বাঁশিওয়ালা: ৩০ বছর ধরে একই জায়গায় বসেন, বাবার তৈরি বাঁশি বেচেন
আধপাকা চুল, মুখে ঘন গোঁফ। পরনের পাঞ্জাবীতেও দেশীয় ঐতিহ্যের ছাপ। শাহবাগ থেকে চারুকলার পাশের পথ ধরে যারা নিয়মিত আসা যাওয়া করে, তাদের কাছে এ চেহারা অনেকটাই পরিচিত।
কখনো তাকে দেখা যায় বাঁশি বাজাতে, কখনো নিজেই কানে হেডফোন গুঁজে রাখেন, কখনো আবার কাস্টমাদেরদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। কাস্টমার বলতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই। উদাসীন চেহারার এই মানুষটি আসলে ফুটপাতের একজন ব্যবসায়ী। চারুকলার দেওয়াল ঘেঁষে তার ছোট্ট বিপণীকেন্দ্র। চারুকলার সাথে লাগোয়া ফুটপাতের ওপর এমন অনেক টুকিটাকি জিনিস পাওয়া যায়। কিন্তু আশেপাশের সবার চেয়ে তিনি যেন আলাদা। নাম রুবেল। চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি 'রুবেল ভাই' পরিচিত। আজ প্রায় ৩০ বছর ধরে চারুকলার এই একই জায়গায় বসেন তিনি। চারুকলার চিত্রিত দেওয়ালেই ঝুলিয়ে রাখেন হাতের তৈরি নানানসামগ্রী।
ঢোল, একতারা, প্রেমজুরি, খমক, হাতবায়া, হারমোনিকা, বাঁশি, দোতারা থেকে শুরু করে মেয়েদের জন্য মালা, চুড়ি, টিপের খুব ছোট্ট একটি জগত নিয়ে তার দোকান। চারুকলার এই দেয়ালটি ঘেঁষে ফুটপাতের ওপর গয়নাগাটি, পেইন্টিং, ব্যাগ, টুপি, খাবার দাবারের অনেক দোকানই আছে। তবে সুরের সরঞ্জাম নিয়ে বসেন রুবেল একাই।
বাঁশির সাথে রুবেলের সম্পর্ক বংশ পরম্পরায়
সুরের সাথে রুবেলের সখ্য শুরু হয় একেবারে ছোটোবেলায়। যখন তার বাবা পাঠশালায় ছাত্রদের বাঁশি বাজানো শেখাতেন। তিনি বলেন, 'ছোটোবেলা থেকে বাবাকে দেখতাম, বাবা বাঁশি বাজাতেন, একতারা বাজাতেন, ঢোল তবলা বাজাতেন। বাবাকে দেখে দেখে নিজের মধ্যে একটা স্পৃহা শুরু হয়। একদিন বাবা বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ছাত্রদের সামনে, আর রুবেল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। কোনটা সা, কোনটা রে, কোনটা গা– ওটা একদিন মাথায় ধরে ফেললাম। ওখান থেকেই শেখা, ওখান থেকেই জানা।'
রুবেলের বাবা মো. লাবু মিয়া দেশব্যাপী প্রসিদ্ধ তার বাঁশির জন্য। রুবেল শিখেছেন তার বাবা লাবু মিয়ার কাছ থেকে। বাবা লাবু মিয়া শিখেছেন তার বাবা চাঁন মিয়ার কাছ থেকে। চাঁন মিয়ার ৬০ বছরের পেশা ছিল। ব্রিটিশ, ভারত, পূর্ব পাকিস্তানে বাঁশের বাঁশির ব্যবসা করতেন তিনি। নিজে শিখেছেন ভারতের একজন ওস্তাদের সাহচর্যে থেকে। বাঁশি বাজানো, ভাটিয়ারি গানে তার বেশ কদর ছিল।
বাবা চাঁন মিয়ার পর ছেলে লাবুও ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে এই পেশায় আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ব্যবসা আরম্ভ করেন। চারুকলায় তার পথচলা শুরু হয় শিল্পাচার্য্য জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে। তিনিই লাবু মিয়াকে নিয়ে এসেছিলেন এই চারুকলায়। বড় হবার পর থেকে রুবেলও বাবার সাথে আসতেন এখানে।
রুবেলদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে পদ্মা নদীর ধারে। নদী ধসে বাড়ি ভেঙে গেলে, তার দাদা চাঁন মিয়া সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসেন। তখনও ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়নি। ঢাকায় হিন্দুদের থেকে একটি বাড়ি কিনে নিয়ে পরিবারসহ থাকা শুরু করেন। একসময় ২০০৮ সালে বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়, হিন্দু সম্পত্তির দোহাই দিয়ে। রুবেলরা তখন সবকিছু নিয়ে নানাবাড়ি চলে যান। ওখান থেকেও প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসতেন, শুক্রবার দিন চারুকলায় সারাদিন বিকিকিনি করতেন। এরপর চলে যেতেন। সে ধারাবাহিকতায় এখনও রুবেল বসেন চারুকলায়।
