দুই বাংলাদেশি প্রাণীবিজ্ঞানী যেভাবে একটি নতুন মথের নামকরণ করলেন
'মথের ১০১টি সুন্দর নাম'— না! এমন কোনো বই লেখেননি তারা। বরং প্রাণীবিজ্ঞানী দম্পতি মো. জহির রায়হান এবং সায়েমা জাহান চট্টগ্রামের একটি ল্যাবে মথ পালন করেছেন এবং সেগুলোর নিয়মিত গবেষণা, পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেছেন।
ছয় মাসের গবেষণার পর, এ দম্পতি তাদের আবিষ্কৃত নতুন মথটির গণ ও প্রজাতির (জীববিজ্ঞান ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের অনুক্রম) নামকরণ করেন—প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া স্পিনোসা (Paraxenoacria spinosa)।
প্যারাক্সিনো (Paraxeno) একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক, এবং আক্রিয়া (Acria) হলো একটি মথের গণ। আক্রিয়া গণের মথগুলোর সামনের ডানায় একটি বাঁক থাকে, যা এক্সকাভেশন বলে পরিচিত। কিন্তু রায়হান ও সায়মার আবিষ্কৃত মথের ক্ষেত্রে এই এক্সকাভেশনটি মথের পেছনের ডানায় অবস্থিত। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা এটিকে 'অদ্ভুত আক্রিয়া' বা প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া নামে নামকরণ করেছেন।
আর প্রজাতির নাম 'স্পিনোসা' শব্দটি 'স্পাইন' (কাঁটা) থেকে এসেছে। এই মথের পুরুষের যৌনাঙ্গে ছয় থেকে সাতটি লম্বা কাঁটা রয়েছে, যা মথের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে — কাঁটাযুক্ত অদ্ভুত আক্রিয়া বা প্যারাক্সিনায়োক্রিয়া স্পিনোসা।
রায়হান বলেন, "প্রকৃতির প্রতিটি জীবের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক নামের প্রয়োজন — সেটা গাছ, এককোষী জীবাণু, অথবা প্রাণী হোক। বিজ্ঞানীদের জন্য বৈজ্ঞানিক নাম একটি আন্তর্জাতিক ভাষার মতো কাজ করে; পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে তারা এই ভাষা বুঝতে পারে"।
গণ হলো নাম এবং প্রজাতি হলো সেই বিশেষ জীবের বিশেষণ। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হল হোমো সেপিয়েন্স (Homo Sapiens)। এখানে হোমো হল গণ, যার অর্থ মানব; এবং সেপিয়েন্স অর্থ বুদ্ধিমান, যা আমাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বর্ণনা করে।
এভাবে জীবজগতের বিভিন্ন প্রজাতিকে তাদের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
"হোমো গণের বহু প্রজাতি ছিল, যেমন- হোমো ইরেক্টাস, যারা সোজা দাঁড়াতে পারত; অথবা হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস, যারা ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে বাস করত। তারপর মানুষের আগমন, যারা প্রাণীজগতের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। এই কারণেই আমাদের নামের শেষে জুড়ে দেয়া হলো সেপিয়েন্স। এইভাবে বিজ্ঞানীরা জীবগুলোকে নামকরণ করেন, যা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদের তাদের আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে সাহায্য করে," যোগ করেন রায়হান।
রায়হান ২০১৮ সালে মথ নিয়ে কাজ শুরু করেন, কারণ মথ ও প্রজাপতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জীববৈচিত্র্য। এটি গবেষণার জন্য একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্র। তাদের মধ্যে অনেক বৈপরীত্য রয়েছে—কিছু মথ রেশম তৈরি করে, আবার কিছু কাপড় নষ্ট করে। কিছু মথ ক্ষতিকারক পোকা, যা ফসলের জন্য ক্ষতিকর, আবার অন্যদিকে আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে মথের প্রজাতি মানুষের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রায়হান বলেন, "মথ ও প্রজাপতির ডানায় রঙের বৈচিত্র্য অসাধারণ। এই বৈচিত্র্যই আমাকে মথ অধ্যয়নে আকৃষ্ট করেছে।"
রায়হান ও সায়েমা উভয়ই ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে রায়হান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরিতে এক বছরের গবেষণা কর্মসূচিতে যোগ দেন। সেখানে তিনি মথের রেশমের বিবর্তন এবং ক্ষতিকারক মথের আণবিক গঠন নিয়ে কাজ করছেন।
