ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা কতটুকু যৌক্তিক?
গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে যানবাহন চলাচল সীমিত ও নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, "এটা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সদরঘাট কিংবা কোনো মাছবাজার নয়।" শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুযোগ করে দিয়ে নিরাপদ অ্যাকাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত করাই এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ক্যাম্পাসে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশৃঙ্খল ও অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেছিল। যাতে করে হয়রানি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাগুলি ক্রমশ সচরাচর হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার ফলে ক্যাম্পাসের পরিবেশের উন্নতি ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
প্রক্টর বলেন, "এখন অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে ক্যাম্পাসের চলাচল করা যাচ্ছে। এই বিধিনিষেধ না থাকলে তা এত সহজে করা সম্ভব হতো না।"
এমন সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ গেটে যানজট বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে প্রক্টর জানান, কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামাল দিতে বাফার টাইম তৈরি করতে ট্র্যাফিক বিভাগের সাথে কাজ করছে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের কারণে শাহবাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও নিউমার্কেট এলাকায় যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। তাই বিষয়টি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
পাবলিক স্পেসে প্রবেশে বাধা
বিধিনিষেধের সিদ্ধান্তের সমালোচকরা মনে করেন যে, সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে বেশ দুর্বল পরিকল্পনা করা হয়েছে। যা আশেপাশের এলাকায় সমস্যা তৈরি করছে।
শহরের বাসিন্দারা সাপ্তাহিক ছুটিতে ক্যাম্পাসের ভেতরে পাবলিক স্পেসে প্রবেশ করতে গিয়ে মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছে। কেননা এত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শহিদ মিনারটিও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাঝে অবস্থিত; যেখানে জনসাধারণের প্রবেশে অনুমতি রয়েছে।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-সব সড়কে যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে তার অধিকাংশই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে ডিএমপি ট্র্যাফিক বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের সাথে পরামর্শ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা অবশ্য ক্যাম্পাসের আশেপাশের হাসপাতালে রোগীদের প্রবেশের উপর বিরূপ প্রভাব তুলে ধারে নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন। একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে এটিকে একটি 'পাবলিক স্পেস' বলে অভিহিত করেছেন।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকার মতো একটি শহরে জনসাধারণের রাস্তা সীমাবদ্ধ করার প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; এটি আমাদের ইতিহাস, জনপরিসর এবং শহুরে বাস্তবতার একটি অংশ। কয়েক দশক ধরে ঢাকা মেডিকেল ও নিউ মার্কেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দ্বারা বেষ্টিত ক্যাম্পাসটি শহরের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। যাত্রীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে এই স্থানগুলিতে পৌঁছানো প্রায়শই বেশ সহজ। ভাবুন তো, যদি বুয়েটও চলাচল সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কী হবে?"
এই নগর পরিকল্পনাবিদ ক্যাম্পাসটিকে বিচ্ছিন্ন না করে নগর বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আহ্বান করেছেন। তিনি নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিয়েছেন। যার মধ্যে নজরদারি বাড়ানো ও একচেটিয়াভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে নির্দিষ্ট ধরনের যানবাহনের চলাচল সীমাবদ্ধ করার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, প্রাইভেট কার বা রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৃহত্তর সিস্টেমিক সমস্যা তৈরি করবে; কেননা এগুলো শহুরে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান সতর্ক করে বলেন, "প্রবেশ সীমাবদ্ধ করার মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা হ্রাস পেতে পারে। কয়েক দশক ধরে ব্যবহৃত পাবলিক রাস্তাগুলি মানুষের জন্য একটি অধিকার হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে এই ক্যাম্পাসে প্রবেশাধিকার সীমিত করা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের জন্য জমায়েত হওয়া স্থান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তাৎপর্য ক্ষুণ্ন করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সম্ভবত ক্যাম্পাসটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকগুলির মধ্যে একটি। যা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ১৯৫১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বৃহত্তর অংশ করে তুলেছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন ৩ আগস্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন সর্বস্তরের মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ব্যবহার করেই শহিদ মিনারে পৌঁছান। যেখানে নাহিদ ইসলাম হাসিনার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন।
অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, "মানুষ জড়ো হতে না পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর ভূমিকাও সংকুচিত হবে।"
যানবাহনের চাপ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেদিন বিধিনিষেধ কার্যকর করেছে, সেদিন অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ আটকে ছিলেন। রিকশা, বাইক থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার পর্যন্ত যানবাহনের বিধিনিষেধের প্রভাব পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে অনুভূত হয়েছে।
মো. রুবেল নামে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক টিবিএসকে বলেন, "চেকপয়েন্টে জিজ্ঞাসাবাদের ফলে সৃষ্ট জ্যামের কারণে ঢাকা মেডিকেল এলাকা পার হতে তার দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে।"
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বহিরাগত যানবাহন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি সাপ্তাহিক দিনগুলিতে বিকাল পাঁচটা থেকে দশটা পর্যন্ত এবং সাপ্তাহিক বন্ধ ও ছুটির দিনগুলিতে বিকেল তিনটা থেকে দশটা পর্যন্ত প্রযোজ্য। তবে ঢাবির স্টিকারযুক্ত যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, মিডিয়া ও সরকারি গাড়ির প্রবেশাধিকার রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেন, "আমরা পলাশী থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত রাস্তা খোলা রেখেছি। বকশী বাজার, বার্ন ইউনিটসহ অন্যান্য এলাকায় কোনো বাধা নেই। যাইহোক, ক্যাম্পাসের এই অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আমরা উদয়ন স্কুল, রাসেল টাওয়ার এবং দোয়েল চত্বরের মত সেকশনে যান চলাচল সীমিত করেছি।"
একচেটিয়া নিষেধাজ্ঞা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যানবাহনের বিধিনিষেধ নিয়ে আলোচনা একদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অন্যদিকে ঢাকার সাথে সামঞ্জস্য করার মধ্য বিতর্ক তৈরি তৈরি করেছে।
এখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের উদ্বেগ নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু যাত্রী ও জরুরি পরিষেবার বিঘ্ন ঘটার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না।
এক্ষেত্রে প্রয়োজন আরও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাসকে বিচ্ছিন্ন না করে বরং নিরাপত্তার দিকে নজর দেওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যে আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত শহিদ মিনারের মতো স্থানগুলি জাতীয় গুরুত্ব বহন করে। এই ধরনের স্থানগুলিতে প্রবেশ সীমিত করলে ঢাকার জনজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যেতে পারে।
ক্যাম্পাসকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টায় পাশাপাশি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি পাবলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই তার দায়িত্ব বিবেচনা করতে হবে। নিরাপত্তা ও প্রবেশযোগ্যতার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, শহরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং জনসাধারণের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। তবেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকার শহুরে দৃশ্যপটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে তার ভূমিকা বজায় রেখে একটি নিরাপদ অ্যাকাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে।