জন্মবধির শিশুদের জীবন যেভাবে শব্দময় হয়ে উঠছে
অর্পার বয়স যখন এক বছর তখন থেকেই বাবা-মা বুঝতে পারেন মেয়েটা কিছুটা অস্বাভাবিক। সে কানেও শুনতে পায়না, কথাও বলতে পারেনা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকও জানান অর্পা সম্পূর্ণ বধির হয়ে জন্মেছে। অর্পার মতো যখন একটি শিশু একাধারে কানেও শোনে না, কথাও বলে না, তখন আমরা ধরে নিই, সে বধির ও মূক। কিন্তু বিষয়টি সবসময় এমন নয়। যেহেতু সে কানে শোনে না, তাই তার মস্তিষ্কে কোনো শব্দ এসে পৌঁছায় না। ফলে কোনো অর্থযুক্ত শব্দ সে উচ্চারণ করতে পারে না। যদি কোনোভাবে তার মস্তিষ্কে শব্দ পৌঁছানো যায়, তাহলে সে শুনতেও পারবে এবং একসময় সে অর্থযুক্ত শব্দের মাধ্যমে কথাও বলতে পারবে।
অর্পার কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে শব্দ ঢোকানোর এই কাজটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল চিকিৎসক। যার ফলে আর দশটা মানুষের মতোই অর্পা এখন কানে শুনতে পারে, কথাও বলতে পারে। শুধু তাই নয়, উনিশ বছর বয়সী অর্পা এ বছর এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে বর্তমানে ঢাকা কমার্স কলেজে পড়ছে।
বাংলাদেশি সার্জন দিয়েই দেশে প্রথম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয় অর্পার কানে
অর্পা যে চিকিৎসা সেবাটি নিয়েছে চল্লিশ বছর আগেও সেটি এতটা জনপ্রিয় ছিল না। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার নাম 'কক্লিয়ার ইমপ্লান্টেশন'। যা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয় ১৯৮৫ সালের দিকে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে শুরু হয় ১৯৯৫ সালের দিকে। আর বাংলাদেশে শুরু হয় ২০০৬ সালের দিকে। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে হাতে গোনা দু'একটি পরিবার নিজ ব্যয়ে বিদেশি সার্জন এনে ঢাকাতে ইমপ্লান্ট স্থাপন করাতো। আবার কোনো কোনো পরিবার বিদেশে গিয়ে এই অপারেশন করাতো।
বাংলাদেশি সার্জন দিয়ে দেশে এ চিকিৎসাসেবা শুরু হয় ২০০৯ সালে। আর সেটি ছিল অর্পার ডান কানে। ২০০৯ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অর্পার ডান কানে সফল অস্ত্রোপচার করে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করেন অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদারের নেতৃত্বে এক দল চিকিৎসক।
অর্পার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কিনতে ব্যয় হয় পনের লক্ষ টাকা, যা তার পরিবার ও আত্মীয় বন্ধুদের সহায়তা থেকে আসে। হাসপাতাল ও চিকিৎসকের খরচ বিনামূল্যে করা হয়। এটিই ছিল বাংলাদেশি সার্জনদের দিয়ে দেশে প্রথম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন।
অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা এখন সম্ভব হচ্ছে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যেই
বর্তমানে বিশ্বে চারটি কোম্পানি মানসম্পন্ন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট তৈরি করে। তাদের মধ্যে অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা- এ তিন দেশের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয়।
একটি বেসিক মডেলের কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের গড় মূল্য দাঁড়ায় নয় থেকে দশ লাখ টাকা। উচ্চতর মডেলের ক্ষেত্রে এর মূল্য বিশ ত্রিশ লাখ টাকা হয়ে থাকে। এই মূল্য আমাদের মতো দেশে বেশিরভাগ পরিবারেরই নাগালের বাইরে। তাই এসব শিশুদের জন্য ২০১০ সালে সরকার প্রথম 'ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ' নামক কর্মসূচি চালু করে।
