কেন নিজ জেলার নামে দোকানপাটের নামকরণ করেন ব্যবসায়ীরা
ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সৌর। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা সবই হয়েছে গাইবান্ধা জেলা শহরে। চেনা গন্ডি ছেড়ে রাজধানীর বাসিন্দা হওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তার নিজ জেলার প্রতি স্মৃতিকাতরতা কমেনি একটুও। ব্যাচেলর মেসে থাকতে শুরু করার পরপরই সেই এলাকায় 'গাইবান্ধা হোটেল' নামের একটি খাবার হোটেলের দেখা পেয়েছিলেন সৌর। মেসের নিয়মিত খাবারের চেয়ে সেখানকার খাবারের দাম অনেকটাই বেশি। রান্নার স্বাদও আহামরি কিছু নয়। তবু সুযোগ পেলেই দুপুর বা রাতের খাবার খেতে গাইবান্ধা হোটেলে হাজির হন তিনি।
বিশাল এই শহরে অপরিচিতের ভিড়ে নিজের চিরচেনা জায়গার অনুভূতি খুঁজে পান সেখানে। হোটেলের মালিক কর্মচারী থেকে শুরু করে অধিকাংশ ক্রেতাকেও মনে হয় চেনা কেউ। শুধু এই হোটেলের ক্ষেত্রেই নয়, রাজধানীর যেকোনো এলাকায় কোথাও 'গাইবান্ধা' নামটি দেখতে পেলে সেদিকে একটু বেশিই নজর পড়ে তার।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানান কাজের সূত্রে প্রতিনিয়ত ঢাকায় পাড়ি জমান অসংখ্য মানুষ। নিত্য দিনযাপনের মাঝে তাদের কাছে এমন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। এখানকার অলিগলিতে চলার পথে প্রায়ই চোখে পড়ে বিভিন্ন জেলার নামে দোকানপাটের নাম।
ব্যবসায়ীরা কী চিন্তা থেকে এ ধরনের নামকরণ করে থাকেন, সাধারণ ক্রেতারা বিষয়টিকে কীভাবে নেন, আসলেই কি এটি কোনো কার্যকরী বিপণন বা মার্কেটিং কৌশল- রাজধানীর নানান এলাকা ঘুরে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
ক্রেতা আকর্ষণের কৌশল?
উত্তরখান এলাকার মাজার চৌরাস্তায় ২০ বছর যাবত 'নোয়াখালী স্টোর' নামের মুদির দোকান চালাচ্ছেন মোঃ নিজামউদ্দিন। জানালেন, তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। কাজের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তরুণ বয়সে। নিজ জেলার প্রতি ভালোবাসা থেকেই নাম দিয়েছিলেন দোকানের। এর সুবিধা-অসুবিধা কোনো কিছুই ভাবেননি তখন। কিন্তু দুই দশকের ব্যবসায় এই নামের বেশ কিছু ভালো দিক লক্ষ করেছেন তিনি। 'নাম দেখে এই এলাকার নোয়াখালীর মানুষজন একটু বেশি আসে আমার দোকানে। নানান জিনিস কেনাকাটার ফাঁকে এলাকা নিয়ে কথাও হয় তাদের সাথে। ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। এলাকার প্রতি টানের কারণে আমার ব্যবসায়ও কিছুটা লাভ হয়,' বললেন নিজামউদ্দিন।
পাশাপাশি আরেক দোকান 'বি-বাড়ীয়া হার্ডওয়্যার ও পেইন্ট।' দোকান মালিক মোঃ শামীমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। এক যুগ আগে ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল হিসেবেই দোকানের নাম ঠিক করেছিলেন তিনি। নামকরণের সেই কৌশল ব্যাখ্যা করে শামীম বলেন, 'আঞ্চলিকতার টানে আমার জেলার অনেক ক্রেতাই আসেন এখানে। দোকানের নাম যদি আমার নিজের নামে বা অন্য কোনো সাধারণ নামে দিতাম তাহলে কিন্তু এই বাড়তি সুবিধাটা পেতাম না।'
নিজ এলাকার নামের টানে শুধু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশের মানুষজনই নন, আকৃষ্ট হন দূরদূরান্তের ক্রেতারাও। মহাখালী আমতলী এলাকায় 'কিশোরগঞ্জ হুডেল' নামের এক খাবার হোটেলের কর্মচারী রাজন জানান, দুই বছর আগে মালিক নিজ জেলার নামে নামকরণ করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির। একে জেলার নামে নাম, তার সঙ্গে আবার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের কারণে হোটেলটি নজর কেড়েছে কিশোরগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় আসা অসংখ্য মানুষের। 'অনেক কাস্টমার আইসা জানায় তারা কিশোরগঞ্জের নাম দেইখা দূর থাইক্যা আসছে। উত্তরা, ফার্মগেট, মিরপুর এলাকার কাস্টমাররাও বন্ধুবান্ধব নিয়া আসে এই নামের কারণে। একবার এক কাস্টমার আইসা কইলো, দেড় বছর ধইরা বাড়ি যায় না। এই হোটেলে আইলে তার নিজের এলাকার কথা মনে পড়ে।'
