দেবুর একাত্তর: এডিটিং টেবিল যখন যুদ্ধক্ষেত্র
'সূর্যস্নান' ছবির শুটিং শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার হোসেন এবং সুমিতা দেবী প্রধান পাত্র-পাত্রী। হাজী আব্দুল জলিল প্রযোজনা করছেন ছবিটি। পরিচালনার দায়িত্বে আছেন রকীবউদ্দিন আহমেদ, রূপকার নামে সমধিক খ্যাত। পান্থপথের মাথায় একটি বড় বটগাছ ছিল, দুই দিন সেখানেই শুটিং হলো। তারপর বাঁধল গোল, প্রযোজক আর সুমিতা দেবীর মধ্যে। সুমিতা দেবী চুক্তি বাতিল করলেন, রূপকারও আর পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে চাইলেন না। কিন্তু পরিচালক ছাড়া ছবি হয় কীভাবে?
সালাহউদ্দিন তখন 'যে নদী মরু পথে'র কাজ শেষ করে এনেছেন। সহকারী পরিচালক নূরুল ইসলাম তার নাম প্রস্তাব করলেন। বলেকয়ে তাকে রাজি করানো গেল। এখন নায়িকার ভূমিকায় কাকে নেওয়া যায়? কে যেন বলল, রওশন আরাকে নেওয়া যেতে পারে। যে নদী মরু পথের প্রধান অভিনেত্রী রওশন আরা, সালাহউদ্দিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। জলিল সাহেব জানতে চাইলেন, সম্মানী কত নেবেন? রওশন আরা বললেন, স্যারের (সালাহউদ্দিনকে চলচ্চিত্রপাড়ার লোকেরা স্যার বলেই ডাকত) ছবিতে দুই হাজার নিয়েছিলাম, এখনো তাই দিতে পারেন। জলিল সাহেব হুংকার দিলেন, না, তা হয় না, সুমিতা দেবীর সঙ্গে তিন হাজার চুক্তি হয়েছিল, আপনাকেও তাই নিতে হবে। ঘটনা ১৯৬০ সালের।
নিশাত হলে ছবি দেখতে গিয়ে
আঠারো বছর বয়সী দেবব্রত সেনগুপ্ত দেবু সবকিছুর দর্শক। বাড়ি পালিয়ে সবে চলচ্চিত্রে এসে ঢুকেছেন। ঘটনাটা দীর্ঘ তবে একঘেয়ে নয়। চট্টগ্রাম শহরের নালাপাড়ায় তাদের বাসা। বাবা ইলেকট্রিক সাপ্লাই ইঞ্জিনিয়ার। বাবার সুবাদেই শহরের সিনেমা হলগুলোর ম্যানেজার, টিকেট মাস্টার, গার্ডরা তাকে চিনত। উজালা, নিরালা, সিনেমামহল, খুরশিদ মহল তখনকার চট্টগ্রামের নামী সিনেমা হল। ১৯৫৫ সালে দেবুর বয়স তেরো, প্রথম সিনেমা দেখেছিল, নাম ছিল 'ফল অব বার্লিন'। তারপর দেখেছে 'সাগরিকা', 'শেষ পরিচয়', 'হারানো সুর'। খেলাধুলা করতে আর ছবি দেখতে তার খুব ভালো লাগত, পাড়ার নাটকের দলে অভিনয়ও করত।
পড়াশোনায় বেশি মন নেই বলে বাড়ির বড়রা রাগারাগি করেছিল, ১৯৬০ সালের একদিনে দেবু চলে এসেছিল ঢাকায়। বন্ধু নিরঞ্জন থাকত নওয়াবপুরের ঝরিয়াটুলি লেনে। উঠল এসে তার কাছে। দু-চার দিন পর নিশাত হলে গেছেন একটি ছবি দেখতে। সাবিহা ও সন্তোষ ছিলেন প্রধান দুই চরিত্রে। ছবি শুরু হলে পর পাশের আসনে যিনি বসেছিলেন, তিনি মাঝেমধ্যে বলছিলেন, নাহ এই শটটা ভালো হয় নাই, এখানে ক্যামেরা আরেকটু ধরে রাখলে ভালো হতো। দেবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বড় ভাই আপনি মনে হচ্ছে সিনেমা বিশেষজ্ঞ, তা কী করা হয়? তিনি বেশ ভাব নিয়ে ইংরেজিতে উত্তর দিলেন, আই অ্যাম দ্য প্রোডাকশন ম্যানেজার অব কথাছবি প্রোডাকশনস। ছবি শেষ হওয়ার পর দেবু তাকে বললেন, আমাকে কি সিনেমায় কোনো কাজ পাইয়ে দিতে পারেন? তিনি বললেন, নিশ্চয়ই পারব। হাতিরপুলের একটি ঠিকানা দিয়ে বললেন, কাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
