ডুবে যাওয়া সোভিয়েত সাবমেরিন উদ্ধারে সিআইএ’র দুর্ধর্ষ অভিযান
১৯৬৮ সালের মার্চ মাস। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে স্থাপিত হাইড্রোফোনে পানির তলায় দুটো বড় বিস্ফোরণ ধরা পড়ল। হাইড্রোফোনের তথ্য থেকে জানা গেল, কামচাটকা পেনিনসুলার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে সমুদ্রগর্ভে একটি সাবমেরিন বিধ্বস্ত হয়েছে।
ওই সাবমেরিনটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের, নাম কে-১২৯। নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে পেট্রোপাভলস্ক ঘাঁটি ছেড়ে বেরিয়েছিল সাবমেরিনটি। খুব একটা আধুনিক সাবমেরিন না হলেও এর ভেতরে ছিল এক মেগাটন ওজনের তিনটে পারমাণবিক মিসাইল। এক-একটা মিসাইল কোনো শহরকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট।
সোভিয়েত নৌবাহিনী দ্রুতই একটি উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠাল সম্ভাব্য বিস্ফোরণস্থলের দিকে। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসল মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থাগুলো। কিন্তু সোভিয়েত উদ্ধার অভিযানে সাফল্য পাওয়া গেল না।
ওই স্থানে সমুদ্রের গভীরতা প্রায় পাঁচ হাজার মিটার। দুই মাসের অসফল চেষ্টার পর সোভিয়েত মিশনটি বন্ধ ঘোষণা করা হলো। কে-১২৯ ও এটির ৮৩ ক্রু-মেম্বারের সলিলসমাধি হয়েছে ধরে নেওয়া হলো। জানাও গেল না ঠিক কীভাবে ডুবোজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছিল।
এসব ঘটনায় আগ্রহ তৈরি হলো মার্কিন নৌবাহিনীর মধ্যে। ছয় মাস পরে ইউএসএস হ্যালিবাট নামক একটি সাবমেরিনকে পাঠানো হলো সমুদ্রের ওই এলাকায়। এটির মিশন — হাইড্রোফোনের নির্দিষ্ট করা সম্ভাব্য বিস্ফোরণস্থল থেকে কে-১২৯-এর ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করা ও ছবি তোলা।
হ্যালিবাট আগে ছিল পারমাণবিক শক্তিচালিত একটি সাবমেরিন। কিন্তু 'বিশেষ অপারেশন' নাম দেওয়া এ গোয়েন্দা মিশনের জন্য ডুবোজাহাজটির খোলনলচে বদলে ফেলল মার্কিনীরা।
হ্যালিবাটের মিসাইল নিক্ষেপের স্থানটি সরিয়ে সেখানে প্রিসিশন স্যাটেলাইট টার্গেটিং সিস্টেম, অত্যাধুনিক সোনার সিস্টেম, একটি ইউনিভ্যাক কম্পিউটার, এবং ডুবোজাহাজ থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে নজরদারি চালানোর জন্য ক্যাবল-নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি পড বসানো হলো। ওই পডগুলোর নাম রাখা হয়েছিল 'দ্য ফিশ' — প্রতিটার ওজন ছিল দুই টনের মতো এবং একটি বানাতে খরচ পড়েছিল পাঁচ মিলিয়ন ডলার।
পরের দুই মাস হ্যালিবাট ওই এলাকা চষে বেড়াল। কে-১২৯-এর ধ্বংসাবশেষের সন্ধানে পডগুলো দিয়ে সমুদ্রের বুকে অনুসন্ধান চালানো হলো। সমুদ্রের গভীরে সম্পূর্ণ অন্ধকারে কয়েক কিলোমিটার লম্বা ক্যাবলের সঙ্গে বাঁধা পডগুলো কয়েক হাজার ছবি তুলল।