এই কর্মসূচি পরিচালনার পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান গলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার। তিনি বলেন, 'কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অবদান। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই এপর্যন্ত সাড়ে সাতশো শ্রবণ প্রতিবন্ধীর কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করা হয়েছে। দু-এক ভাগ ছাড়া তারা সবাই ভালো ভাবে কানে শুনতে ও কথা বলতে পারছে, এবং বেশিরভাগ শিশু মূলধারার বিদ্যালয়ে অধ্যায়নের সক্ষমতা অর্জন করেছে।'
দেশের দরিদ্র ও সাধারণ পরিবারের শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শ্রবণ সহায়তার সাহায্যে নতুন জীবন দিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এটি চালু হয়। মূলত অর্পাকে উদাহরণ হিসেবে ধরেই এ কর্মসূচি শুরু হয়।
এ কর্মসূচি থেকে সরকারি অর্থে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস প্রদান, অপারেশন ও অপারেশন পরবর্তী ভাষা শিক্ষা সহ সব সেবা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অল্প যা কিছু খরচ হয়, সেটিও রোগীর পরিবারের আয়-সাপেক্ষে হয়ে থাকে। রোগীর পরিবারের মাসিক আয়ের কাগজপত্র দেখে কস্ট-শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবার খরচ বহন করে থাকে। যাদের সামর্থ্য একেবারেই কম, তারা নামমাত্র মূল্যেই এই সেবা পাচ্ছে।
এখনও অনেককে বেগ পেতে হয় এ চিকিৎসার খোঁজ পেতে
তাদের মধ্যে একজন, নিশাত। সবসময় উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতো, ডাকলেও সাড়া দিত না। কয়েকমাস পর তার বাবা-মা বুঝতে পারেন, কানেই শুনতে পায়না তাদের নিশাত।
এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সদর হাসপাতালে। সেখানে জানানো হয় নিশাত বধির। বাসায় এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিশাতের বাবা। এরপর ঢাকার ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান নিশাতকে। সেখানে তাকে নিয়মিত সেশন এবং একটি হিয়ারিং এইড দেওয়া হয়। ২০১১ সালের আগস্টে অকস্মাৎ মারা যায় নিশাতের বাবা। নিশাতের মা সৈয়দা মুজিরা তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। আর নিশাতের বয়স কেবল দুই বছর। আর আরেক মেয়ে মুজিরার গর্ভে।
একাহাতে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়িয়েছেন। কিন্তু সেসময় কেউই তাকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের কথা বলেনি। একদিন তার বান্ধবী ট্রেনে অপরিচিত এক শিশুর কানে একটি মেশিন খেয়াল করে। শিশুটির মা'কে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় এটি বধিরদের জন্য একটি ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা।
কিন্তু বান্ধবীর কাছ থেকে এই চিকিৎসার নাম বা বিস্তারিত কোনো তথ্য জানতে পারেননি মজিরা। তিনি কেবল জানতেন, ট্রেনের ওই শিশুর মা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সূর্যমুখী স্কুলের শিক্ষক। শুধু এতটুকু জেনেই মজিরা সেই স্কুল শিক্ষককে খুঁজতে শুরু করেন। একদিন পেয়েও যান। এরপর তার থেকেই জেনে নেন কীভাবে কী করতে হবে।
তখন নিশাতের বয়স ২ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আউটডোরে তাকে দেখানো শুরু হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় থেকেও একসময় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি এলো। হাসপাতাল থেকে মজিরার সাথে যোগাযোগ করা হলো। তিনিও দেরি না করে আবেদন করে ফেলেন। এরপর বাছাই পর্ব শুরু হয়।
বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে করতে প্রায় একটা বছর প্রায় চলে যায়। টাকাও চলে যায় লাখখানেকের মতো। নিজে চাকরিও করতেন না তখন। কল্যাণ তহবিলের কিছু টাকা, জমানো টাকা আর টিউশনের টাকা দিয়ে স্বামী হারা ও দু সন্তানের জননী সৈয়দা মুজিরা লড়ে যান।
২০১৩ সালে অপারেশন হলো। সে-বার আবেদন করা ৫০ জনের মধ্যে ৪-৫ জনকে বাছাই করা হয়। তারমধ্যে একজন ছিল নিশাত। বর্তমানে সে মূলধারার স্কুলেই সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে।
'সুফল পেতে ইমপ্লান্ট করতে হবে এক থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যে'
অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার জানান, 'কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের উৎকৃষ্ট উপকারিতা সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্য কিছু হিয়ারিং সেন্টার বা প্রতিষ্ঠান এরকম সম্পূর্ণ বধিরদেরকে শুধুমাত্র হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে থাকে। এক্ষেত্রে হিয়ারিং এইড আসলে একেবারেই ফল্প্রসূ হয়না। আবার অনেকে ব্যয়বহুল হওয়ায় বা প্রযুক্তি সহজলভ্য নয় বলে কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের সন্ধান দেন না।'
'ফলে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুর বাবা মায়েরা কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কেন্দ্রে আসতে দেরি করে ফেলেন। পাঁচের ওপর চলে যায় শিশুর বয়স। পাঁচ বছর বয়সে ব্রেনের নিউরাল প্লাসটিসিটি হ্রাস পায়, ফলে এই সার্জারির কার্যকারিতাও কমে যায়। জন্মগতভাবে সম্পূর্ণ বধিরদের ক্ষেত্রে এক থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করতে পারলে ফলাফল সবচেয়ে ভালো হয়।'
২০১৯ সালের জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে বিভিন্ন মাত্রায় ৯.৬ ভাগ মানুষের বধিরতা আছে। এর মধ্যে ১.২ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ বধিরতায় আক্রান্ত। ১৫ বছরের নিচে বধিরতায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা ৬ শতাংশ। তবে সকল মাত্রার জন্য আবার কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না তা নিশ্চিত হতে শিশু বা ব্যক্তির শ্রবণ বধিরতার মাত্রা দেখার জন্য প্রথমে কিছু অডিওলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল টেস্ট করা হয়।
এই টেস্টের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির। প্রতিটি শিশুকে সঠিক উপায়ে যাচাই-বাছাই করা হয়। সঠিক শিশু বাছাই করা না যায়, সেক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এরপর রোগীর সাইকোলজিক্যাল ও জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার উপযুক্ততার জন্য কিছু টেস্ট করা হয়। এরপর তাকে এই অপারেশনের জন্য উপযুক্ত ধরা হয়।
প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার বাক বা শ্রবণহীন শিশুর কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে সারাদেশের সরকারি বেসরকারি সবগুলো হাসপাতাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ প্রায় পাঁচ শত শিশুকে এই সেবা দেওয়া যায় বছরে। যারা সরকারিভাবে ডিভাইসটি পাননা, তাদের ডিভাইসটির পূর্ণ ব্যয় নিজেরা বহন করতে হয়। তবে অপারেশন এবং হাসপাতালের খরচটুকু বিনামূল্যে করানো হয়।
পাঁচ বছরের মধ্যে বয়স হলে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়
