১৯৪১ সাল: যুদ্ধের বাজারে যেভাবে মজুরি-অনুদান বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছিল
ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি বা পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৪ সালে। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের কিছু বেশি আর শহর এলাকা ছিল ২০ বর্গকিলোমিটার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ঢাকায় ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠি আর লোকবল থাকলেও নগর প্রশাসন গড়ে ওঠেনি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়, তারপর ঢাকা পায় নগর প্রশাসন বা পৌরসভা। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকার বলে পৌরসভার চেয়ারম্যান হতেন।
মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতীর সময় (১৬০৮) থেকে পরের একশ বছর ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী। সুবেদার ও তার কোতোয়াল নগর শাসন করতেন। তখন বিভিন্ন মহল্লায় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল পঞ্চায়েত কমিটি যার নেতৃত্ব দিতেন সর্দার। মুর্শিদ কুলী খাঁ রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেওয়ার পরের ২০০ বছর ঢাকা গুরুত্বহীন ছিল। ফলে সম্প্রসারণ তো দূরের কথা, প্রতিষ্ঠিত অনেক মহল্লাও জনশূন্য হয়ে যায়। তবে বসতিগুলোতে পঞ্চায়েত চালু ছিল। আর ওই পঞ্চায়েতকে বলা চলে পৌরসভার পূর্বসুরি।
১৮৬৪ সালের ঢাকা একটি বিভাগীয় কেন্দ্র মাত্র। ছোট্ট শহরটির অল্পসংখ্যক নাগরিককে পৌরসেবা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় মিউনিসিপ্যালিটিকে। অবশ্য তখন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করার বেশি কাজ পৌরসভার ছিল না। আর এটুকু কাজও চলছিল শম্বুকগতিতে — অন্তত ১৮৮০ সালের আগ পর্যন্ত। ১৮৮৫ সালে প্রথমবারের মতো পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচন হয় এবং তারপর থেকে ইউরোপীয় স্টাইলে ঢাকা গড়ে তোলার কথা ভাবা হতে থাকে।
পৌরসভার কাজের তালিকাও বড় হয়। যেমন সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, সড়কবাতি জ্বালানো ও নেভানো, আবর্জনা নিষ্কাশন ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা জোগাড়ের জন্য পৌরসভা নির্ভর করেছে স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপর। সুপেয় পানি ও বৈদ্যুতিক বাতির জন্য অধিকাংশ টাকা জোগান দিয়েছিল ঢাকার নবাব পরিবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এবং মধ্যবর্তী সময়েও ঢাকায় কিছু নাগরিক সুবিধা সংযোজিত হয়, তার একটি ফায়ার ব্রিগেড।
১৮৬৪ সালের ৮৪ বছর পর ১৯৪৭ সালে আমরা দেখলাম ঢাকার আয়তন বেড়েছে ১১ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখ।
ওই হিসাবে ১৯৪১ সালের ঢাকাকে মোটামুটি জমজমাট শহর বলাই যায়। আর পৌরসভাই তখন পর্যন্ত বড় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা কঠিন নয়, ততদিনে এর কর্মীসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। সবারই মনে পড়বে, ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তৃতীয় বছরে পড়েছিল। বাজারে জিনিসপত্রের আকাল দেখা দিতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। ওই সময়ে পৌরসভার কর্মীরা বেতন ও সুবিধাদি এবং পৌরসভার আনুকূল্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অনুদান বৃদ্ধি চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে আবেদনও করেছিলেন।
৩০ টাকা বেতনের রুপচাঁন
রুপচাঁন ছিলেন ফায়ার ব্রিগেডের ড্রাইভার। ১৯৪১ সালের ২ জানুয়ারি তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মারফত পৌরসভার চেয়ারম্যান বরাবর একটি দরখাস্ত দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন: 'জনাব, সম্মান ও বিনয়পূর্বক নিবেদন, আমি পৌরসভার একজন অতি দরিদ্র কর্মচারী। মাসে ৩০ টাকা বেতন পেয়ে থাকি। আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭ জন। আমার উপার্জনের আর কোনো উপায় নেই। আমার জন্য ওই স্বল্প টাকায় ঢাকার মতো এই বড় শহরে পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে টিকে থাকা দুঃসাধ্য। এমনকি পরিবারের সকলের জন্য দুবেলা আহার জোটানোও অনেকদিন কঠিন হয়ে যায়। এক্ষণে বেতন বৃদ্ধি না হলে আমার এই অশেষ দুঃখের পরিসমাপ্তি ঘটবে না।
তাই বিনীত আবেদন, আমার বেতন বৃদ্ধি করে দিন নয়তো পদোন্নতি দান করুন যেন আমি কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।'