মগবাজার মোড়ের 'কুমিল্লা স্টোর' নামের দোকানটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৫৬ সালে। দোকানের বর্তমান কর্ণধার ইকবাল জানালেন, নিজের জেলার নামে দোকানের নামকরণ করেছিলেন তার বাবা। তার ভাষ্যে, 'সব জায়গার ক্রেতাই আসে আমাদের দোকানে, তবে কুমিল্লার প্রতি টান থেকে সেখানকার মানুষ একটু বেশি আসে। তারা মনে করে নিজেদের দোকান এটা। নিজ জেলার প্রতি ইজম তো সবারই কাজ করে।'
উত্তরখানের 'চাঁদপুর টেলিকম', শহীদ তাজউদ্দীন স্মরণীর 'টাঙ্গাইল অয়েল এন্ড অটো স্টোর', মগবাজার দিলুরোডের 'বিক্রমপুর হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট', বড় মগবাজারের 'নোয়াখালী জেনারেল স্টোর', নিউমার্কেটের 'লক্ষ্মীপুর বস্ত্রালয়', মতিঝিলের 'সিলেট স্টোর'এর মতো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খুঁজে পাওয়া জেলার নামে নামকরণ করা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কথা বলেও জানা যায় একই ধরণের তথ্য।
নিজের জেলার ব্যবসায়ীর প্রতি বিশ্বাস
'ঢাকায় থাকি প্রায় ৩০ বছর যাবত। ঘরে বাচ্চাকাচ্চা, পাড়া-প্রতিবেশী বা কর্মক্ষেত্রে কলিগদের সঙ্গে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলতে সিলেটি টান ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু এই দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বললে মনে হয় ঢাকার মাটিতে এক টুকরা সিলেট খুঁজে পেয়েছি। নিজেও সিলেটি ভাষায় কথা বলতে পারার টানে টুকটাক কেনাকাটা করতে দেশি ভাইয়ের দোকানে আসি বারবার,' বললেন সিলেট স্টোর থেকে চিপস কিনতে আসা ক্রেতা জয়নাল আবেদীন।
উত্তরখানের 'ফরিদপুর গোশত বিতান' থেকে গরুর মাংস কিনতে আসা হাবিবুল্লাহ জানালেন তার বাড়িও ফরিদপুর। নিজের এলাকার মানুষ জেনে দোকান মালিক সবসময় তাকে সবচেয়ে ভালো মাংসটাই দেন বলেই বিশ্বাস করেন তিনি।
নোয়াখালী স্টোরে কথা হয়েছিল দীর্ঘদিনের মরিশাস প্রবাসী রমজানের সঙ্গে। তার মতে দোকানের নামে বা পণ্যের গায়ে নিজের এলাকার নাম দেখতে পাওয়া ক্রেতার জন্য আবেগের বিষয়। 'বিদেশ যখন থাকতাম দেশের ১০ টাকার চিপস বা ২৫ টাকার পানীয় ডাবল দাম দিয়ে কিনে খেতাম, শুধু 'বাংলাদেশ' নামটা লেখা থাকত বলে। নিজের জন্মস্থান থেকে দূরে যারা থাকে তারাই আসলে এর কদর বুঝতে পারে,' বলেন রমজান।
সৌর, জয়নাল আবেদীন, হাবিবুল্লাহ বা রমজানের মতো অনেক ক্রেতাই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রভাবিত হন নিজের জন্মস্থানের নাম দেখে। তবে এই প্রভাব ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই কার্যকরী বলে মনে করেন ঢাকার আরেক বাসিন্দা নিলুফার। তার ভাষ্যে, 'নিজ জেলার নাম দেখে সব ক্রেতাই প্রভাবিত হলে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নামও তো বিভিন্ন এলাকার নামেই হতো। কিন্তু এ ধরণের নাম বেশিরভাগ সময় অলিগলিতে বা এলাকার স্থানীয় দোকানেই দেখতে পাওয়া যায়।'
মার্কেটিং কৌশল হিসেবে কতটা ফলপ্রসূ
নামকরণের এই কৌশল মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে আংশিক কার্যকরী বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মাদ শহীদুল ইসলাম। তার মতে, অধিকাংশ বিক্রেতা খুব একটা না বুঝেই নিজের এলাকার নামে নামকরণ করেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের।
'পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের নাম ভোক্তার আচরণে সবসময়ই প্রভাব ফেলে। এলাকার নামে দোকানের নামকরণ করলে ভোক্তার সঙ্গে নৈকট্য তৈরি হয়। এটা তাদের পণ্য ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে,' বলেন তিনি।
'নিজের দেশের ভেতর থেকেও আমাদের কাজের সূত্রে নানান এলাকায় বসবাস করতে হয়। এই মাইগ্রেশনের কারণেই মূলত এ ধরণের নামকরণ আরো জনপ্রিয় হয়েছে। তবে টেকসই ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে এটি খুব একটা কার্যকরী নয়,' যোগ করেন শহীদুল ইসলাম।