২৫ বছর পর এখনো বিস্ময় জাগানিয়া অ্যালবাম ‘আমাদের বিস্ময়’
১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বেরিয়েছিল এলআরবি'র ডবল অ্যালবাম আমাদের বিস্ময়।
আমাদের? ও বিস্ময় নামক দুটো অ্যালবাম এক মোড়কে নিয়ে আসে এলআরবি। বাংলাদেশে ডবল অ্যালবামের ধারণা নিয়ে এসেছিল তারাই। ১৯৯২ সালে ডবল অ্যালবাম দিয়েই যাত্রা শুরু করে এলআরবি।
২৫ বছর পেরিয়ে এসেও আইয়ুব বাচ্চুর চলে যাওয়ার দিনে মনে পড়ে ১৯৯৮-এ বেরোনো এই আইকনিক অ্যালবামটির কথা। এর বিশেষত্ব — এটি পুরোপুরি রক অ্যালবাম। নানা ধরনের গান না করে রকের ওপরেই অনবদ্য সব কম্পোজিশনের দেখা মেলে এই ক্যাসেটে — সফট গানগুলোর ক্ষেত্রে মেলোডি নিয়ামক হলেও রক প্যাটার্নেই করা হয়েছে কম্পোজিশন। এছাড়া ফোক ধাঁচের আধ্যাত্মিক গানগুলোও নির্মাণ করা হয়েছে রক কম্পোজিশন হিসেবে।
এলআরবি গানের কথার ক্ষেত্রে জীবনঘনিষ্ট নানা ব্যাপার ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলিকে প্রাধান্য দেয়। এ অ্যালবামটিতে গান লিখেছেন লতিফুল ইসলাম শিবলী, বাপ্পী খান, নিয়াজ আহমেদ অংশু, এঞ্জেল শফিক, মারুফ আহমেদের মতো গীতিকারেরা।
'এখন অনেক রাত' খ্যাত বাপ্পী খান এই অ্যালবামের সবচেয়ে হিট গান 'সাড়ে তিনহাত মাটি' লিখেছেন। 'ভবের দেশে'ও তার লেখা। ব্যক্তিক নিঃসঙ্গতা, মনোজাগতিক বিষয়ের বাইরে গিয়ে এখানে আধ্যাত্মিক কথা লিখতে দেখা গেছে তাকে।
নিয়াজ আহমেদ অংশু আমাদের বিস্ময়-এ 'জলজোছনা', 'রোদ্দুর জানে না' এর মতো গান লিখেছেন। বিশেষ করে 'একটি সাঁকো' কিংবা 'সুইসাইড নোট' গানগুলোয় বেশ নিরীক্ষাপ্রবণ হতে দেখা গেছে তাকে। আবার, 'খুব সহজেই'-এর মতো চমৎকার সফট রক গানের গীতিকারও তিনি। এই গানটিতে তার হৃদয়গ্রাহী লিরিকের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুর অনবদ্য গিটার সলো গানটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে।
লতিফুল ইসলাম শিবলি বরাবরের মতো মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন 'আকাশজোড়া ভালোবাসা' গানে। এঞ্জেল শফিকও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন 'চাই জল' গানের লিরিকে। অ্যালবামের 'একটিবার' গানটির গীতিকার মারুফ আহমেদ অপু সেসময় ছিলেন কিশোরবয়সী। তিনিও নিজস্ব ছাপ রেখেছেন গানের কথায়।
আমাদের?
