শাহিন আলমের রুটির ঝুড়ির সংক্ষিপ্ত, ভাইরাল খ্যাতি
ঢাকা এমন একটি শহর যেখানে জীবন এক অবিরাম গতিতে এগিয়ে যায়, প্রত্যেকে নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে অক্লান্ত ছুটে চলে। এমন ব্যস্ততম শহরের সাম্প্রতিক এক ভাইরাল ছবি অনেকের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, এক চায়ের দোকানের মালিক মুখে হাসি নিয়ে চা বানাচ্ছেন। তার পেছনে অর্গানিক (রাসায়নিক মুক্ত) খাদ্যপণ্যের ব্যানার।
তবে যে জিনিস সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো, দোকানের সামনে রাখা একটি সাধারণ ঝুড়ি। যে ঝুঁড়িতে লেখা, 'টাকা নেই? চিন্তা করবেন না, ঝুড়ি থেকে বিনামূল্যে এক টুকরো রুটি খান'।
ছবিতে থাকা লোকটি হলেন শাহিন আলম। বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন স্নাতকোত্তর পাশ করা শাহিন। অন্যান্য চাকরিরও চেষ্টা করেন। তবে এক পর্যায়ে এসে রাজধানীর কাঠালবাগানে চা দোকান দিয়ে বসেন তিনি।
দুর্ভাগ্যবশত, রুটির ঝুড়ি এখন আর নেই, নেই চায়ের স্টলও। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড শাহিনের কাছে তার গল্প এবং কেন চায়ের স্টোভের আগুন বন্ধ হয়েছে তা জানতে চেয়েছে।
শাহিনের জন্ম কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায। এসএসসি পরীক্ষার পর তিনি বাগেরহাটে আসেন। এসময় তার পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে এবং শাহিনের খরচ বহন করতেন তার বড় ভাই।
মেসে রাখার সামর্থ্য না থাকায় তাকে নিজের কাছে রাখেন বড় ভাই। সেখানে থেকেই বাগেরহাটের পিসি কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তার সম্পন্ন করেন শাহিন।
২০১৪ সালে মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর তিনি বিসিএসের প্রস্তুতি নেন, তবে পাশ করতে পারেননি। ২০১৯ সালে তিনি ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল-এ ১২,০০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন।
এরপর সীমিত পুঁজি নিয়ে ২০২০ সালের নভেম্বরে তিনি সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং ল্যাবএইড হাসপাতালের মাঝের রাস্তার পাশে চায়ের দোকান খোলেন। চা দোকান খোলায় পরিবারের মত ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে গিয়েই দোকান খুলতে হয়েছে বলে জানান শাহিন।
শাহিন যখন প্রথম ঢাকায় আসেন, তখন অনেক ক্ষুধার্ত দিন কেটেছে তার। খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। শাহিন বলেন, 'আমি চাইনি অন্য কোন ব্যক্তি একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাক।' তাই, তিনি তার দোকানের বাইরে রুটির ঝুড়ি রেখেছিলেন।
দেড় বছর চায়ের দোকান চালানোর পর শাহিন মধু, ঘি, ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের মতো অর্গানিক পণ্য বিক্রির কথা চিন্তা করেন। কাঁঠালবাগান কিচেন মার্কেটের কাছে একটি দোকান ভাড়া নেন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। এক বছরেও বেশি সময় চলার পর পাঁচ মাস আগে সে ব্যবসা বন্ধ করে দেন শাহিন।
তিনি বলেন, 'আমার যা কিছু ছিল তা এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি।' শাহিন জানান, সততার জন্য গ্রাহকরা তাকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু তাদের চাহিদা মেটানো ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।
'ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করার মতো ব্যবসা হতো না আমার', ব্যাখ্যা করেন শাহিন।
এখন তিনি একটি আইনি সংস্থায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এখনও শাহিন একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয়ভাবে তহবিল খুঁজছেন।
দাম বৃদ্ধির কারণে অর্গানিক ব্যবসা কঠিন হয়ে ওঠে। গ্রাহক হারাতে থাকেন শাহিন। তিনি বলেন, যখন সবকিছুর দাম বেড়ে যায়, তখন আমার পণ্যগুলি সাধারণ গ্রাহকদের জন্য হয়ে ওঠে বিলাসিতা।
হতাশাজনক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও, তিনি তার নীতির সাথে আপস করতে চান না। শাহিন বলেন, 'আমি আমার ব্যবসা সততার সাথে এবং নৈতিকভাবে পরিচালনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এমনকি যদি এর জন্য তাৎক্ষণিক মুনাফাও হারাতে হয়।'
শাহিনের উপর তার গ্রাহকদের আস্থা কাজে লাগাতে কিছু ভুয়া কোম্পানি তাকে তাদের পণ্য বিক্রি করতে বলেছিল। শাহিন জানান, নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করা এসব কোম্পানির অফার তিনি গ্রহণ করেননি।
'আমি সেই লোক যে তার লাভের ২ শতাংশ ঝুড়িতে রাখি। আমি মানুষের আস্থা এবং ভালবাসা অর্জন করেছি, আমি সেগুলি নষ্ট করতে পারি না।'
তার রুুটির ঝুড়ির গল্প যেদিন ভাইরাল হয়, পরদিন সকালে উঠে দেখেন তার ফোনে অনেকগুলো নোটিফিকেশন, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও এসেছে অনেক। এক নারী ফেসবুকে তার ছবি পোস্ট করেন। শাহিন বলেন, বিষয়টা কিছুটা অস্বস্তিকর। কারণ এখন আমার দোকানটি নেই, অথচ তা ভাইরাল হয়েছে।
নতুন করে শুরু সহজ হবে না। তবে শাহিন আলম মনে করেন, ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু তিনি শিখেছেন।
'দেখুন, আমি ব্যর্থ হয়েছি এবং এর মানে এই নয় যে আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। আমি অনেক কিছু শিখেছি। এখন আমি ব্যবসার ভেতর-বাহির জানি। কিন্তু আমি এখন আমার জ্ঞান ব্যবহার করতে পারছি না', দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলেন শাহিন।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অনুরাগী হিসেবে, থিঙ্ক অ্যান্ড গ্রো রিচ, মিরাকল মর্নিং, রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড এবং জিরো টু ওয়ানের মতো বইগুলি তাকে পথ দেখিয়েছে। এই প্যাশনের বিষয়টি শাহিন তার ছোট ভাইয়ের সাথেও শেয়ার করেছেন। তার ছোট ভাইও সাহিত্যের ছাত্র।
আইনি সংস্থায় শাহিন ঢাকার বাইরে নথি-সম্পর্কিত তথ্য যাচাই-বাছাই এর কাজগুলি করেন। তাকে তাৎক্ষণিক খরচ দেওয়া হয়।
কিছু মানুষ তাকে সাহায্য করতে চান। তাদের মধ্যে একজন মালয়েশিয়ান প্রবাসী আছেন। অনেকে তার ব্যবসায় অর্থায়ন করতে চেয়েছেন। তবে সবকিছু না মেলায় শাহিন এগুতে চাননি।
শাহিন বলেন, আমার একজন পরিচিত ব্যক্তি অর্থায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন তার মতো করে যাতে ব্যবসা চালাই, কিন্তু আমি তা চাই না। আমি এমনকি ৬০ শতাংশ শেয়ার দিতেও প্রস্তুত, কিন্তু ব্যবসা আমার নিজের শর্তে চালাতে দিতে হবে।
'আমার কাছে কেবল ব্যক্তিগত অর্জনই সাফল্যের মাপকাঠি নয়, সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলাও সাফল্য।'