বয়স্করাও নানা কারণে বধির হয়ে থাকেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভাইরাল ফিভার (ভাইরাসজনিত জ্বর)। তখন তাদেরও কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রয়োজন হয়। পাঁচ বছরের অধিক শিশুদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা অনেকটা কমে আসে। তাই বাছাই করার সময়ও পাঁচের নিচে যারা আছে তাদের আগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সবশেষে সুযোগ দেয়া হয় পূর্ণবয়স্ক বধিরদের ।
এ অপারেশনের পর শিশুদের প্রায় এক থেকে দুই বছর কাটাতে হয় স্পিচ থেরাপিস্টের অধীনে। অপারেশনের ২-৩ সপ্তাহ পর শিশুর কানে লাগানো মেশিনের সুইচটি অন এবং ম্যাপিং করে যথার্থ শব্দ শোনার বিষয়টি নিশ্চিত হতে হয়। এটি অন করার পর প্রথমবারের মতো বা শিশুর কানে শব্দ পৌঁছায় এবং সে শব্দের জগতে প্রবেশ করে। এরপর ইমপ্ল্যান্ট গ্রহীতা শিশুকে স্পিচ থেরাপিস্ট দিয়ে শব্দ শোনা ও ভাষা শেখানো হয়। যাকে বলা হয় হ্যাবিলিটেশন। সেখানে শিশুর বাবা-মায়েদেরও সেশন নিতে হয়।
স্বাভাবিক শিশুদের ক্ষেত্রে কথা ফুটতে যেমন প্রায় দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। এসকল শিশুদেরও তেমন সময় লেগে যায়। সুইচ অন করার পর যখন তাকে স্পিচ থেরাপি বা ক্লাসগুলো নেওয়া হয়, পুরো সময়টা তার মস্তিষ্কে শব্দগুলো জমা হতে থাকে তখন। একটা পর্যায়ে যখন মস্তিষ্কে তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়, তখন সে কথা বলতে শুরু করে। এভাবে একটা সময় সে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
তবে এই অপারেশন সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়। অপারেশন যেহেতু মস্তিষ্কে করতে হয়, সেক্ষেত্রে ইনফেকশন (সংক্রমণ) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বড় ইনফেকশন হওয়ার ঘটনা নগণ্য বলে জানান অধ্যাপক জোয়ারদার।
প্রথম শব্দ শুনতে পেয়ে হেসে দেয় নুসাইবা
শুধু কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমেই এই চিকিৎসা শেষ নয়, এ শিশুদের আজীবন কক্লিয়ার কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে।
অপারেশনের পর থেকে এখনও তাই নিয়মিত কক্লিয়ার কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন নুসাইবার মা রাওফা বিনতে নূর। প্রতিদিন কয়টা শব্দ শিখছে, কী কী উন্নতি ঘটছে সব লিখে রাখেন মা রাওফা। শ্রবণ প্রতিবন্ধী অন্য শিশুদের তুলনায় নুসাইবা একটু এগিয়ে আছে। যেখানে, সুইচ অন করার এক সপ্তাহের মধ্যে শিশুরা প্রথম শব্দ শোনে। সেখানে, নুসাইবা শুনেছিল ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই। প্রথম শব্দ শুনে খুব খুশি হয় সে।
২০১২ সালে বাবা-মায়ের কোল আলো করে আসে তাদের প্রথম ও একমাত্র সন্তান নুসাইবা। গর্ভকালীন মায়ের রুবেলা হওয়ায় বধির হয়ে জন্ম নেয় নুসাইবা। ডাক্তার একটি সাধারণ হিয়ারিং এইডের সহায়তা নিতে বলেন। যাতে করে নুসাইবা কিছুটা হলেও শুনতে পারবে। প্রথমদিকে শুনতে পেলেও, কিছুদিন পর মা খেয়াল করলেন নুসাইবা অতটুকুও আর শুনতে পারছেনা। তখন শেষমেশ ইশারা ভাষার দিকেই ঝুঁকলেন।
এর কিছুদিন পরেই বিটিভিতে থেকে জানতে পারলেন কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের কথা। সে অনুযায়ী সব কার্যক্রম শুরু করলেন। অন্যদের তুলনায় নুসাইবা ছিল একটু এগিয়ে। যেকারণে, অন্যরা যেখানে অপারেশনের পর থেরাপি নিতেন, সেখানে নুসাইবা থেরাপি নেওয়া শুরু করে অপারেশনের আগেই।
কেন শিশু জন্মবধির হয়?