দেবু পরের দিন তার সঙ্গে দেখা করলেন। ভদ্রলোক তাকে নিয়ে গেলেন ইন্দিরা রোডে জলিল সাহেবের বাড়িতে। বসার ঘরে প্রধান সহকারী পরিচালক ফখরুল আলম বসেছিলেন। ভদ্রলোক ফখরুল আলমকে ধরে বসলেন, চট্টগ্রাম থেকে এসেছে ছেলেটা। আপনাদের প্রোডাকশনের সহকারী করে নেন। কিছুক্ষণ পর জলিল সাহেব ঘরে ঢুকলেন, জানতে চাইলেন ছেলেটি কে? ফখরুল আলম সবিস্তার বর্ণনা করে তাকে একটা কাজ দেওয়ার অনুরোধ জানান। জলিল সাহেব জানতে চাইলেন, কত বেতন চাও? দেবু বললেন, আপাতত খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা হলেই চলবে। পরে আপনারা যা বুঝবেন তাই দেবেন।
ওস্তাদ বশীর হোসেন
সালাহউদ্দিন থাকতেন ৬১ নং কাজী আলাউদ্দিন রোডে। তিনতলা ভবনটির দোতলায় ছিল 'যে নদী মরু পথে'র প্রযোজক কামাল রহমানের অফিস আর ভবনের বিভিন্ন তলায় পরিচালকসহ ক্যামেরাম্যান সাধন রায়, কমেডিয়ান হীরালাল রায় প্রমুখ থাকতেন। দেবুরও সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো। সূর্যস্নানের শুটিং চলাকালে সালাউদ্দিন চলে আসেন ১ নং ইন্দিরা রোডে। দেবুও এলেন পিছু পিছু। শুটিং শেষ হলে সম্পাদনা সহকারীর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো দেবুকে। সম্পাদক ছিলেন বশীর হোসেন, চিত্রসম্পাদনা শিল্পে তার ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
দেবু খুব মনোযোগ দিয়ে সম্পাদনার কাজ শিখতে লাগলেন। সেটা ছিল চলচ্চিত্রের লিনিয়ার বা অ্যানালগ আমল। ৩৫ মিমি রিল দিয়ে শুটিং হতো। ক্যামেরা, প্রসেসিং ল্যাব, এডিটিং, সাউন্ড মিক্সিং, কালার গ্রেডিং মেশিন সবই ছিল অ্যানালগ। হাতে ধরে ধরে সব কাজ করতে হতো। বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (বিএফডিসি বা এফডিসি, ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা, চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু ১৯৫৯ সালে) বয়সও তখন বেশি নয়। তবে উদ্যম, উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। এফডিসির প্রথম অপারেটিভ ডিরেক্টর নাজির আহমেদ জার্মানি থেকে মানসম্পন্ন সব যন্ত্রপাতি এনেছিলেন, যা সে সময় ভারতেও ছিল না। এরই ফলশ্রুতিতে জহির রায়হান দুই পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র 'সঙ্গম' তৈরি করতে পেরেছিলেন ১৯৬৪ সালে।
এডিটিং টেবিলে তৈরি হয় ছবি
অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধা মনে করেন, চলচ্চিত্র তৈরি হয় সম্পাদন টেবিলে; যদিও চিত্রগ্রহণ, ফিল্ম প্রসেসিং, শব্দ সংযোজনা কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সম্পাদনার গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে এখানে খণ্ড খণ্ড সব ভাবনাকে জোড়া দেওয়া হয়। ফিল্ম রিল এক্সপোজ হওয়ার পরে তা ল্যাবে পাঠিয়ে ডেভেলপ করা হয়। তারপর আনা হয় এডিটিং টেবিলে। সহকারী পরিচালক ও সহকারী সম্পাদক একসঙ্গে বসে তখন সর্টিং করতে থাকে। সর্টিং হলো ওকে থেকে নট গুড (এনজি) শটগুলো আলাদা করা। এনজি কেটে বাদ দেওয়ার পর ওকে শটগুলো সিমেন্ট নামের এক ধরনের আঠা দিয়ে জোড়া দেওয়া হয়। পরে তা আবার পাঠানো হয় ল্যাবে। আবার ডেভেলপ করিয়ে নিয়ে আসার পর শুরু হয় আসল সম্পাদনা। গল্পটি তৈরি করা হয় এ পর্যায়ে। তারপর হয় ডাবিং। সংলাপ ও এফেক্ট সাউন্ড জুড়ে দিয়ে সাউন্ড ট্র্যাক তৈরি সম্পন্ন হয়। সবশেষে সাউন্ড ও পিকচার ট্র্যাক মার্জ (অঙ্গীভূত) করে সিনেমা হলে প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। সম্পাদকের সামান্য ভুলে মূল নেগেটিভও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই সহকারী থেকে সম্পাদক হয়ে উঠতে লেগে থাকতে হয়।