ডবল অ্যালবামের প্রথমটি আমাদের?, শুরু হয়েছে 'সাড়ে তিনহাত মাটি' গানটি দিয়ে। আধ্যাত্মিক ধাঁচের সঙ্গে রকের চমৎকার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন বাচ্চু। গিটারে আরপিজিওর চমৎকার কাজ করেছেন তিনি। তার সঙ্গে কিবোর্ডের ব্যাকআপ দারুণ রসায়ন তৈরি করেছে।
'ভালো লাগে না' গানটির শুরু থ্রাশ মেটাল ধরনে। এখানে লিড ও বেজ গিটারের চমৎকার মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়। মাঝে মাঝে ব্লুজ প্যাটার্নেও বাজিয়েছেন বাচ্চু।
'বিস্ময়' গানটিতে ড্রামের ব্যবহার আরও করার সুযোগ ছিল। 'আয়না' গানটিতে কিবোর্ডের অসাধারণ কাজ রয়েছে। 'যখন থেমে যায়' গানটির লিরিক চমকপ্রদ, তার সঙ্গে দারুণ সমন্বয় তৈরি করেছে কি বোর্ডের কাজ। তবে গায়নশৈলীতে বোধহয় আরেকটু আবেগ আনতে পারতেন বাচ্চু।
অ্যালবামের 'সাঁকো' একটি অসাধারণ জ্যাজ ধাঁচের কম্পোজিশন। কার্লোস স্যান্টানার কথা মনে করাতে পারে এই গান। এঞ্জেল শফিকের লেখা 'চাই জল' গানটিও বেশ ভালো লাগার মতো — বাচ্চুর গায়কী প্রশংসনীয়।
বিস্ময়
দ্বিতীয় অ্যালবামটির নাম বিস্ময়। আমাদের?-এর তুলনায় এই পর্বের গানগুলো অপেক্ষাকৃত কোমল। প্রথম গান 'একটিবার'-এ আইয়ুব বাচ্চু তার স্বাভাবিক গলার বাইরে একটু ডিপ ভয়েসে গানটি করেছেন। গানটির মিক্সিং অসাধারণ। বেজ গিটার ও কিবোর্ডের কাজও অনবদ্য।
'ষোলআনা' গানটি 'হেভি গিটার রিফট'সমৃদ্ধ। 'জলজোছনা' গানটিতে চমৎকার কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেছে চমৎকার সুর — ড্রামসের রোলিং, গিটার, কিবোর্ড সবই বেজেছে দুর্দান্তভাবে।
'সুইসাইড নোট' গানটি কথায় ও সুরে নিরীক্ষাধর্মী। এখানে হেভি গিটারের কাজ করেছেন বাচ্চু। থিমের দিক থেকে গানটি অনন্য।
সম্পূর্ণ 'ব্লুজ' ধাঁচের গান 'মনটা আমার।' যথেষ্ট 'প্যাথোস' দিয়ে গানটি গেয়েছেন বাচ্চু। গানটিতে কান্নার অংশে তার এক্সপ্রেশন অনবদ্য।
'স্বপ্নবদল' গানটির হার্মোনাইজ প্রশংসনীয় হলেও বাচ্চুর কণ্ঠে একটু ক্লান্তি ছিল যেন। তবে কণ্ঠে দারুণ 'ডেপথ' নিয়ে বাচ্চু গেয়েছেন শিবলীর লেখা 'আকাশজোড়া ভালোবাসা।' কিবোর্ড ও বেজ গিটারের দারুণ কাজ গানটিকে প্রাণবন্ত করেছে। গানের শেষদিকে বেজবাদন অনন্য।
ব্লুজ ও মেলোডিয়াস বাংলা গানের সুরের মিশ্রণে তৈরি 'যাবে যদি চলে যাও' গানটি ভালো। 'স্মৃতি' গানটিতে গিটার বেজেছে 'একুইস্টিক' ধরনে, শ্রোতাদের কাছে তৃপ্তিদায়ক মনে হবে। অ্যালবামের শেষ গান 'মেলামেশা'য় কথার সাথে সুরের চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে।
দারুণ টিমওয়ার্ক
অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের কাজ চমৎকার। বেজ গিটার বাজিয়েছেন স্বপন। কিবোর্ডে এস আই টুটুল। ড্রামসে রিয়াদ। গিটারের ড্রেস্টশন কালারের ক্ষেত্রে আইয়ুব বাচ্চুকে ওস্তাদ বলা যেতে পারে। অ্যালবামের সব গানেই তার প্রশংসনীয় গিটারবাদন শ্রোতাদের মন কেড়ে নিতে সক্ষম। এর সঙ্গে স্বপনের বেজ বাজানোর কথা অবশ্য উল্লেখ্য। তিনি এখানে ফিঙ্গারস্টাইলে বেশি বাজিয়েছেন। একইসঙ্গে রক্ষা করেছেন পরিমিতিবোধ। কিবোর্ডে টুটুল অসাধারণ ছিলেন। বিশেষত তার টোন সিলেকশনের প্রশংসা করতেই হয়। রক ড্রামার হিসেবে রিয়াদ তাল, লয় ও নানা প্যাটার্নের ভেতর চমৎকার সঙ্গতি রক্ষা করেছেন।
আইয়ুব বাচ্চুর সংগীত পরিচালনায় মুন্সিয়ানা দুর্দান্ত একটি ডবল অ্যালবাম তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। ডিপ পার্পল, ভ্যান হেলেন, কার্লোস স্যান্টানার গান যারা শুনেছেন, তাদের কাছে এই অ্যালবাম খুব তৃপ্তিদায়ক মনে হতে পারে।
১৯৯৮-এ এমন একটি ডবল অ্যালবাম শ্রোতাদের জন্য ছিল এক অনবদ্য ঈদ উপহার। নব্বই দশকে ব্যান্ডসংগীতের সেই দুর্দান্ত বিকাশের সময়ের এক উজ্জ্বল সৃষ্টি এলআরবির আমাদের বিস্ময়। ২৫ বছর পরেও যা একই রকম আবেদন রাখতে সক্ষম।