ঢাকার নতুন রাস্তাগুলো কোনো নামে না হয়ে কেন নম্বরে রাখা হয়?
স্বাধীনতার পর জিন্নাহ এভিনিউয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। আর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আইয়ুব গেটের নাম রাখা হয় আসাদ গেট। ঠিক এভাবেই সময়ের সাথে সাথে বদলেছে ঢাকার বহু রাস্তার নাম।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শহীদ আসাদ, বেগম রোকেয়া, আগা সাদেক, আবুল হাসনাত, আহসান উল্লাহর মতো মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের নামে কিছু রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের নামেও ফুলার রোড, বেইলি রোড, মিন্টো রোড, জনসন রোডের নাম রাখা হয়েছে।
কিছু এলাকায় আবার রাস্তা ও চৌরাস্তার নাম স্থানীয় নানা পরিচিতি থেকে রাখা হয়েছে। যেমন, খিলগাঁওয়ের মাটির মসজিদ রোড, মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ রোড, লালবাগের কেল্লার মোড়, বাড্ডায় কাজীবাড়ি রোড ইত্যাদি।
মোগল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বরাও বাদ যাননি। মোহাম্মদপুরে নূরজাহান, আকবর, তাজমহল, বাবর, হুমায়ুন ইত্যাদির নামেও রয়েছে রাস্তা।
কাউকে সম্মানিত করার জন্য তার নামে রাস্তার নামকরণ করা একটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয়।
আবার ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড, পশ্চিম আগারগাঁও কিংবা ডিআইটি রোডও রয়েছে। যেগুলো কি না ওই স্থানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নামকরণ করা।
কিন্তু প্রায়শই রাস্তাগুলো কোনো মানুষ, স্থান, ঘটনা বা বিষয় থেকে নামকরণ করা হয়। এটি আমাদের কেবল ভৌগোলিকভাবে নয় বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিকভাবেও পরিচিত করে।
তবে আপনি যদি ঢাকার মানচিত্রের দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করেন, তবে দেখবেন নতুন ঢাকার এক্ষেত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানকার বেশিরভাগ রাস্তাগুলো কোনো নামে নয়, বরং নম্বর হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
আপনি যদি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মানচিত্র দেখেন, তবে সেখানে একটি গ্রিড লে-আউট দেখতে পাবেন। এটি ১৩টি ব্লকে বিভক্ত, যার নাম 'এ' থেকে 'এম' পর্যন্ত। একইসাথে রাস্তাগুলোর নাম ১ থেকে ৫৬ পর্যন্ত রাখা হয়েছে। আবাসিক এলাকাটি এখনও প্রসারিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামবে কারও জানা নেই। একই প্রবণতা উত্তরা-দিয়াবড়ি, মহাখালী ডিওএইচএস, পূর্বাচল ও বনশ্রী এলাকায় দেখা যায়।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দক্ষিণ দিকে বাড্ডা-রামপুরা এলাকার দিকে তাকালে আবার ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। এখানকার রাস্তাগুলো চেকারবোর্ডের প্যাটার্নে নয়, স্থানীয় নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, কাজীবাড়ি রোড, কবরস্থান রোড, কাঁচাবাজার রোড ইত্যাদি।
পরিকল্পিত ও সুসংঘটিত একটি এলাকা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইদানীং রাস্তার নামের পরিবর্তে বর্ণমালা ও সংখ্যা দিয়ে নামকরণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে এতে করে সেখানকার অনন্য পরিচয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা নগর পরিকল্পনাবিদ, রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করেছি। জানতে চেয়েছি তারাও এমনটা মনে করে কি না।
একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট হওয়ার পাশাপাশি তৌহীদ ফিরোজ নিজেকে 'এলিফ্যান্ট রোডের পোলা' হিসেববে পরিচয় দিয়ে থাকেন। যার অর্থ ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
তৌহীদ ফিরোজ বলেন, "আপনি মানচিত্রে যে নামগুলো দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলো এমনিই কোথাও থেকে উঠে আসেনি। এর সাথে ইতিহাস বা কোনো ঘটনার সংযোগ রয়েছে। গল্পগুলো সেখানকার বাসিন্দারা ধারণ করে।"
