট আছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশ কখনোই সেই একাউন্ট ব্যবহারই করেনি বলে জানায় বিশ্বব্যাংক।
থিয়াগরাজন মনে করেন, দরিদ্রদের ঋণ দেওয়া সমাজতন্ত্রের একটি রূপ। কিন্তু অন্যান্য ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে যে উচ্চ সুদের হারে ঋণ দেওয়া হয়, তার চেয়ে সুলভ হারে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, এভাবেও ব্যবসা করাটা নিরাপদ এবং লাভজনক হতে পারে। আর এই কাজের মাধ্যমে তিনি অন্যান্য কোম্পানিকেও সুদের হার কমিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
বর্তমানে এই ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড়। ভারতে বর্তমানে ৯৪০০ 'শ্যাডো ব্যাংক' রয়েছে, যারা মূলত ঐ সকল ব্যক্তিদের ঋণ দেয় যারা গতানুগতিক অর্থব্যবস্থায় বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে না।
কেপিএমজি ইন্ডিয়া'র সিনিয়র পার্টনার এবং কর্পোরেট ফাইন্যান্স শাখার প্রধান, শ্রীনিবাস বালাসুব্রাহ্মনীয়ান বলেন, "আর থিয়াগারাজন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। খুব কম লোকেই এত দীর্ঘ সময় ধরে টিকে আছে এবং উন্নতি করে যাচ্ছে।"
থিয়াগরাজন এমন একটি ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে আছেন, যেটি কিনা প্রায়ই নৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এবং যেখানে উত্থান-পতনও অনেক বেশি।
ভিন্নধর্মী চিন্তা ও উদ্যোগ
ছোটবেলায় চেন্নাইয়ের একটি সচ্ছল পরিবারে গৃহকর্মী-পরিচারক পরিবেষ্টিত থেকে বড় হওয়া একজন মানুষের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু থিয়াগরাজন বলেন, তার মধ্যে সবসময়ই একটা বিশ্লেষণধর্মী এবং সমতাভিত্তিক মনমানসিকতা কাজ করতো।
চেন্নাইয়ে তিনি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং মাস্টার্স পর্যায়ে গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপরে তিনি কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে তিন বছর পড়াশোনা করেন।
১৯৬১ সালে নিউ ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করার মাধ্যমে আর্থিক খাতে নিজের কাজের জাদু দেখাতে শুরু করেন যা পরবর্তী দুই দশক ধরে অব্যহত থাকে। এর মধ্যে তিনি বিশ্ব ব্যাংকে (Vysya Bank) আঞ্চলিক ঋণদাতা এবং জে বি বোডা অ্যান্ড কোম্পানিতে রিইনস্যুরেন্স ব্রোকার হিসেবে কাজ করেন।
এই সময়টায় চেন্নাইয়ের অনেক মানুষ তার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য আসতো পুরনো ট্রাক কিনতে, আর তিনি নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে তাদের ঋণ দিতেন। ধীরে ধীরে এই বাড়তি কাজটাই তার জীবনের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। ৩৭ বছর বয়সে তিনি তার বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে মিলে শ্রীরাম চিটস প্রতিষ্ঠা করেন।
যারা ব্যাংক থেকে ঋণ পেত না, তারা প্রায়ই এসব তথাকথিত চিট ফান্ডের ওপর নির্ভর করতো। চিট ফান্ড হলো সম্মিলিত সঞ্চয়ী স্কিম, যেখানে প্রত্যেক সদস্য প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখে। এরপরে যত বছর অতিক্রম হয়েছে, থিয়াগরাজন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত ৩০টি কোম্পানি নিয়ে একটি গ্রুপ দাঁড় করাতে সক্ষম হন।
ট্রাক কেনায় অর্থায়নের ক্ষেত্রে থিয়াগরাজন দেখেন যে, মানুষ ৮০% হারেও ঋণ নিচ্ছে, কারণ ব্যাংকগুলো এই কাজে ঋণ দেয় না। তিনি সিদ্ধান্তে এলেন যে, প্রচলিত ধারণাটা ভুল।
তিনি বলেন, "মানুষ ভাবতো, সুদের হার চড়া হওয়ায় ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু আমার কাছে মনে হলো- এটা মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়।"
এই বোধোদয় তার জীবনকে পাল্টে দেয়। তিনি এমন এক হারে ঋণ দিতে শুরু করেন যা বৈশ্বিক মানদণ্ডে উচ্চহার হলেও, অন্যান্য বিকল্পের চেয়ে নিম্নহার ছিল। "সুদের হার ৩০%-৩৫% থেকে ১৭%-১৮% তে চলে এল", বলেন থিয়াগরাজন।
থিয়াগরাজন বলেন, দান করার চিন্তা থেকে তার এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়নি। দুটি মূল পুঁজিবাদী বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত এটা, একটি হলো বেসরকারি খাতে শিল্পোদ্যোগের গুরুত্ব; অন্যটি হলো বাজার নীতিতে বিশ্বাস।
বর্তমানে শ্রীরাম গ্রুপের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৩ মিলিয়ন। বর্তমানে ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি শ্রীরাম ফাইন্যান্স লিমিটেডের বাজারমূল্য ৮.৫ বিলিয়ন ডলার এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২০০ মিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করেছে। তাদের স্টক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন যে ৩৪ জন বিশ্লেষক, এদের মধ্যে মাত্র একজন স্টক বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন।