বাবা লাবু মিয়ার পথ ধরেই গড়েছেন নিজের দোকান
আধুনিক সঙ্গীত সরঞ্জামের ভিড়ে বিলুপ্তপ্রায় বাঁশি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনও কাজ করছেন লাবু মিয়া। বাংলাদেশের কোথাও মেলার খবর পেলেই বাঁশের বাঁশি নিয়ে ছুটে যান সেখানে। তার বানানো বাঁশির কদর দেশ-বিদেশে রয়েছে। নিজ দেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বাঁশি রপ্তানিকারকরা এখান থেকে বাঁশি নিয়ে যান। এছাড়া নিজের পেশা ধরে রাখতে রাজধানীর আল্পনা প্লাজায় 'লাবু ফ্লুট' নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আছে।
রুবেলের বাকি ভাইবোনরা লেখাপড়া করে বাবার সাথে দোকানে বা নিজ নিজ কর্মজগতে আছে। তারাও উত্তরাধিকার সূত্রে লালন করছেন এই সুরের খেলা। তবে চারুকলা ছাড়েননি রুবেল। বাবার রেখে যাওয়া স্থানেই গড়েছেন নিজের মতো করে ছোট্ট একটি দোকান। শুক্র, শনি এবং রবি– এই তিনদিন সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায় সেখানে।
দোকানে যা কিছু পাওয়া যায় সবই হাতের তৈরি
রুবেলের কাস্টমার বলতে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই। এই ছোট্ট জগতের শুরুটা বাঁশি, দোতারার মতো বাদ্যযন্ত্র দিয়ে হলেও এখন বেশিরভাগ আয় আসে মেয়েদের গয়নাগাটি থেকে। বাবা লাবু মিয়া শুরু করেছিলেন শুধু বাদ্যযন্ত্র দিয়ে। পরে ২০০৯ সাল থেকে বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী গয়নাগাটিও বানাতে শুরু করেন কাঠ, কড়ি, সুতা দিয়ে। এখন গয়নাই বেশি বানানো হয়। আর বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বেশি বানানো হয় বাঁশি, একতারা দোতারা।
এসব তৈরিতে যে কাঁচামাল লাগে তার জন্য রুবেলকে যেতে হয় বিভিন্ন জেলায়। যেমন– চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসেন বাঁশ, চামড়া নিয়ে আসেন যশোর থেকে। মানিকগঞ্জে আল্লাহ বাজানের দরবারে গেলে সেখান থেকে কিনে আনেন অনেক যন্ত্র। এছাড়া এসব বানানোর জন্য কিছু মেশিনও আছে বাসায়। সব কাঁচামাল কেনা হলে, ঘরে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও আশেপাশের প্রতিবেশীরা মিলে বানিয়ে ফেলেন। বানানোর পেছনে সপ্তাহে তিনদিন সময় দেন। যেমন– একদিনে একাহাতে ওয়ান স্টিক একতারা তিনটি বানাতে পারেন।
এলিফ্যান্ড রোডে তাদেরই দোকান 'লাবুফ্লুট'
দেড়শো থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে জিনিসপত্র আছে। দিনে বিকিকিনি প্রায় পাঁচ হাজারের মতো। বিশ ত্রিশ টাকার বাঁশি যেমন আছে, তার বাবার হাতের তৈরি প্রফেশনাল বাঁশিগুলোও আছে। যেগুলোর দাম দুই হাজার, তিন হাজার কিংবা পাঁচ হাজার।
বৈশাখ ও পূজোর সময় বিক্রিবাট্টা বেড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, বিদেশি বা যারা ঘুরতে আসেন তারাই একসাথে অনেকগুলো কিনে নেন। তখন খেলনা একতারাগুলোই বানাতে হয় পাঁচশো পিস। আর বড়গুলো ২০-৩০টার মতো। অন্যান্য সময় এতটা বিক্রিবাট্টা হয়না। দিনে হয়তো সবমিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো উঠে আসে। তবে কোনো বড় অর্ডার আসলে বা ভারী প্রফেশনাল কোনো যন্ত্রের অর্ডার এলে, এলিফ্যান্ড রোডে তাদেরই দোকান 'লাবু ফ্লুট' থেকে এনে দেন।
শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে আসে বিপদে
রাজধানীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা শাহবাগ। অগণিত অনশন, প্রতিবাদ, মিছিলের মতো নানান ঘটনা-প্রতিক্রিয়ায় মুখরিত থাকে এ অঞ্চল। দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতায় সেসবের সাক্ষীও তাকে হতে হয়েছে। কখনো বাবার সাথে থেকে, কখনো একাই। কিন্তু এতে কখনো ভয় বা ক্ষতির মুখ দেখতে হয়নি বলে জানান রুবেল। বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হওয়ায় এবং চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক থাকায়, নিশ্চিন্তেই থাকতে পেরেছেন।
রুবেল বলেন, 'একবার প্রচণ্ড গন্ডগোলের সময় টিয়ারগ্যাস খেয়ে দোকান খোলা রেখেই ভেতরে ঢুকে যাই। স্টুডেন্টরাই নিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর সুস্থ হয়ে যখন ফিরি, দেখি সব মালপত্র গুছিয়ে চারুকলার ভেতরে রাখা হয়েছে। এভাবেই তারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে।'
ব্যবসার পাশাপাশি অনুষ্ঠানও করেন
ছোটো থেকে বাবার হাত ধরে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াতেন বলে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াটুকু আর হয়ে ওঠেনি রুবেলের। তবে নিজের চেষ্টায় পড়েছেন অনেক বই। বাবা ছিলেন লালনের ভক্ত। বাবার থেকে জেনেছেন লালনকে। লালনের আত্মতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। লালনকে নিয়ে গবেষণা করতে চান আরও। এখনও দেশজুড়ে বিভিন্ন সাধুসঙ্গে যোগ দেন। তাছাড়া ব্যবসার পাশাপাশি মাসের প্রায় পনেরো দিন তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। সেখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বিয়ের অনুষ্ঠান বা মেলার মতো নানান জায়গা থেকে তার ডাক আসে।
নিজের মনকে খুব প্রাধান্য দেন রুবেল। মন চাইলে দোকান উঠিয়ে বাসায় চলে যান। আবার চাইলে অসময়ে দোকান খুলে বসেন। মনকে শান্ত রাখার জন্য করেন সাধনা। প্রতিদিন ভোর চারটার দিকে উঠে প্রাণায়াম করেন দুই ঘণ্টা। এরপর স্নান সেরে একটি বিস্কুট ও চিনিছাড়া কফি খেয়ে নেন। দুপুরে অল্প ভাত আর সবজি। রাতের আইটেমে থাকে সবজি-রুটি। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই রাতের খাবার শেষ করে ফেলেন। সপ্তাহে এক দুদিন ভারী আহার থেকে বিরত থাকেন। তখন চা, কফি পানির মতো একেবারে হাল্কা নাস্তা করেন। প্রায় বিশ বছর ধরে এই তার রুটিন।
এখানেই শুরু, এখানেই শেষ করতে চান
বাবার হাত ধরে আসতেন এই চারুকলায়। বাবাকে দেখেছেন গান গাইতে, বাঁশি বাজাতে, একতারা বাজাতে। ভক্ত গুণীগ্রাহীরা আসতেন। বাবার মতো বংশী বাদক নন তিনি, কিন্তু বাবার মতোই সুরের সাধনা করতে ভালোবাসেন। একজীবন পার হয়েছে চারুকলার ফুটপাতের ওপরেই, বাকিজীবনও তাই ইচ্ছে। হয়তো পরিসর একটু বড় করবেন, কিন্তু চারুকলা থেকে বিদায় নেবেন না। শাহবাগের কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো সুরের এই প্রাঙ্গণ। তার সুর শুনে অনেকেই বাঁশি কেনেন এবং শেখার আগ্রহ দেখান। রুবেলও চেষ্টা করেন বিনামূল্যে একদম অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই আগ্রহীদের বাঁশি শেখাতে।
শুধু বাঁশিই নয়, একতারাও শিখতে আসেন অনেকে। কেউ কেউ আবার আসেন শুধুই পরিচিত এই মানুষটির মুখে বাঁশি শুনতে। আবার কখনো দর্শকদের উদ্দেশ্য নিজেই যন্ত্রে সুর তোলেন। আসতে আসতে জড়ো হতে থাকে সুর পিপাসীরা। কিনতেই হবে এমন কথা নেই, নাহয় এক সাধকের বাঁশির সুরই শুনে গেলেন!