কিন্তু বেশিরভাগ ছবি থেকেই কিছু বোঝা যায় না। শেষপর্যন্ত একটা ছবি আশার আলো জ্বালাল — ছবিটিতে ধরা পড়েছে একটি সাবমেরিনের টারেটের খানিকটা অংশ।
কয়েকটি ছবি একসঙ্গে জুড়ে সার্বিক দৃশ্যটি তৈরি করা হলো। তখন স্পষ্ট হয়ে উঠলো কে-১২৯, বিস্ফোরণের ধাক্কায় মাঝখানে ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গিয়েছে। সামনের অংশটুকু (বো) প্রায় ১০০ ফুট লম্বা। অন্যদিকে পেছনের অংশ (অ্যাফ্ট) প্রপেলারের যন্ত্রপাতিসহ বেশ কয়েকমিটার দূরে পড়ে ছিল।
সাবমেরিনটির টারেটের যে অংশে তিনটি মিসাইল থাকার কথা, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটা টিউবের কোনো চিহ্ন নেই, খুব সম্ভবত বিস্ফোরণের কারণে হারিয়ে গেছে। আরেকটা টিউব দেখে মনে হলো ভেতরটা ফাঁকা। কিন্তু তৃতীয় টিউবের ভেতর তখনো মিসাইল অক্ষত ছিল। আর ডুবোজাহাজটির ভেতরে এনক্রিপ্টেড ট্রান্সমিটার ও বিভিন্ন কোডবুকও অক্ষত থাকার ব্যাপারে ধারণা করল ইউএসএস হ্যালিবাটের ক্রুরা।
সিআইএ ও নিক্সন
মার্কিন নৌ-কর্তৃপক্ষ প্রথমে কে-১২৯-এর গায়ে ছিদ্র করে রোবট পাঠিয়ে কিছু জিনিসপত্র সংগ্রহ করার চিন্তা করল। কিন্তু এ পরিকল্পনা দ্রুতই বাতিল হলো। কারণ অনেক পুরোনো মডেলের এ সাবমেরিনের ভেতর থেকে যা পাওয়া যাবে তা দিয়ে এ কাজের খরচ ও জটিলতা পোষানো যাবে না। ততদিনে কে-১২৯ ডোবার তিন বছর পার হয়ে গিয়েছে। এর ভেতরের বিভিন্ন জিনিসপত্র, বিশেষ করে এর মিসাইলগুলো তখনকার প্রযুক্তির তুলনায় সেকেলে হয়ে গিয়েছে।
এ খবর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র কানে গেল। এর বিশেষজ্ঞরা তখন আরও দুর্ধর্ষ একটি মিশনের পরিকল্পনা করলেন। কেবল অল্পকিছু জিনিস সংগ্রহের বদলে মিসাইল, টর্পেডো ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ সাবমেরিনটির সম্পূর্ণ অগ্রভাগ তুলে আনলে কেমন হয়? এ খবর তৎকালীন সেক্রেটারি অভ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন পর্যন্ত পৌঁছাল। দুজনেই এমন মিশনের কথা শুনে আগ্রহী হলেন, মিলল অনুমোদনও।
সিআইএ তখন বিশাল একটি জাহাজ তৈরি করতে শুরু করল। এ জাহাজটি ব্যবহার করেই সাবমেরিনটি সামনের অর্ধেক পানির ওপর তোলা হবে। ডেস্ট্রয়ারের চেয়েও বড় ১৮০ মিটার লম্বা ওই জাহাজটির সামনে-পেছনে দুই অংশেই প্রপেলার ছিল।
বলা বাহুল্য, পুরো প্রকল্পটিকে সর্বোচ্চ গোপনীয় হিসেবে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এমন বড় আকারের জাহাজতো একেবারে গোপনে তৈরি করা যায় না, তাই এটি বানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সিআইএকে একটি গল্প ফাঁদতে হলো। আর এ কাজের জন্য বেছে নেওয়া হলো খেয়ালি মার্কিন ধনকুবের হাওয়ার্ড হিউজকে।
সমুদ্রের গভীরে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য একটি শেল কোম্পানি খুলতে রাজি হলেন হিউজ। জাহাজটির নামও রাখা হলো তার নামে: দ্য হিউজ গ্লোমার এক্সপ্লোরার।
সিআইএ একইসঙ্গে লকহিড মার্টিন-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করল। স্পাই প্লেন তৈরিসহ নানা গোপন প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে কোম্পানিটির। দানবাকৃতির একটি ধাতব নখর তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হলো লকহডিকে। এ নখর দিয়েই সাবমেরিনটিকে টেনে ওপরে তোলা হবে।
রাশিয়ার সন্দেহ
প্রায় চার বছর ধরে প্রস্তুতি চলার পর অবশেষে ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে মিশন পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হলো দ্য গ্লোমার এক্সপ্লোরার। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার পরপরই একটি সোভিয়েত গবেষণা জাহাজের নজরে পড়ল মার্কিন জাহাজটি।
জাহাজের গায়ে অ্যান্টেনা থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত জাহাজের ক্রুদেরকে মার্কিনীরা বোঝাতে পারলেন, তাদের গ্লোমার এক্সপ্লোরার স্রেফ সমুদ্রের নিচে খনিজ অনুসন্ধান করছে। সোভিয়েত ক্যাপ্টেন এ ধাপ্পা ধরতে তো পারলেন-ই না, উল্টো যাওয়ার আগে মার্কিন জাহাজটিকে শুভকামনা জানিয়ে গেলেন।
ধাতব নখরটিকে সমুদ্রের বুকে নামাতে সময় লেগেছিল কয়েক সপ্তাহ। এক হাজার মিটার পর্যন্ত নামানোর পর আবারও রাশিয়ার একটি ডিপ-সি টাগবোট ঘটনাস্থলে হাজির। কিন্তু এবারও একই কথা বলে রাশিয়ানদের প্রবোধ দিতে পারলেন মার্কিনীরা।
প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ান
অবশেষে কে-১২৯ পর্যন্ত পৌঁছাল মার্কিন যন্ত্রপাতি। সাবমেরিনের গায়ে আঁকড়ে বসল ধাতব নখর। হাইড্রলিক পিস্টন ব্যবহার করে সমুদ্রের মেঝে থেকে ধীরে ধীরে ওপরে তোলা শুরু হলো কে-১২৯-এর সামনের অংশকে। পাঁচ কিলোমিটার ওপরে জাহাজে বসে ভিডিও ও সোনারের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থার ওপর নজর রাখছিলেন মার্কিন ক্রুরা।
দুই কিলোমিটার ওপরে ওঠার পর থাবার কিছু অংশ সাবমেরিনের দেহকাঠামো থেকে ছুটে গেল। সাবমেরিনের অর্ধেক অংশ ভেঙে আরও দু-টুকরো হয়ে গেল। বড় অংশটুকু খুলে পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করল, সেই সঙ্গে নিয়ে গেল মিসাইল কাঠামোটুকুও। সমুদ্রের তলদেশে পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে গেল এটি।
শেষ পর্যন্ত কেবল খানিকটা অংশই উপরে তুলতে পেরেছিল দ্য গ্লোমার এক্সপ্লোরার। সেখান থেকে কিছু টর্পেডো পাওয়া গেলেও যোগাযোগের কোনো যন্ত্র বা কোডবুক পাওয়া যায়নি। নিদেনপক্ষে সিআইএ সেটাই জানিয়েছিল।
কে-১২৯-এর ছয়জন ক্রুয়ের দেহাবশেষও পাওয়া গিয়েছিল অবশ্য। গ্লোমার এক্সপ্লোরারে রাশিয়ান ও মার্কিন পদ্ধতিতে তাদের শেষকৃত্য করে মৃতদেহগুলো আবারও সমুদ্রে বিসর্জন দেওয়া হলো। শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানটি সিআইএ-এর লোকেরা ভিডিওতে ধারণ করেছিলেন, বেশ কয়েকবছর পরে সেটি রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া হয়। অবশ্য অপারেশনের অন্য অংশগুলোর ভিডিও সিআইএ কখনো প্রকাশ করেনি।