বশীর হোসেনের (ওস্তাদ) সঙ্গেও লেগে থেকেছেন দেবু। স্যারকে বুঝিয়ে ওস্তাদকে ইন্দিরা রোডের বাড়িতে এনে রেখেছেন। বছরখানেকের মাথায় দেবু সহকারী সম্পাদক হিসাবে এহতেশাম-মুস্তাফিজের প্রোডাকশন হাউস লিও ফিল্মসে যোগ দেন ৭৫ টাকা বেতনে। এফডিসিতে তখন এডিটিং মেশিন ছিল ৭টি। চলচ্চিত্রের শুটিং থেকে এডিটিং, সাউন্ড মিক্সিং সবই হতো এফডিসিতে। ফিল্ম রিল পাওয়া যেত কেবল এফডিসিতেই, ক্যামেরাও ছিল এফডিসির, এখানকার ফ্লোরেই বানানো হতো সেট। মানে একটি ছবির এ টু জেড প্রায় সব কাজ হতো এফডিসিতে। বারী আর বেঙ্গল নামে দুটি প্রাইভেট স্টুডিও হয়েছিল আরও কিছুকাল পরে।
সুমিতা দেবী গান দেখতে চেয়েছিলেন
ভালোই চলছিল লিও ফিল্মসে। এহতেশামের পরিচালনায় 'চান্দা' ছবির সম্পাদনা শেষ করার পর, একই বছর নতুন সুরও করলেন। মাসে পঁচাত্তর টাকা সে আমলে কম টাকা নয়। কিন্তু এর মধ্যে একদিন ওস্তাদ বললেন, তোমার আর লিও ফিল্মসে কাজ করা চলবে না। পাছে রেগে যান এই ভয়ে কারণ জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেননি। ইন্দিরা রোডের বাসায় ফিরে স্যারের উপস্থিতিতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন ওস্তাদকে। কিন্তু ওস্তাদ কোনোভাবেই সিদ্ধান্ত বদলালেন না। শেষে চাকরিটি ছেড়েই দিতে হলো দেবুকে। এই পর্যায়ে ওস্তাদের সহকারী হিসাবে যখন যা পান, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। শেষে একদিন ওস্তাদের সঙ্গেও মনোমালিন্য হলো, কারণ অবশ্য সামান্য, 'দুই দিগন্ত' ছবির সম্পাদনার কাজ চলছিল, সুমিতা দেবী একদিন এসে একটি গান দেখতে চাইলেন, দেবু তাকে নিষেধ করতে পারেননি, ওস্তাদের রাগের এটাই ছিল কারণ। শেষে তিক্ততা এতই বেড়ে গেল যে দেবুকে নিজের পথ দেখে নিতে হলো। তবে এটা তার জন্য শাপে বর হয়ে দেখা দিল। এর মধ্যে তিনি সম্পাদক হিসাবে পাকা হয়ে উঠেছেন আর সংশ্লিষ্টরা তার পরিচয়ও পেয়ে গেছে। তাই 'ম্যায় ভি ইনসান হু', 'ভাগ্যচক্র', 'ঘূর্ণিঝড়' ছবির কাজ করতে থাকলেন একে একে। ভরপুর কাজের সময় ছিল সেটা। তিন শিফটে কাজ চলত এফডিসিতে। একটানা দুই-তিন দিনও কাজ করেছেন, বাসায় ফেরার সময় করতে পারেননি। কলাকুশলীদের বেশির ভাগই কিন্তু এফডিসির স্টাফ ছিলেন না, প্রযোজক বা পরিচালকেরা তাদের নিযুক্ত করতেন এবং সম্মানীও তারাই দিতেন।
যুদ্ধ শুরু হলো
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত দেবু ৬-৭টি ছবি সম্পাদনা করেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালালে তিনি ঘরে বন্দী হয়ে রইলেন ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত। কারফিউ যখন শিথিল হলো, তিনি নদী পেরিয়ে জিনজিরা চলে গেলেন। সেখানে দুই রাত কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। চার দিন হেঁটে পৌঁছালেন নালাপাড়ার বাসায়। গিয়ে দেখেন সব লন্ডভন্ড, বাবার কোনো খবর নেই। বেশি দেরি না করে আবার হাঁটা দিলেন। দেড় দিন পার করে পৌঁছালেন ফেনী। ফেনীতে জেনিথ কেমিক্যাল নামে তাদের একটি ল্যাবরেটরি ছিল। বাবা উষারঞ্জন সেনগুপ্তকে সেখানে পাবেন বলে ভেবেছিলেন। না পেয়ে পাশের ওষুধের দোকানে খোঁজ নিলেন। দোকানদার জানালেন, উষাবাবু তো তোমার পিসির বাড়ি চলে গেছে। আরও আধা বেলা হেঁটে পৌঁছালেন পিসির বাড়ি। রাত কাটিয়ে বাবাকে নিয়ে বিলোনিয়া সীমান্ত হয়ে চলে গেলেন আগরতলা। সেখান থেকে কলকাতা। ব্যারাকপুরে থাকতেন দেবুর বড় ভাই ও বোন।