রুপচাঁন ইংরেজীতে টাইপ করে দরখাস্তটি পেশ করেছেন কিন্তু তার বাংলা স্বাক্ষর দেখলে বোঝা যায় তিনি পড়াশোনা জানতেন না। আন্দাজ করা যায়, সেকালে এমন চিঠির নমুনা টাইপিস্টদের কাছে মিলত এবং এতে টাইপিস্টের দুপয়সা বাড়তি রোজগার হতো।
সাইকেল ভাতার জন্য
পৌরসভার প্রকৌশলী বরাবর লেখা হয়েছিল পরের দরখাস্তটি, ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে। ইংরেজিতে টাইপ করা দরখাস্তটি লিখেছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। তাতে বলা হয়েছে: 'জনাব যথাবিহিত সম্মানপূর্বক অবগত করছি যে আমার নিযুক্তি হয়েছে ওয়ারশিয়ারের কুলি হিসেবে। কিন্তু আমি কাজ করছি পাইপ লাইনের মিস্ত্রি হিসাবে আর সেসব সারাই বা রদবদলের জন্য শহরের প্রায় সকল জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে যেমনটা অন্য মিস্ত্রিরা করে থাকে। এজন্য আমাকে নিজের সাইকেলটি ব্যবহার করতে হচ্ছে আর এ বাবদ কোনো ভাতাও পাচ্ছি না।
তাই আপনার নিকট বিনীত আবেদন রাখছি আমার কুলি পদবীটি পরিবর্তন করে পাইপ লাইন মিস্ত্রীর পদবী দেওয়া হোক যেন আমি নিয়মমাফিক সাইকেল ভাতা পেতে পারি।'
নারিন্দা থেকে নিকুঞ্জ বিহারী
পরের দরখাস্তটি লেখা হয়েছে সরাসরি পৌরসভা চেয়ারম্যান বরাবর। নারিন্দার গুরুদাস সরকার লেনের জনৈক নিকুঞ্জ বিহারী মুখার্জি লিখছেন: 'মহোদয় আমি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি আপনার অধীনস্ত কয়েকটি নিম্ন প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ শূণ্য হয়েছে। আমি নিজেকে ওই পদের একজন প্রার্থী হিসাবে আবেদন করছি।
আমার যোগ্যতার বিবরণ এতদসঙ্গে পেশ করছি: ১৯২৭ সালে আমি রলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গণিত ও সংস্কৃতে ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেছি। পরে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে বিজ্ঞান কোর্স সম্পন্ন করেছি।
উপরন্তু রলি উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে দেড় বছর পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে এবং সাত বছর কৃতিত্বের সঙ্গে অনন্তময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি।
তাই উপরোক্ত কোনো শূণ্য পদে আমাকে নিয়োগদানের বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। এসঙ্গে আমার শিক্ষাগত ও চারিত্রিক সনদের অনুলিপি আপনার নিকট পেশ করছি।'
রামমোহন লাইব্রেরির অনুদান
চতুর্থ যে দরখাস্তটি আমরা পেয়েছি সেটি লিখেছেন রামমোহন রায় লাইব্রেরির সুপারিনটেনডেন্ট বংকু বিহারি কর। পৌরসভার চেয়ারম্যানকে তিনি লিখছেন: 'পূর্ববঙ্গ ব্রাম্হ সমাজের নির্বাহী পরিষদ এজন্য কৃতজ্ঞ যে, গত ৪ বছর ধরে ঢাকা পৌরসভা রামমোহন লাইব্রেরিকে ২০০ টাকা অনুদান দিয়ে আসছে । কিন্তু গ্রন্থাগারের কার্যক্রম বছর বছর বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে খরচও বাড়ছে। আপনি জানেন গ্রন্থাগারটিতে মূল্যবান সব গ্রন্থের একটি বড় সংগ্রহ রয়েছে যা দিয়ে বিদ্যোৎসাহী সমাজ উপকৃত হচ্ছে এবং এ কার্যক্রমের বিস্তার আরো অধিক সংখ্যক ব্যক্তিকে উপকৃত করবে।
তাই আমাদের সবিনয় নিবেদন, সকল কিছু বিবেচনা করে আপনি গ্রন্থাগারের অনুদান ২০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪০০ টাকায় উন্নীত করুন।'
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায়
তখন দ্য ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটটি ছিল জনসন রোডে। অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন রায়বাহাদুর এনপি নিয়োগী ছিলেন এর সুপারিনটেনডেন্ট। পৌরসভার চেয়ারম্যানকে তিনি অবগত করছেন: 'ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় ওষুধ এবং আনুষঙ্গিক জিনিষপত্রের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে আর সে কারণে ইনস্টিউটে ওষুধ এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে বেশি দাম দিয়ে।
বিশেষ করে আমাদের হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েরা অধিক হারে ভর্তি হচ্ছেন, বড় এবং ছোট উভয় রকমের অস্ত্রচিকিৎসার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনার নিকট ইতিমধ্যে পেশ করা বর্হিবিভাগ ও ভর্তি হওয়া রোগীর পরিসংখ্যান দেখে আপনি তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। উপরোক্ত সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের প্রতিষ্ঠানের অনুদান বছরে ১২০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকায় উন্নীত করার প্রার্থনা জানাচ্ছি।'
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে পাওয়া এসব দরখাস্ত তখনকার সময় ও সমাজচিত্র তুলে ধরে। তবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বিষয়টি এ সময়ে প্রাসঙ্গিকও বটে।