নুসাইবার মায়ের গর্ভাবস্থায় রুবেলা হওয়ায় নুসাইবা জন্মবধির হয়ে জন্মায়। রুবেলার মতো গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের কোনো ধরনের ভাইরাস ইনফেকশন হয়, যেমন- মাম্পস, মিজলস হলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার কিছু বাচ্চার জন্মের পরই জন্ডিস, নিউমোনিয়া হয়। বিশেষ করে মেনিনজাইটিস (মস্তিষ্ক-ঝিল্লীর প্রদাহ) অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ফলে মস্তিষ্কে ইনফেকশন হয় এবং মস্তিষ্কে যে কানের অংশ আছে সেটি নষ্ট হয়ে যায়।
এমনটা হয় মিরপুরবাসী আদিয়ানের জন্মের সময়। আদিয়ানের জন্মের পরই তার নিউমোনিয়া হয়। ফলে বড় ভাইয়ের মতো সুস্থ হয়ে জন্ম নিলেও, নিউমোনিয়ার কারণে আদিয়ান তার শ্রবণশক্তি হারায়। ২০১৯ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে আদিয়ানের কানেও কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করানো হয়।
এসব ভাইরাজজনিত রোগ ছাড়াও এছাড়া গর্ভকালীন মা ড্রাগ বা মাদক ব্যবহার করলে, জন্মের সময় ফোর্স ডেলিভারি হলে, প্রসববেদনা অনেকক্ষণ ধরে থাকলে শিশুর শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া ডেলিভারি যদি দীর্ঘ সময় ধরে হয়, সে ক্ষেত্রে অনেক সময় বাচ্চাটা অক্সিজেন পায় না, ফলে তার শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। তাছাড়া রক্তের সম্পর্কে বিয়ে হওয়ার কারণটা তো আছেই!
সার্জারির পর স্পিচ প্রসেসর নষ্ট নিয়ে আরেক দুশ্চিন্তা…
কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রহীতারা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তাকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইসটি নিয়েই বাঁচতে হবে। বলা যায়, অনেকটা চশমার মতো। কিন্তু এই বেসিক স্পিচ প্রসেসরের দাম পাঁচ লাখ টাকা, উচ্চতর মডেলের দাম দশ লাখ টাকা- যা নিম্ন ও সীমিত আয়ের জনগণ ও চাকুরীজীবীদের হাতের নাগালের বাইরে। তাই স্পিচ প্রসেসর অকেজো হয়ে গেলে আবার সব ভুলতে বসে এসব শিশুরা। আর এখানেই দুশ্চিন্তা শুরু হয় বাবা-মায়ের।
যেমন তূর্য্যর বাবা মা। নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তূর্য্যর বাবা একজন পুলিশ কন্সটেবল, মা গৃহিণী। ২০১৩ সালে তূর্য্যের কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়। কিন্তু সমস্যা বাঁধে স্পিচ প্রসেসরেরটি তিন বছরের মাথায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায়। অন্যদের যেখানে স্পিচ প্রসেসরটি প্রায় টানা সাত আট বছর সেবা দিয়ে থাকে, তূর্য্যর সেখানে তিন বছরেই নষ্ট হয়ে যায় গোটা স্পিচ প্রসেসরটি।
মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে তালিকাভুক্ত হয়েও প্রায় দু বছর হতে চলছে প্রসেসর পাননি। ফলে, তূর্য্য এখন শব্দ শোনা এবং বলা দুটোই প্রায় ভুলতে বসেছে। স্কুলে প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তি হলেও, শ্রেণীতে তাকে দেওয়া হয়না কোনো বাড়তি মনোযোগ। ফলে ক্লাসে যা বলা হয় কিছুই ধরতে পারেনা সে। একবার, একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণ করেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগেরদিন শ্রেণীকক্ষে পরীক্ষার কথা বলা হয়েছিল। সবাই তা শুনতে পেলেও, তূর্য্য শুনতে পায়নি। ফলে সে পরীক্ষা দিতেও যায়নি। এভাবেই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দিনদিন।
