এফ মাইনর: নৃগোষ্ঠীর নারীদের প্রথম ব্যান্ডদলের শুরুটা যেভাবে
আমি নিশি রাইতের জংলা ফুল
ভাঙা নদীর ভাঙা কূল
মইধ্যেখানে জাইগা থাকা চর।
আমি গহীন বনে...
আমি গহীন বনের উদাস পাখি
সুখের আশায় চাইয়া থাকি সারাজনম ভর।
একজন বাজাচ্ছেন গিটার, আরেকজনের হাতে উকুলেলে। অন্যরা কিবোর্ড ও ড্রামসের দায়িত্বে। মিউজিকের তালে তালে সুর দিয়ে গান গেয়ে চলেছেন দলের প্রধান ভোকালিস্ট পিংকি চিরান। ২০১৯ সালে জংলা ফুল গানটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই নৃগোষ্ঠীর পাঁচনারীর ব্যান্ড দল 'এফ মাইনর' জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মানুষের এমন আগ্রহের আরেকটি কারণ হচ্ছে, এ পাঁচজনই হচ্ছেন পাহাড়ি কন্যা।
জাতি ও ভাষাগত দিক থেকে তারা ভিন্ন হলেও বাংলা গান তাদের গলায় যেন অনন্যমাত্রা পেয়েছে। তাদের গলায় বাংলা গানের সুন্দর ও সাবলীল গায়কি দর্শকদের রীতিমতো মুগ্ধ করেছে। নারীদের নিয়ে লেখা 'মেয়ে আমি সমানে সমান', নদী নিয়ে গান 'ডাহুক', এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষার ওপর তাদের একাধিক গান রয়েছে।
এফ মাইনর নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নারীদের নিয়ে গঠিত প্রথম কোনো ব্যান্ডদল। নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর পুরুষ শিল্পীদের একাধিক ব্যান্ডদল আরও আগে থেকেই ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উৎসব ও মেলায় এ দলগুলো গান করত। বর্তমানে পুরুষ ব্যান্ডগুলোর পাশাপাশি 'এফ মাইনর'-এর মেয়েরা তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় নানা উৎসব-আয়োজনে গান করেন। গানের জগতে নারীদের এমন অগ্রগতিকে নিজ গোষ্ঠীর লোকেরা বেশ সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে।
দলটির সদস্যরা জানান, পারিবারিক ও সামাজিক উৎসাহ সবসময় তাদের পাশে ছিল। তাদের সমাজে গান নিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ না থাকায় তাদেরকে তেমন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়নি। অবশ্য কিছু মানুষের আশালীন মন্তব্য থেকে মুক্তি পাননি তারা।
এফ মাইনর-এর গান শুনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও সরাসরি অনেকেই ইতিবাচক মন্তব্য করে উৎসাহ দেন। তবে এসবের বাইরেও একদল লোক নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করেন। দলের মূল ভোকালিস্ট পিংকি চিরান বলেন, 'এসব শুনে মাঝেমধ্যে খুবই হতাশ লাগে — এগুলো মনোবল দুর্বল করে দেয়। সবসময় এসব কথা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তখন সেগুলোর উত্তর দেই। কারণ আমরা মনে করি, এড়িয়ে গেলে কখনোই হয়তো পরিবর্তন আসবে না।'
শখের গাইয়ে থেকে গানের দল
পিংকি চিরান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তার সঙ্গে সাইড ভোকালিস্ট হিসেবে গলা মেলান শুরু থেকেই দলের সঙ্গে যুক্ত নাদিয়া রিছিল। তিনি একইসঙ্গে গিটার ও উকুলেলে বাজান। লিড গিটারিস্ট হিসেবে আছেন গ্লোরিয়া মান্ডা, কিবোর্ডে একিউ মারমা। আর ড্রামস বাজান দিবা চিছাম। এফ মাইনর-এর পাঁচ সদস্যের মধ্যে চারজন গারো সম্প্রদায়ের ও একজন মারমা। আগে ঐশ্বর্য চাকমা ছিলেন, তবে কাজের চাপে তিনি এখন আর দলের সঙ্গে যুক্ত নেই।
পিংকি চিরান জানান, তারা কেউই পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। ছোটবেলায় খুব ঘটা করে গানের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়াও হয়নি। তবে আগ্রহ থেকে অন্যদের কাছে গান শিখতে যেতেন। টেপরেকর্ডারে গান শুনে নিজেরাই গুণগুণ করে সেগুলো গাইতেন। গানের প্রতি আগ্রহ জন্মানোর পর টুকটাক শখের বশে স্কুল, গির্জার অনুষ্ঠানে ও মেলায় গান গাওয়ার শুরুটা হয়েছিল।
প্রথমদিকে দলের সদস্যরা সবাই বাদ্যযন্ত্রের ওপর খুব একটা দক্ষ ছিলেন না। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের আগ্রহ থেকে সেগুলো আয়ত্ত করে নেন। ব্যান্ডটির কনিষ্ঠতম সদস্য ও প্রধান গিটারিস্ট গ্লোরিয়া মান্ডা শুরুর দিকে গিটার বাজানোয় খুব একটা পারদর্শী ছিলেন না। শেখার প্রতি গভীর আগ্রহ ও অনুশীলনের মাধ্যমে গিটারের সুরে গান তোলার কাজটি তিনি বেশ ভালোভাবে রপ্ত করে নিতে পেরেছেন।
এফ মাইনর-এর শুরুর গল্প দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানাচ্ছিলেন পিংকি চিরান। শুরুর দিকে অনুশীলনের সময় তাদের সঙ্গে জাদু রিছিল ও অন্তর স্কুর নামক দুইজন পরিচিত বড় ভাই ছিলেন। এফ মাইনর-এর প্রথম মৌলিক গান জংলা ফুল জাদু রিচিলের লেখা। 'তার হাত ধরেই আমাদের এফ মাইনর-এর পথচলা শুরু হয়েছিল। ২০১৬ সালে আমরা তিনজন মেয়ে ছিলাম। ২০১৮ সালে দলে আরও দুজন নতুন সদস্য যুক্ত হন। বর্তমানে আমরা পাঁচজন ব্যান্ডের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আছি,' পিংকি বলেন।
মাঝখানে অবশ্য আরও কয়েকজন দলটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কেউ কেউ দু-একটি শোতে সাথী হয়ে পারফর্মও করেছিলেন। প্রথমদিকে নিজ সংস্কৃতি ও ভাষার গানগুলো দলটি চর্চা করত। ২০১৯ সালে জংলা ফুল গানের ভিডিও রেকর্ডেড ভার্সন মুক্তি পাওয়ার পর এফ মাইনর-এর পরিচিতি বাড়তে থাকে। এরপর তারা আরও তিন–চারটি মৌলিক গান করেছেন।
পিংকি বলেন, 'নৃগোষ্ঠীদের বিভিন্ন ভাষার ওপর প্রায় ১৫টি গান আমরা শিখেছি। এগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকি। গারো ও মারমা ভাষা বাদেও চাকমা, ত্রিপুরা, হাজং জনগোষ্ঠীর বিখ্যাত গানগুলো আমরা তুলেছি।' বড় অংকের টাকা লাগে বলে সবগানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করা সম্ভব হয়না বলে জানান পিংকি।
'আমাদের নিজস্ব ভাষার গান ছাড়া অন্যান্য গানগুলো তুলতে আমাদের তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। যারা গানগুলো লিখেছেন তাদের থেকে আমরা প্রথমে ঠিকমতো উচ্চারণ শিখে নেই। যদি গানের কথা ও উচ্চারণ সহজ হয়, সেক্ষেত্রে গানটি তুলতে ১০ মিনিট লাগে। আবার কোনো গান এক ঘণ্টায়ও তোলা সম্ভব হয় না,' বলেন পিংকি।
অন্য ভাষার গানগুলোর উচ্চারণ, অর্থ ও মূলভাব জেনে নিয়ে সেগুলো আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন এফ মাইনর-এর সদস্যরা। এরপর কয়েকবার অনুশীলন করলে ঠিকঠাক সুর দিয়ে গান তুলে ফেলা যায়। গান বাছাই করার ক্ষেত্রে তারা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বহুকাল পুরোনো গানগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেন।
এফ মাইনর—এক নাম, একাধিক অর্থ
