বঙ্গবন্ধু টানেল পাড়ি দেওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা
গাড়ির চাকা সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। মিনি বাসে থাকা সবার আগ্রহও বাড়ছে। মিনি বাসটি নদীর বুক চিরে তলদেশে সরু সড়কে ঢুকে গেল মুহুর্তে। চারদিকে আলো জ্বলছে। সবার উৎসাহ-উদ্দীপনা মনে করিয়ে দিচ্ছিল কাজী নজরুল ইসলামের অভিযান কবিতার 'নতুন পথের যাত্রা-পথিক, চালাও অভিযান! উচ্চ কণ্ঠে উচ্চার আজ, মানুষ মহীয়ান!' পঙক্তিটি। কারণ সুইজারল্যন্ডের গথার্ড বেজ টানেল, নরওয়ের ল্যার্ডল টানেল, ইংলিস চ্যানেলের নিচ দিয়ে নির্মিত যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যকার সংযোগ স্থাপনকারী চ্যানেল টানেল বা জাপানের টোকিও বে-অ্যাকুয়া-লাইনসহ অনেক টানেলের গল্প শুনলেও বাস্তবে প্রথমবার কোনো টানেল পাড়ি দিতে যাচ্ছি আমরা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলে প্রবেশের অনুভূতি ছিল এমনই।
প্রায় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই সুড়ঙ্গ বিশিষ্ট টানেলটির পূর্ত কাজের সমাপ্তি হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। এরপর ভেতরের নিরাপত্তা ও প্রকৌশল কাজ হয়েছে। গাড়ি চলাচলের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর গণমাধ্যমকর্মীরা প্রথমবারের মতো গত ২৬ অক্টোবর দুপুরে ৩৩১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের টানেলে প্রবেশের সুযোগ পান।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় শহর থেকে বায়েজিদ লিংক সড়ক হয়ে দোতলা দুটি পর্যটন বাস ছুটেছিল আউটার রিং রোড় ওপর দিয়ে। লক্ষ্য— ঢাকা থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী যানবাহনগুলো কীভাবে কর্ণফুলীর দক্ষিণপ্রান্ত আনোয়ারা উপজেলায় উঠবে তার অভিজ্ঞতা দেওয়া। পতেঙ্গাপ্রান্তে টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়কের দোতলা বাস থেকে নেমে উঠতে হয়েছে মিনি বাসে। গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে জেলা প্রশাসন, এসএসএফ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের গাড়ির বহরের এবার টানেলে প্রবেশের পালা।
গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে টানেল নিয়ে রিপোর্টিং করার সুবাদে জেনেছি অনেক খুঁটিনাঁটি। তবে বাড়তি অনুভূতি বা আগ্রহের কারণ হলো— ২০১১ সালে যখন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সাম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাই করা হচ্ছিল, তার অংশীদার ছিলাম আমি। সমীক্ষার একটি অংশে ট্রাফিক গণনা এবং এই রুটের সাম্ভাব্য যান চালকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজে যুক্ত ছিলাম। প্রতি আট ঘন্টায় ৩০০ টাকা চুক্তিতে শাহ আমানত সেতু, কালুরঘাট সেতু এবং নিমতলা বিশ্ব রোডে তিন দিনে মোট ৩২ ঘন্টা কাজ করেছিলাম।
টানেলের পূর্বপ্রান্ত পতেঙ্গা দিয়ে প্রবেশের সময় চোখে পড়বে ওজন স্কেল। দুই সুড়ঙ্গের অ্যাপ্রোচ সড়ককে বিভিক্তকারী মাঝখানের ফুল গাছ স্বাগত জানাবে যাত্রীদের। এরপর রয়েছে স্ক্যানার, হলুদ আচ্ছাদন (রেইন শেল্টার) এবং স্ক্রিন। উত্তর দিকের সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে টানেলে ঢুকে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়বে ফ্লাড গেট। ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এগুলো বন্ধ করে দিলে সুরক্ষিত থাকবে টানেল। এরপর ভেতরের আলো স্বাগত জানাবে। টানেলের সুড়ঙ্গে প্রবেশের পর প্রতি ১০০ মিটার চার মিটার করে ঢালু হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকবে। নদীর তলদেশে সর্বোচ্চ ৩১ মিটার পর্যন্ত নামবে টানেলের মাঝামাঝিতে গিয়ে। এরপর আবার একইভাবে ঢালু ধরে উঠতে থাকবে। মাত্র ৪ মিনিটের ব্যবধানে গাড়িটি পৌঁছে যাবে আনোয়ারা প্রান্তে। অথচ এই পথ অতিক্রম করতে এতদিন এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগতো।
এনহাঞ্চ লাইটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করায় টানেলের প্রবেশের পর আলোকায়ন সহনীয় থাকবে। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছানোর কয়েকশ মিটার আগে থেকে মনে হতে পারে ওই প্রান্তে যেন সূর্য নেমে এসেছে। টানেলের প্রবেশ ও শেষ ২০০ মিটার বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাইরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এছাড়া দুই সুড়ঙ্গে মোট ২৮টি জেট ফ্যান দিয়ে ভেতরে বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ হবে। টানেলের বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মনিটরিং স্টেশন থেকে আলো-বাতাস নিয়ন্ত্রিত হবে।
টানেলের ভেতরে তিনটি ক্রস প্যাসেজ দিয়ে দুই সুড়ঙ্গের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। কিছু দূর পর পর মাইক, অগ্নিনির্বাপক এবং জরুরি বহির্গমনের পথ রয়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও রয়েছে। টানেলের ভেতরে সরু ওয়াকওয়ে থাকলেও গাড়ি থেকে নামা নিষেধ। শুরুর দিকে ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চললেও পরে তা ৮০ কিলোমিটারে উন্নিত করা হবে। দুই এবং তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ। আনোয়ারা প্রান্তে টোল প্লাজায় ১৫টি বুথে একসঙ্গে ১৫টি গাড়ি টোল পরিশোধ করতে পারবে।
টানেলটির মেয়াদ ১০০ বছর। তবে ৩০ বছরের মধ্যে নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে। টানেল পরিচালনায় মোট পাঁচ শতাধিক জনবল প্রয়োজন হবে। টানেলটি ২৪ ঘন্টা চালু থাকবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী জানান, টানেলের ভেতরে কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার বা নষ্ট হয়ে গেলে পরিচালন কর্মীরা তা ৫ মিনিটের মধ্যে ক্লিয়ার করবে। প্রথম পাঁচ বছর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি টোল সংগ্রহ ও টানেলটি পরিচালনা করবে।