এলিফ্যান্ট রোডের কথাই বলা যাক। এখানকার নামটি এসেছে ঢাকার নবাবদের পালন করা হাতি থেকে। বর্তমান বিজিবি এলাকার পিলখানায় এসব পশু রাখা হতো। সেখান থেকে পশুগুলো এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে বর্তমান হাতিরঝিলে গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো।
তৌহীদ ফিরোজ ফের বলেন, "যেমনটা আমি আগেই বলেছি, (রাস্তার নামের পিছনে) স্মৃতি ও গল্পগুলি সেইসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকে। তবে ঢাকা শুধু পুরনো ঢাকাবাসীর জন্য নয়। সারাদেশের মানুষও এখানে চলে এসেছে। এই পুরনো শহরের স্মৃতি রাখার জন্য তারা দীর্ঘকাল এখানে ছিল না। তাই তারা জানে না কীভাবে এখানকার গলিগুলোর নাম রাখা উচিত।"
এদিকে লেখক ও রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ আবার ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, "রাস্তার নামকরণের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম বেছে নেওয়া হয়।"
মহিউদ্দিন আরও বলেন, "স্থানের নাম ও ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ইতিহাস ও জাতীয় ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচয় প্রচারের জন্য এটি ব্যবহার করে।"
১৯৮৬ সালে মাওজ আজারিয়াহু জার্নাল অব কনটেম্পোরারি হিস্টোরিতে 'রাস্তার নাম ও রাজনৈতিক পরিচয়: প্রেক্ষিত পূর্ব বার্লিন' শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি পূর্ব বার্লিন শহরের নামগুলো বিশ্লেষণ করেন।
ফলাফলে দেখা যায়, "রাস্তার নামগুলোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। একইসাথে সেগুলো রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।"
আজারিয়াহু তার গবেষণাপত্রে আরও বলেন, "এক ব্যক্তির নাম অন্যদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়টি কাজ করে। সেইসাথে ইতিহাস ও পূর্ববর্তী সময়ের আধিপত্যের বিষয়টিও প্রতিনিধিত্ব করে।"
গ্রিড আয়রন লে-আউট প্যাটার্ন
আমরা নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ডা. আদিল মোহাম্মদ খানের সাথে কথা বলেছি। তার মতে, রাস্তার নামগুলো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে আমরা কোথায় আছি এবং আগে কোথায় ছিলাম। এগুলো আমাদের গল্প বলে।
এখন রাস্তাগুলো যেভাবে নম্বরভিত্তিক নামকরণ করা হয়েছে তা আমাদের নতুন ঢাকার বৈশিষ্ট্য। পুরনো ঢাকার সাথে পার্থক্য এখানেই।
আদিল মোহাম্মদ বলেন, "যখন শহরের রাস্তার নাম নম্বর হিসেবে হয়, তখন এটি আত্মিক অনুভূতি হারায়। একটি নাম ঐতিহাসিক কিংবা সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে; যা ঐ শহরকে জীবন দেয়। শহরকে জীবন্ত সত্তা হিসাবে উপলব্ধি করতে চাওয়ার অভিপ্রায় থেকেই সেখানকার স্থান ও রাস্তার নাম রাখা হয়।"
আদিল মোহাম্মদ আরও বলেন, "নগর পরিকল্পনায় আমরা গ্রিড আয়রন লেআউট প্যাটার্ন নামে একটি শব্দ ব্যবহার করি। যেখানে রাস্তাগুলো একে অপরের সাথে সমকোণে থেকে একটি একটি গ্রিড বা চেকারবোর্ড গঠন করে। নতুন পরিকল্পিত ঢাকার নকশা প্রণয়নে আমরা এই বিন্যাসটি প্রয়োগ করছি। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সরলরেখা ও প্যাটার্নের অধীনে রাস্তাগুলোকে নম্বর দেওয়া হয়েছে।"
অন্যদিকে অপরিকল্পিত এলাকাগুলো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠেছে ও প্রসারিত হয়েছে। সেখানকার রাস্তার নামগুলো গ্রিড বা প্যাটার্ন অনুসরণ করে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নম্বর অনুসারে নামকরণ করা যায় না।
এজন্য একটি স্থান বা রাস্তা বোঝাতে বাসিন্দারা স্থানীয় কোনো পরিচিতি বা কিছুর নাম বেছে নেয়, যা তাদের সকলের কাছে পরিচিত।
আদিল মোহাম্মদ বলেন, "তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা এই রাস্তাগুলির ঐতিহাসিক নাম দিতে পারব না। কিংবা কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা অনুসারে নামকরণ করতে পারবো না৷ আসলে আমি বিশ্বাস করি এটি করাই আরও উপযুক্ত হবে। কারণ, একটি শহর একটি নির্জীব সত্তা। ফলে মানুষ ও তাদের গল্পই শহরটিকে প্রাণ দেয়।"