'আমরাও সেখানে গিয়ে উঠলাম। পার্ক সার্কাসে ছিল বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস (১৮ এপ্রিল যেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়ে গিয়েছিল)। সেটিকে ঘিরে পুরো এলাকাটা একটি মিনি বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিনই যেতাম। একদিন আমাদের এফডিসির একজন প্রোডাকশন কন্ট্রোলার, নাম চিত্তবর্ধন, বললেন, তোকে জহির সাহেব খুঁজছেন। তখন জহির রায়হান, আলমগীর কবির এবং আলী যাকের আনোয়ার শা রোডের একটি তিনতলা বাড়ি ভাগাভাগি করে থাকেন। আমি গিয়ে জহির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, আমরা ছবি বানাব। যোগাযোগের মধ্যে থাকবেন, দরকার হবে।
'আমি সম্মতি দিয়ে চলে এলাম। মুজিবনগর সরকার গঠন হয়ে গেছে ১৭ এপ্রিল। চলচ্চিত্র বিভাগ রাখা হয়েছে সরকারের তথ্য, প্রচার ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবুল খায়ের এমএনএ চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান, যিনি ইস্টার্ন ফিল্মসেরও স্বত্বাধিকারী। চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ছিলেন 'মুখ ও মুখোশ' নির্মাতা আব্দুল জব্বার খান। পার্ক সার্কাসে গেলে হাসান ইমাম, আজমুল হুদা মিঠু প্রমুখ অনেকের সঙ্গেই দেখা হতো। হাসান ইমাম বাংলাদেশ শিল্পী ও কুশলী সমিতি নামে একটি সংস্থা গড়ে তুললেন, জহির রায়হান ছিলেন এর সভাপতি, হাসান ইমাম সাধারণ সম্পাদক। সমিতি গঠনের মধ্য দিয়ে ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন বা ইমপার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত হলো। বেঙ্গল মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিএ) মারফত ইমপা আমাদের কিছু অনুদান দিল। খায়ের ভাইও কিছু অর্থ জোগাড় করে দিলে আমরা মাঠে নেমে গেলাম।' বলছিলেন দেবব্রত সেনগুপ্ত।
সমিতির সদস্য ১৩৩ জন
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নালে প্রকাশিত মীর শামছুল আলম বাবুর নিবন্ধ 'বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের ভূমিকা' থেকে জানা যাচ্ছে, সমিতির কাজ ছিল মূলত পূর্ব বাংলা থেকে আসা চলচ্চিত্রশিল্পী ও কলাকুশলীদের খাদ্য, বাসস্থান ও মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা। বিএমপিএ সমিতিকে এ বাবদ মাসে পনেরো হাজার টাকা সাহায্য দিত। এ টাকা থেকে চলচ্চিত্রকর্মীদের মধ্যে যারা পরিবার নিয়ে এসেছিলেন, তারা মাসে পেতেন ২০০ টাকা এবং যারা একা ছিলেন, তারা পেতেন ১০০ টাকা। সমিতির ভাতা ও সহায়তাপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন ১৩৩ জন।
সমিতির উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য চারটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা, যার প্রথমটি 'স্টপ জেনোসাইড'। এর পরিচালক জহির রায়হান গণহত্যাকে বিষয় নির্বাচন করেন এবং প্রকাশ করতে চাইলেন ভিয়েতনাম বা আলজেরিয়ায় সংঘটিত গণহত্যার চেয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কোনো অংশেই কম কিছু করছে না। ছবিটিতে তিনি তাদের নৃশংসতা, শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরলেন। বীর বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকেও তিনি উপস্থিত করলেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার দাবি রাখল স্টপ জেনোসাইড। ছবিটির ক্যামেরাম্যান ছিলেন অরুন রায়।
