জীবন বন্দী যানজটে
গত তিন এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্ট্রোকের রোগী নিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে যান অ্যাম্বুলেন্স চালক আব্দুস ছাত্তার। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় আসার পথে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছালেও মূল বিপত্তি ঘটে ঢাকায় প্রবেশের পরে। এয়ারপোর্ট রোডে এসে প্রায় তিন ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকেন। পরবর্তীতে পুলিশের সহযোগিতায় কিছু পথ উল্টো রাস্তা দিয়ে আসলেও সময় বেশি লেগে যাওয়ায় হাসপাতালে রোগী নামিয়ে বেডে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে রোগী।
অ্যাম্বুলেন্স চালক আব্দুস ছাত্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঢাকার যে অসহনীয় যানজট এতে নিয়মিতই রোগীদের নিয়ে ভয়ে থাকতে হয়। পাঁচ মিনিটের রাস্তা পার হতে ২ ঘণ্টাও লেগে যায় কখনো। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলেও করার কিছু থাকে না।'
শুধু আব্দুস ছাত্তার নয়, ঢাকার যানজটের কারণে প্রতিদিন মুমূর্ষু রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে নেয়ার পথে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন রাজধানীর অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা।
অধিকাংশ সময়ই যানজটের কারণে ট্রাফিক পুলিশকে অনুরোধ করে রোগী নিয়ে উল্টো পথে চলাচল করে অ্যাম্বুলেন্সগুলো। তবে যখন দুই পাশের রাস্তায়ই যানজট থাকে তখন করার আসলেও কিছু থাকে না।
যানজটের মধ্যে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে উল্টো পথকেই বেছে নিচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। রাস্তায় ইমার্জেন্সি লেন থাকার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। তাই নিয়মিতই উল্টো পথে চলতে বাধ্য হচ্ছে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স।
অ্যাম্বুলেন্স চালক সোহরাব আলী টিবিএসকে বলেন, 'রোগী গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে যানজট হলে তো সমস্যাই হয় কিন্তু তার আগে রোগীর পরিবারের ফোন পেয়ে তাদের ঠিকানা পর্যন্ত যেতেও যানজটে পড়তে হয়। যানজটে রোগী হাসপাতালে নিতে রাস্তায় দুই-তিন ঘণ্টা পার হয়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'একজন লোক স্ট্রোক করার পর কত সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন সে কথা ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও অনেক সময় যানজট ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারি না। অনেক সময় দেখি অসুস্থ রোগী অ্যাম্বুলেন্সে বেঁচে আছেন কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার বলছেন রোগী আর নেই।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'স্ট্রোকের চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যাবে, তত ভালো। স্ট্রোকের রোগীর জন্য প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঢাকা শহরে ট্রাফিক জ্যামের কারণে রোগীরা হাসপাতালে আসতে দেরি করে তাই আমরা গোল্ডেন আওয়ার কাজে লাগাতে পারিনা। স্ট্রোকের চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে রোগীর অন্য ডিসঅ্যাবিলিটি কম হয়। কিন্তু জ্যামের কারণে বেশিরভাগ রোগী স্ট্রোকের চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আসতেই পারেনা। ঢাকার বাইরে থেকে রোগীরা অ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত আসলেও ঢাকায় ঢোকার পর জ্যামের কারণে হাসপাতালে আসতে দেরি করে।'
ঢাকা মেডিকেলে নিয়মিত রোগী নিয়ে আসেন অ্যাম্বুলেন্স চালক ফারুক হাসান। তিনিও ঢাকার যানজটে রোগী নিয়ে নিয়মিতই পড়ছেন সমস্যায়। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের বাধ্য হয়ে রং সাইড ধরে চলতে হয়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে রোগী না থাকলে পুলিশ উল্টো পথেও যেতে দেয় না।'
এছাড়া খালি অ্যাম্বুলেন্স পুলিশ রাস্তায় আটকিয়ে হয়রানি করে বলেও অভিযোগ তার। তিনি বলেন, 'আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে ছয় সিটের বেশি থাকলেই জরিমানা দিতে হয়। গাড়ি ধরলেই অন্তত ৫০০ টাকা পুলিশকে দিতে হয়। গাড়ির কোনো সমস্যা কিংবা কাগজপত্রের কোনো সমস্যা না পেলেও তাদের মতো করে একটি সমস্যা বের করে টাকা নেয়।'
অ্যাম্বুলেন্স চালক ইমরান হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'সোমবার রাতে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই কিন্তু সকালে ঢাকায় প্রবেশের জন্য পোস্তগোলা থেকে যানজটের মুখোমুখি হই। প্রায় দেড় ঘণ্টা যাত্রাবাড়িতে জ্যামে বসে থেকে পুলিশকে বলে উল্টো রাস্তা দিয়ে নিউরোসায়েন্সে আসতে হয়। রোগীর অবস্থা খুব বেশি সংকটাপন্ন না থাকায় তেমন সমস্যা হয়নি।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ক্লিনিকাল কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক টিবিএসকে বলেন, ''যানজটের কারণে হার্টের রোগীদের হাসপাতালে ডিলে অ্যারাইভাল একটি কমন প্রবলেম। চিকিৎসা শুরু হতে এক মিনিট দেরি হলে অনেক সময় হার্ট ফেইলিওরের একজন রোগী মারা যায়। কিন্তু জ্যামের কারণে হার্টের অনেক রোগীর ব্রড ডেথও হয়।'
ডা. হারিসুল হক বলেন, 'শুধু হার্টের পেশেন্ট না, ডায়াবেটিস রোগীরাও দীর্ঘক্ষণ জ্যামে বসে থাকলে তাদেরও হার্টের ওপর চাপ পড়ে। এছাড়া জ্যামে দীর্ঘক্ষণ থাকার কারণে মাথা ঘোরা, অস্বস্তি সৃষ্টি করে। জ্যামের কারণে শুধু হার্টের রোগী না, ডায়রিয়া, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের রোগীরাও পথে মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।'
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান টিবিএসকে বলেন, 'অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হলেও অপরিকল্পিত নগর গড়ে তুলে আমরা অমানবিক জাতিতে পরিণত হচ্ছি।'
অ্যাম্বুলেন্সসহ অতীব জরুরী সেবার জন্য আলাদা লেন অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রাস্তার উপরে ময়লা আবর্জনার স্তূপ, অবৈধ পার্কিং এবং মেট্রোরেলের নির্মাণ সামগ্রী রাখার কারণে রাস্তার ধারণক্ষমতা কমে গেছে। সেই সাথে ফুটপাতসহ যত্রতত্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যানজটের জন্য কম দায়ী নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্সসহ অতি জরুরি সেবাদানকারী পরিবহনের ইমার্জেন্সি লেনে চলাচলের ব্যবস্থা করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে সড়কের ফুল ক্যাপাসিটি ব্যবহার করতে হবে।'