চাঁদের সম্পদ কেনাবেচা কি পৃথিবীর কোম্পানিগুলোর জন্য বৈধ?
চাঁদ নিয়ে নতুন করে প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো। এর ফলে বিজ্ঞানের যেমন উৎকর্ষ হচ্ছে, তেমনি খুলে যাচ্ছে কয়েক মিলিয়ন ডলারের নতুন ব্যবসার দুয়ার।
চাঁদের বিভিন্ন খনিজ সম্পদ থেকে অর্থ আয়ের চেষ্টা করছে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশ ও বড় কোম্পানিগুলো।
২০১৮ সালের একটি গবেষণার বরতা দিয়ে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) অনুমান করেছে, ২০৪৫ সাল পর্যন্ত চাঁদের বিভিন্ন সম্পদের ব্যবসার মাধ্যমে বার্ষিক ৭৩ থেকে ১৭০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।
চাঁদের মেরুতে পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া চন্দ্রপৃষ্ঠে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ। আমাদের একমাত্র এ উপগ্রহে স্থায়ীভাবে মানুষের বসতি বা আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহারের জন্য এসব উপাদান ব্যবহার করা হবে।
ভবিষ্যতে প্রযুক্তির আরও সমৃদ্ধির মাধ্যমে চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর একটি সিল্ক রোড তৈরি হতে পারে। চাঁদে রয়েছে হিলিয়াম-৩, যা পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ার প্রধান উপাদান।
চাঁদের এসব সম্পদে ভাগ বসাতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন একে অপরেরে সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর এ লক্ষ্যে তারা এত দ্রুত নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে যে, চাঁদ বা মহাকাশের সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনও তাল মিলিয়ে উঠতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এ গ্যালাক্সি খুব দ্রুতই নতুন বুনো পশ্চিম হয়ে উঠতে পারে।
চাঁদের সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র বা বেসরকারি কোম্পানি এগুলোর মালিকানা দাবি করতে পারে কি না। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এ নিয়ে হওয়া আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশ নিজের মতো করে মহাশূন্যের চাঁদ বা অন্য কোনো মহাজাগতিক বস্তুর ওপর দখলদারিত্ব চালাতে পারবে না।
ল ফার্ম হোগান লোভেলস-এর জ্যেষ্ঠ অ্যাসোসিয়েট ভিক্টর ব্যারিও বলেন, ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস ট্রিটি অনুযায়ী, মহাজাগতিক বস্তুর মালিকানা পৃথিবীর কারও নেই।
তবে এ চুক্তি অনুযায়ী চাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ নয়। মহাকাশ আইন বিশেষজ্ঞ রাফায়েল হারিলো বিষয়টি ব্যাখা করেছেন এভাবে: 'সমুদ্র সবারই, কিন্তু মাছ কেবল যিনি ধরেন তার।' অবশ্য এমন দর্শনও পুরোপুরি দ্বন্দ্বমুক্ত নয়।
তত্ত্ব পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও পরিস্থিতি তাত্ত্বিক পরিসীমা ছেড়ে বাস্তব হয়ে উঠলেই সমস্যা তৈরি হয়।
নাসা ও চীন উভয়ই চাঁদে স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে চাচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন হবে পানি, খনিজ উপাদান, শক্তির উৎস ইত্যাদি।
তাই গ্রহাণু বা উপগ্রহের সম্পদের অধিকার পেতে শক্তিশালী দেশগুলো এগুলোর ব্যবহারকে একতরফা আইনি ভিত্তি দেওয়া শুরু করেছে।
২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত অ্যাস্টেরয়েডস অ্যাক্ট-এর অনুমোদন দেয়। এ আইনের অধীনে মার্কিনীরা চাঁদ বা অন্য মহাজাগতিক বস্তুর বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যের জন্য লাইসেন্স নিতে পারবেন।
এরপর ২০১৭ সালে লুক্সেমবার্গও এ ধরনের আইন তৈরি করে উপগ্রহের সম্পদভোগকে বৈধতা দিয়েছে। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, স্পেন ইত্যাদি দেশও একই পথে এগিয়েছে।
তবে একতরফা বা দেশভিত্তিক অধিকারলাভের চেষ্টার পাশপাশি বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মহাজাগতিক সম্পদ বণ্টনের প্রচেষ্টাও রয়েছে।
নাসা ও মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের তৈরি করা আর্টেমিস অ্যাকর্ডস-এ স্বাক্ষর করেছে আমেরকিরা প্রায় ৩০টির বেশি আন্তর্জাতিক মিত্র দেশ। এ চুক্তিতে যোগদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব দেশ যেন ভবিষ্যতের চন্দ্রাভিযানগুলোতে অংশ নিতে পারে।
মহাকাশ গবেষণায় সহযোগিতামূলক গাইড হিসেবে কাজ করে এ ধরনের বহুপাক্ষিক চুক্তিগুলো। তবে ভিক্টর ব্যারিও বলেন, এ ধরনের চুক্তিগুলো মহাকাশের সম্পদ আহরণের বিষয়টিকেও একপ্রকার স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। কারণ এসব চুক্তির ফলে কোনো দেশের একক দখলদারিত্বের বিষয়টি অনুভূত হয় না।
মহাকাশ অর্থনীতিও ক্রমে চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অনেক বড় কোম্পানি ইতোমধ্যে এ খাতে বড় বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। অনেকেই বিভিন্ন উপগ্রহ বা গ্রহাণুতে থাকা প্লাটিনাম, সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু সংগ্রহের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করছে।
তবে এ ধরনের কোনো সাফল্য দেখতে হলে আমাদেরকে আরও দুই দশক অপেক্ষা করতে হতে পারে। কিন্তু চাঁদে এ ধরনের বিভিন্ন প্রকল্প আগামী দশকেই শুরু হয়ে যেতে পারে।
চান্দ্র অর্থনীতি আমাদের সামনে অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছে যেগুলোর কোনো উত্তর আমাদের এখনো জানা নেই। একটি বড় প্রশ্ন হলো, এ খাতে কোনো আর্থিক অংশ না থাকা দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেওয়া হবে।
এক্ষেত্রে কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, একটি ট্যাক্সভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত যার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর ঘাটতি পোষানো যাবে। আবার অনেকে মনে করেন, মহাকাশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত বিভিন্ন উন্নত দেশের আবিষ্কৃত মহাকাশ প্রযুক্তি থেকে সারা বিশ্বের মানুষ অনেক আগে থেকেই সুবিধাভোগ করছেন।
বলা হচ্ছে, পৃথিবীর সপ্তম মহাদেশ হয়ে উঠবে চাঁদ। চাঁদকে মহাদেশ হিসেবে দেখার ধারণা তৈরি হয়েছিল আরও অর্ধশতক বছর আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নে (রাশিয়া ইউরেশিয়াকে একক মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করে)।
সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মিশন পরিচালনার হিড়িক পড়ে যাওয়ার পর এ ধারণা নতুন করে হালে পানি পাচ্ছে। রাশিয়া ব্যর্থ হলেও চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করেছে ভারত।