একাই সামলেছেন দেবব্রত সেনগুপ্ত
চলচ্চিত্র গবেষক শামছুল আলম বাবু বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, 'যে চারটি ছবির কথা আমরা বলছি, তার মধ্যে জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন স্টপ জেনোসাইড এবং আ স্টেট ইজ বর্ন। লিবারেশন ফাইটার্স করেছিলেন আলমগীর কবির এবং ইনোসেন্ট মিলিয়নসের পরিচালক ছিলেন বাবুল চৌধুরী। ক্রেডিটলাইনে প্রথম তিনটি ছবিরই ক্যামেরাম্যান অরুন রায়। ইনোসেন্ট মিলিয়নসের ক্যামেরাম্যান হিসাবে পাচ্ছি সাধন রায়কে। আমরা পশ্চিমবঙ্গের হরিসাধন দাশগুপ্ত এবং কমল নায়েকের কথাও জানতে পেরেছি, যারা দৃশ্যধারণে ভূমিকা রেখেছেন। সেটা তো স্বাভাবিক সময় ছিল না, যাকে যখন পাওয়া যাচ্ছে, তাকে নিয়েই রওনা হয়েছেন পরিচালক অথবা যে যা তুলে এনেছে, সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিল্পী, কলাকুশলীই তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে এডিটিং টেবিল ও মেশিন বলতে গেলে এক হাতেই সামলেছেন দেবব্রত সেনগুপ্ত।'
জহির রায়হান বলেছিলেন, দেবু যা ফুটেজ পাবেন, সব ডেভেলপ করে ফেলবেন। ডেইলিরটা ডেইলি। এখানে কোনো এনজি নেই। কারণ, সবই প্রতিরোধ, সংগ্রাম, শরণার্থী, নিপীড়ন, রণাঙ্গন নিয়ে। কোনোটাই ফেলার নয়। এ ছবিতে কাজে না লাগলে অন্য ছবিতে লাগবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও দলিল হিসেবে থেকে যাবে। জহির রায়হান আরও বলেছিলেন, দেবু দিনে আমাকে পাবেন না, রাতে আপনার সঙ্গে বসব।
টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্স ওয়ানে ফুটেজ প্রসেস করাতেন দেবু। সম্পাদনার কাজ করেছেন মূলত ফিল্ম সার্ভিসে। টেকনিশিয়ানসেও করেছেন কিছু। সবগুলোই প্রাইভেট স্টুডিও। ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া গুনে কাজ করিয়ে আনতেন। দেবু বলছিলেন, 'টালিগঞ্জের প্রাইভেট স্টুডিও ফিল্ম সার্ভিস হয়ে উঠল আমার কর্মক্ষেত্র। ফিল্ম সার্ভিসে আমাদের একটি আলমারিও ছিল, যেখানে ফিল্ম ক্যান, নেগেটিভ, পজিটিভ, সিমেন্টের বোতল সব রাখতাম।' আলমগীর কবির ২০ মিনিট ব্যাপ্তির চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইডের ধারা বর্ণনা রচনা ও পাঠ করেন ইংরেজি ভাষায়।
স্টপ জেনোসাইড পথ খুলে দিল
স্টপ জেনোসাইড একাত্তরের আগস্টে সম্পন্ন হয়েছে। আলমগীর কবিরের একটি চিঠি অনুযায়ী তারিখটি ২৮ আগস্ট। চলচ্চিত্র প্রযোজক ফজলুল হকের এক আবেদনপত্র থেকে বোঝা যায়, ছবিটির প্রাইভেট বা ঘরোয়া একটি প্রদর্শনী হয়েছিল ৭ সেপ্টেম্বর। ১৩ সেপ্টেম্বরের পরের কোনো দিনে মুজিবনগর সরকারের ফুল কেবিনেট চলচ্চিত্রটি দেখে অনাপত্তিপত্র তথা ছাড়পত্র দেন। জনসাধারণের মধ্যে প্রথম প্রদর্শনী সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে কথাশিল্পী শওকত ওসমানের একটি স্মৃতিচারণায় ২৭ সেপ্টেম্বরের উল্লেখ আছে। সেদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অনেকের সঙ্গে তিনি ছবিটি দেখেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তরকে ছবিটি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কিনে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালাতে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে চলচ্চিত্রটি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন।