থিয়াগরাজন বিশ্বাস করেন যে, তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেশি বেতন দেওয়া হচ্ছে, যদিও তারা প্রচলিত বাজার হারের চেয়ে কমই পেয়ে থাকে বেতন। নিম্নস্তরের কর্মীরা প্রায়ই সহকর্মীদের চেয়ে ৩০% কম উপার্জন করে; আর সিনিয়র নির্বাহীদের ক্ষেত্রে ডিসকাউন্টের পরিমাণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
এ বিষয়ে থিয়াগরাজনের ভাষ্য হলো, "আমরা তাদেরকে ততটাই দেই যা দিয়ে তারা নিজেদের মোটামুটি স্বচ্ছন্দ্যে রাখতে পারে, খুব বেশি বাড়াবাড়ি ধরনের যেন না হয়। তাদের উচিত না আশেপাশের অন্যদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করা। এতে করে শুধু দুঃখই পাবে।
তিনি দাবি করেন, তার কর্মীরা তার প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর সঙ্গেই মানিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট। যদিও বেতন কম, কিন্তু কর্মীরা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সমসাময়িক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এখানে কাজের নমনীয়তা বেশি।
"আমি মনের শান্তি, স্থিতাবস্থা এবং সুবিধাজনক অবস্থায় বিশ্বাস করি যা এই চাকরিতে পাওয়া যাচ্ছে", বলেন মুম্বাইয়ে শ্রীরাম ফাইন্যান্সের শাখা ব্যবস্থাপক অমল বাওলেকার। এমনকি তিনি আরও বেশি বেতনের অনেক চাকরির প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার মতে, "এই প্রতিষ্ঠানের কাজের সংস্কৃতি অনেক বেশি মানবিক। এখানে অমানুষিক চাপ নেই।"
সাদামাটা জীবনযাপন
শ্রীরাম গ্রুপের কাজের প্রক্রিয়াকে যৌক্তিক মনে করার আরও একটি কারণ হলো, এর প্রতিষ্ঠাতা থিয়াগরাজন নিজেই গণমানুষের মতোই জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন। বহু বছর ধরে তিনি হুন্দাই হ্যাচব্যাক চালিয়েছেন। তার নেই কোনো মোবাইল ফোন, কারণ তিনি মনে করেন মোবাইল ফোন থাকলে মনোযোগ নষ্ট হয়।
এই বিজনেস টাইকুন শ্রীরাম গ্রুপের সব শেয়ারহোল্ডিং একদল কর্মীকে দিয়ে দিয়েছেন যেগুলো শ্রীরাম ওউনারশিপ ট্রাস্টে গিয়েছে। এই ট্রাস্ট ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ট্রাস্টের সুবিধাভোগী হিসেবে আছেন শ্রীরাম গ্রুপের ৪৪ জন নির্বাহী। তারা যখন অবসর নেন, এখান থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ভাতা নিয়েই বাড়ি ফেরেন।
এই ট্রাস্টের স্টকের বর্তমান মূল্য ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্লুমবার্গকে দেওয়া তিন ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে থিয়াগরাজন জানান, তার আগেও টাকার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না, এখনও নেই। তিনি সাধারণভাবেই থাকতে পছন্দ করেন। আজকাল তিনি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শুনে এবং ওয়েস্টার্ন ব্যবসায়িক ম্যাগাজিন পড়ে সময় কাটান।
গত ডিসেম্বরে শ্রীরাম ট্রান্সপোর্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি একটি শেয়ার অদলবদল চুক্তিতে শ্রীরাম ক্যাপিটাল লিমিটেড এবং শ্রীরাম সিটি ইউনিয়ন ফাইন্যান্স লিমিটেডকে নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়। শ্রীরাম পরিবহন ট্রাক ক্রয় এবং শ্রীরাম সিটি ইউনিয়ন ভোগ্যপণ্য এবং মোটরসাইকেল ক্রয়ের জন্য অর্থায়ন করে।
থিয়াগরাজন বলেন, তার নির্বাহীরা বছরের পর বছর ধরে এটির পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তেমন জড়িত ছিলেন না এখানে। কোম্পানিতে তার আর কোনো আনুষ্ঠানিক ভূমিকা নেই, কিন্তু দুই সপ্তাহ অন্তর সিনিয়র ম্যানেজাররা তাকে ব্রিফ করেন এবং তার পরামর্শ চান।
থিয়াগরাজন বলেন, "এখন কনসালট্যান্ট হিসেবে আমার একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। আমার একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। লোকজন আমার মতামত গ্রহণ না করে নিজেদের মতো কাজ করলেও আমার সমস্যা নেই। কিন্তু পরে যদি দেখা যায়, তারাই ভুল ছিল; তখন আমি শুধু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং বলি যে দেখো, আমি বলেছিলাম এটা।"
তবে থিয়াগরাজনের আফসোস এটা নিয়ে নয় যে তিনি তার সম্পদ দিয়ে দিয়েছেন; বরং কিভাবে দিয়েছেন তা নিয়ে তার আফসোস। তার ভাষ্যে, 'আমি ভাবতে পারিনি যে এত এত টাকা মুষ্টিমেয় কজনের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এ ব্যাপারে আমি অতটা খুশি নই। তবে ঠিক আছে। আমি এটা নিয়ে দুঃখও করছি না।"