এফ মাইনর নামটি আপাতদৃষ্টিতে গিটারের একটি কর্ড মনে হলেও এ নামকরণের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ব্যান্ডদলটি নারী মুক্তি ও নারী অধিকারকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেষ্টা করে চলেছে। এফ মাইনর-এর 'এফ' অক্ষরটি 'ফিমেল', 'ফ্রিডম, 'ফাইটার'-এর প্রতিনিধিত্ব করে বলে জানান পিংকি। আর 'মাইনর' শব্দটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অর্থে বোঝানো হয়েছে। যেহেতু গানের দল, তাই গিটারের কর্ডের সঙ্গে মিলে গিয়ে নামটি বেশ জুতসই হওয়ায় এটিকেই ব্যান্ডের নাম হিসেবে নির্বাচন করেন তারা।
২০১৬ সালে যাত্রা শুরুর পরপরই তারা শো করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। ঢাকার বনানী মাঠে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে এফ মাইনর প্রথম মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করে। নৃগোষ্ঠীদের বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাদেও স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মে দিবস, সম্প্রীতিমূলক অনুষ্ঠান, নারীদিবস ও নারী সম্মাননা অনুষ্ঠানগুলোতে এফ মাইনর-এর নারীদের পারফর্ম করতে আমন্ত্রণ করা হয়। জলবায়ু বাঁচাতে নদীরক্ষার জন্য আয়োজিত 'নদী রক্স' কনসার্টেও তারা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
'যেতে চাই বহুদূর'
ব্যান্ডটির নারীরা গানের পাশাপাশি সবাই কমবেশি অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত। কেউ চাকুরি করছেন, কারও এখনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ হয়নি। শুরু থেকেই তাদেরকে দুদিক সামলে গান চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কখনো কখনো দুকূল সামলাতে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তারা — এখনো হচ্ছেন।
পিংকি চিরান বলেন, 'প্রোগ্রামের তারিখ ও পরীক্ষার তারিখ এক দিনে পড়ে গেলে আমাদেরকে শেষ মুহূর্তে এসে না করে দিতে হতো। এসব কারণে আমাদের ব্যান্ডের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। কয়েকবার এমন হয়েছিল, পরীক্ষার দিনই কোথাও শো করতে ডাকা হয়েছে। আমরা পরীক্ষা শেষ করে রওনা দিতাম।
'তবে হতাশাজনক হচ্ছে, কোনো কারণে প্রোগ্রাম বাতিল হলে বা পেছালে তা আমাদেরকে অনেকেই জানান না। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সময় আমাদের সাথে এমন ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ বলতেন, তারা বিষয়টি আমাদেরকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। অনেক সময় আমরা রাস্তায় থাকা অবস্থায় প্রোগ্রাম বাতিলের কথা জানতে পারতাম। এ ব্যাপারগুলো আসলেই দুঃখজনক।'
পাঁচনারীর এ ব্যান্ডদলে ভবিষ্যতে আরও সদস্য যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিটি গোষ্ঠী থেকে সদস্য নেওয়ার মাধ্যমে সব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যান্ডের সদস্যারা। নৃগোষ্ঠীদের একাধিক ভাষার গানের পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর বাদ্যযন্ত্রগুলো শিখে সেগুলো গানে ব্যবহার করার চিন্তাও আছে তাদের। তারা চান গানের মাধ্যমে বহুদূর এগিয়ে গিয়ে 'এফ মাইনর' ব্যান্ডকে নৃগোষ্ঠী নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে গড়ে তুলতে।