তূর্য্যর বাবা জানান, 'দেরি করে ইমপ্ল্যান্ট হওয়ায় ডিভাইস দিয়েও তো স্বাভাবিক মানুষের মতো সব শুনতে-বলতে পারেনা। ডাক্তাররা বলেছে, ওর জন্য ইশারা ভাষা নিষেধ। কিন্তু ইশারা তো এসে যায়। এটা ছাড়া আর কীভাবে যোগাযোগ করব বলেন? ভাগ্য এতই খারাপ, পয়সাও নাই যে নিজ খরচেই একটা প্রসেসর কিনে দিব ছেলেটাকে।'
তুর্য্যের মতো রিমির জীবনও এখন দুশ্চিন্তাময়। রিমির মা গৃহিনী, বাবা গাড়ি চালায়। রিমিরা আগে থাকতো একতলার একটি বাসায়। কিন্তু এই অপারেশনের পর তারা এখন অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। যেন রিমির বেড়ে ওঠার পরিবেশ সুন্দর হয়। রিমির বাবা মাঝে গাড়ি চালানো ছেড়ে মেয়েকে ঘরে সময় দিতেন। কিন্তু এখন প্রসেসর অকেজো হয়ে যাওয়ায়, আবার সেই অনিশ্চয়তার জীবন শুরু।
এদিকে, নুসাইবা এখন অন্য আর দশটা শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে সব শোনে এবং কথা বলে। তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী নুসাইবা ভালোবাসে অন্যদের সাথে মিশতে, প্রাণ খুলে হাসতে, কথা বলতে। তবে ইদানিং নুসাইবার স্পিচ প্রসেসরটা কিছুটা ঝামেলা করছে।
এর আগে প্রসেসরটার তার নষ্ট হয়ে যায়। এরকম কোনো সমস্যা হলে হাজারখানেক খরচ হয়। ব্যাটারি নষ্ট হলে বিশ বাইশ হাজার চলে যায়। কিন্তু পুরো প্রসেসরটাই নষ্ট হয়ে গেলে বিপদ। মা রাওফা তাই ঘুম থেকে উঠে আগেই দেখে নেন প্রসেসরটি ঠিক আছে কি-না। বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছেন। এখনও পাননি নতুন প্রসেসর। তাই মেয়ের বর্তমানটা সুন্দর চললেও, ভবিষ্যৎ নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন থাকতে হয় মা-কে।
সরকারের পাশাপাশি বিত্তবান ও দানশীল ব্যক্তিবর্গকেও এগিয়ে আসতে হবে
অর্পা, রিমি, তূর্য্য, নুসাইবা এ-সব শিশুদের জীবন এখন নির্ভর করে আছে এই ব্যয়বহুল প্রসেসরটির ওপর। প্রসেসরটি নষ্ট হয়ে গেলেই আবার পথহারা হয়ে পড়েন এসব বাবা মায়েরা।
যদিও পুনরায় এই স্পিচ প্রসেসরটি দেওয়ার জন্য সরকারি বরাদ্দ আছে, আবেদন করা থেকে সরকারি বরাদ্দ অনুমোদন হয়ে স্পিচ প্রসেসরটি হাতে আসতেও লেগে যাচ্ছে কখনো এক বছর, কখনো বা দু বছর। দীর্ঘ অপেক্ষার মাঝেই এসব শিশুরা আবার শব্দের জগত থেকে সরে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছে।
এ বিষয়টি বাদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত সফলভাবেই স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বর্তমানে জাতীয় নাক কান ও গলা ইন্সটিটিউট, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-ঢাকা, সিলেট মেডিকেল কলেজ এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ সহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে এই সেবা চালু হয়েছে। এখন দরকার সীমিত আয়ের পরিবারের শিশুদের শব্দ শোনার স্পিচ প্রসেসরটি দ্রুত হাতে পাওয়ার ব্যবস্থা করা।
এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা যেখানে একসময় বিত্তবানদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে সরকার থেকে এই উদ্যোগ নেওয়ায় অনেক দরিদ্র বা সাধারণ পরিবারের শিশু আজ নিজেদের জীবন গড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলো, দানশীল ও বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে এসব শিশুদের সীমাবদ্ধতাগুলোও একদিন দূর হয়ে যাবে হয়তো।