এদিকে, সায়েমা বর্তমানে একটি বিশেষ প্রজাপতি — সুন্দরবনের ক্রো প্রজাপতি নিয়ে একটি যৌথ গবেষণায় কাজ করছেন। এই প্রজাপতি শুধু বাংলাদেশের সুন্দরবনে পাওয়া যায় এবং এটি বিলুপ্তির পথে। তিনি এর আণবিক গঠন, পরিবেশবিজ্ঞান এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য অধ্যয়ন করছেন।
নাম নির্বাচিত হলো যেভাবে
এখন পর্যন্ত বিশ্বে দেড় লাখের বেশি মথের প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ১২৮টি পরিবারে শ্রেণিবদ্ধ। এর মধ্যে একটি পরিবার হল প্যালিওপোডিডি, যার অন্তর্ভুক্ত ১০-১২টি মথ। 'প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া স্পিনোসা' এই পরিবারের সদস্য।
এ বছরের এপ্রিল মাসে, রায়হান ও সায়েমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মথের লার্ভা সংগ্রহ করেন। তারা লার্ভাগুলোকে নিজেদের ল্যাবে পালন করতে শুরু করেন।
রায়হান বলেন, "আমরা লার্ভা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক মথ হওয়া পর্যন্ত তাদের ছোট ছোট বৈশিষ্ট্যগুলো মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করেছি। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে গবেষণার পর, আমরা দেখতে পাই এটি অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।"
তারা মথের অণু-গঠন, পরিবেশ, কোন গাছের পাতা খায়, কীভাবে তারা নিজেদের রেশম দিয়ে কামড় বানায়, তাদের ডানার বৈশিষ্ট্য, ডানার রন্ধ্র, লিঙ্গ অঙ্গের বৈশিষ্ট্য, লার্ভা এবং ক্যাটারপিলার পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করেন।
রায়হান বলেন, "যখন আমরা প্যালিওপোডিডি পরিবারের অন্যান্য জেনারগুলোর সঙ্গে তুলনা করেছি, তখন আমরা দেখেছি যে এটি অন্যান্যদের তুলনায় আরও বৈচিত্র্যময়। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে এটি একটি নতুন গণ এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি যা আগে কখনো নামকরণ করা হয়নি"।
এরপর, তারা তাদের নিবন্ধটি, বৈজ্ঞানিক নামকরণের জন্য পরিচিত জার্নাল জুটেক্সা-তে পাঠান। সেখানে দুইজন বিজ্ঞানী তাদের নিবন্ধটি পর্যালোচনা করেন এবং তাদের তুলনা ও ব্যাখ্যা মঞ্জুর করেন। অক্টোবর মাসে জার্নালে 'অ্যা নিউজ জেনাস অ্যান্ড স্পেসিস অফ পেলিওপোডিডি হজেস, ১৯৭৪ (ইনসেকটা: লেপিডোপটেরা) ফ্রম সাউথ-এশিয়া' শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
'আইন্যাচারালিস্ট' নামে একটি ওয়েবসাইট রয়েছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা মথ, পাখি, প্রজাপতি এবং অন্যান্য পোকামাকড়ের ছবি শেয়ার করেন। গবেষকরা এই ছবিগুলোর মাধ্যমে প্রজাতিগুলোর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পান।
রায়হান দম্পতি দেখতে পান, এই মথ গণটি কেবল বাংলাদেশেই নয়, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও পাওয়া যায়। এজন্য তাদের গবেষণাপত্রে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রায়হান জানান, "মথের নমুনাটি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এরকম নতুন কিছু আবিষ্কৃত হলে তা প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে রাখা হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারে"।
মথের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রায়হান বলেন, "পেঁপে ফুলের পরাগায়ণের জন্য একটি বিশেষ মথের প্রয়োজন, যাকে হক মথ বলা হয়। এই মথ ছাড়া পৃথিবীতে পেঁপে থাকত না। প্রতিটি পেঁপে গাছে পরাগায়ণের জন্য এই মথ অপরিহার্য। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা প্রায়ই বলি, 'নো হক মথ, নো পাপায়া'।"
রেশম উৎপাদন থেকে শুরু করে পাখি, সরীসৃপ ও মানুষের প্রোটিনের উৎস হিসেবে মথের ভূমিকা আমাদের জীবন ও প্রকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
"আমরা মথ থেকে এমনকি আইসক্রিমের রংও পাই," বলেন রায়হান।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন