এসি ছাড়াই যেভাবে ঠান্ডা থাকে মরুভূমির মাঝে অবস্থিত এই স্কুল!
ভারতের রাজস্থানে থর মরুভূমির বুকে অবস্থিত এক শহর জয়সালমির। হলদে বেলেপাথরের তৈরি স্থাপত্যের কারণে এই শহরকে 'গোল্ডেন সিটি' বলেও ডাকা হয়। কিন্তু মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় গ্রীষ্মকালে এখানে তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে।
এই দাবদাহের কথা মাথায় রেখেই বহু আগে থেকেই জয়সালমিরের এই শহরের ভবনগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে গরম কম অনুভূত হয়। আর এই শহরেরই একটি স্কুল, রাজকুমারি রত্নাবতী গার্লস স্কুল-এর ভবনের নকশা করতে গিয়ে সেই একই ধারণাটি মাথায় রেখেছিলেন নিউইয়র্কের স্থপতি ডায়ানা কেলোগ।
ভারতে নারী শিক্ষার হার সর্বনিম্ন যে অঞ্চলে, সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এই স্কুল নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা সিআইটিটিএ'র উদ্যোগে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এ সংস্থাটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আর্থিক ও শিক্ষা সহায়তা প্রদান করে। তিন স্তরের প্রকল্পের প্রথম ধাপ হিসেবে এই স্কুলটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মধ্যে আরও আছে নারীদের জন্য একটি কোঅপারেটিভ সেন্টার এবং একটি এক্সিবিশন স্পেস তৈরি।
আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ইন্ডিয়া এরই মধ্যে পরিবেশবান্ধব, বেলেপাথরে তৈরি এই স্কুলকে 'বিল্ডিং অব দ্য ইয়ার' হিসেবে অভিহিত করেছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে চালু হওয়া এই স্কুলে বর্তমানে ১২০ জন মেয়ে পড়াশোনা করছে বলে জানিয়েছেন কেলোগ।
কিন্তু কিভাবে মরুভূমির মধ্যেও ভবন শীতল রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই স্কুলে? বিশেষ করে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তাপপ্রবাহও বেড়ে গিয়েছে এবং প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ।
প্রাকৃতিকভাবে শীতল হওয়ার ব্যবস্থা
থর মরুভূমির কেন্দ্রে অবস্থিত একটি জায়গায় শিশুদের জন্য আরামদায়কভাবে শিক্ষা গ্রহণের মতো স্কুল তৈরি করা ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখানে খরার প্রবণতা বেশি এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
কেলোগ সাধারণত হাই-এন্ড আবাসিক ভবনের নকশা করে থাকেন। কিন্তু ২০১৪ সালে জয়সালমির ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এমন একটি ভবন নির্মাণ করতে চান যেখানে জয়সালমিরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সঙ্গে আধুনিক নকশার সম্মিলন ঘটবে এবং এটি মরুভূমির বুকে আশা ও সহনশীলতার একটি প্রতীক হয়ে থাকবে।
স্থপতি কেলোগ বলেন, "শত শত বছর ধরে ভবনকে ঠান্ডা রাখার জন্য প্রচলিত কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি সেইসব পদ্ধতিকে এমনভাবে একত্র করে ব্যবহার করেছি যে এতেই কাজ হয়েছে।" তিনি আরও জানান, স্কুলের ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের চেয়ে প্রায় ২০-৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট কম।
স্কুলের অবকাঠামোর জন্য তিনি জয়সালমিরেরই বেলেপাথর ব্যবহার করেছেন- যেটি একটি জলবায়ু-সহিষ্ণু পদার্থ হিসেবে পরিচিত। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে পরিচিত জয়সালমির দুর্গ থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের আরও অনেক ভবন নির্মাণে যুগ যুগ ধরে বেলেপাথর ব্যবহার করা হচ্ছে।
"এ অঞ্চলে প্রচুর বেলেপাথর পাওয়া যায়। আর দামেও সস্তা এবং এখানকার স্টোনম্যাসনরা (পাথর নিয়ে কাজ করেন যারা) অসম্ভব প্রতিভাবান। বেলেপাথর ব্যবহার করলে তাপ ভেতরে প্রবেশ করে কম, আবার রাতেও এই ঠান্ডা ভাব বজায় থাকে", বলেন কেলোগ।
প্রচলিত যেসব রীতি কেলোগ ব্যবহার করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে- চুনা দিয়ে ভেতরের দেয়াল ঢেকে দেওয়া, যা আর্দ্রতার ফলে সৃষ্ট ময়েশ্চারকে বের করে দেয় এবং প্রাকৃতিকভাবেই ঘর ঠান্ডা রাখে। এ অঞ্চলের অন্যান্য ভবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েতিনি জালি ওয়ালও বসিয়েছেন- যা প্রাঙ্গনে সূর্যের আলো থেকে ছায়া দেয়। আর শ্রেণীকক্ষের ভেতরে উঁচু সিলিং এবং জানালা থাকায় ভেতরের তাপ বেরিয়ে যায় এবং সোলার প্যানেল ক্যানোপি শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্কুলের কাঠামোটি উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকারভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, বাতাস প্রবাহের দিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আবার নারীত্বের প্রতীকী রূপও প্রকাশ করা হয়েছে এর মাধ্যমে। কেলোগ এটিকে 'বিশালভাবে হাত বাড়িয়ে, দৃঢ় আলিঙ্গন' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
টেকসই ক্ষমতার মাঝেই আরাম
স্কুলে ব্যবহৃত, ভবন শীতল রাখার কৌশলগুলো অন্যান্য জায়গায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে জায়গাভেদে এসব কৌশলের কার্যকারিতায় পার্থক্য থাকবে বলে স্বীকার করেন কেলোগ। বাতাস প্রবাহের দিক এবং বিভিন্ন ধরনের বেলেপাথর ব্যবহারের ফলেও তাপমাত্রায় তারতম্য ঘটবে।
রাজকুমারি রত্নাবতী গার্লস স্কুলের কোথাও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়নি শুধুমাত্র এর পরিবেশগত প্রভাবের কারণেই নয়, বরং এই অঞ্চলে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবহার তেমন প্রচলিত নয়। প্রচলিত ও প্রাকৃতিকভাবে ভবন শীতল রাখার পদ্ধতি, যেগুলোর সাথে শিক্ষার্থীরা পরিচিত, সেগুলোই স্কুলে ব্যবহার হতে দেখার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এই পরিবেশে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করে এবং নিজেরা আত্মবিশ্বাসী হয় বলে মনে করেন কেলোগ।
তিনি বলেন, "আমি নিজেই গত ৩-৪ মাস ধরে এটা দেখেছি। মেয়েদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে; লাজুক স্বভাবের থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা, তাদেরকে যা শেখানো হচ্ছে তা-ই সাগ্রহে গ্রহণ করছে তারা।"