দেবু বলেছেন, 'স্টপ জেনোসাইড ভারতের নামকরা সব চলচ্চিত্রকার যেমন সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন প্রমুখ দেখেছেন এবং আপ্লুত হয়েছেন। যে উদ্দেশ্যে ছবিটি করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি সার্থক হয়েছিল বলেই আমি মনে করি।'
দেবু আরও বলেছেন, 'স্টপ জেনোসাইড ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করলে প্রবাসী সরকার আরও অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এ প্রেক্ষিতে আলমগীর কবিরের মধ্যস্থতায় জহির রায়হানের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আব্দুল মান্নান এমএলএর ফলপ্রসূ বৈঠক হয় এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কথাও বলা হয়। সে অনুযায়ী জহির রায়হান ৫টি প্রামাণ্যচিত্র এবং একটি কাহিনিচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা জমা দেন। সব মিলিয়ে বাজেট গিয়ে দাঁড়ায় আড়াই লক্ষ টাকার বেশি। বাংলা, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হবে বলে পরিকল্পনায় লেখা ছিল। কিন্তু প্রবাসী সরকার তিনটি বিশ মিনিটের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিলে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়। অর্থসহ আরও সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রাঙ্গনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ফলে নভেম্বরের শেষ দিকেই ছবি তিনটির নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।'
জহির ভাই রেগে গিয়েছিলেন
'এ স্টেট ইজ বর্ন' ছবিটির শুরু ১৯৪৭ সাল। তারপর ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় প্রামাণ্যচিত্র, আলোকচিত্র বা চিত্রকলার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন-সংগ্রাম এবং তার অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সকলের সাক্ষাৎকার নেন জহির রায়হান।
দেবু বলছিলেন, খন্দকার মোশতাকের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় জহির ভাই (জহির রায়হান) খুবই রেগে যান। কারণ, একপর্যায়ে মোশতাক বলে ফেলেন, এসবই বেকার। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা হয়ে যাবে কিছুদিন পরই। আপনারা শুধু শুধু দৌড়ঝাঁপ করছেন। শুনে জহির ভাই রেগে গিয়ে বলেন, এতগুলো নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হলো, উদ্বাস্তু হয়েছে কোটি মানুষ আর আপনি বলছেন সমঝোতা হয়ে যাবে? সবই বেকার!
এ ছবিরও ধারাবর্ণনা রচনা ও পাঠ করেন আলমগীর কবির। ছবিটির দৈর্ঘ্য ২০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড।
লিবারেশন ফাইটার্সের বিষয় ছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অপারেশন। বীর বাঙালির প্রতিরোধচিত্র এতে ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে নেওয়া মুক্তাঞ্চলের ছবিও রয়েছে। ১৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটির চিত্রনাট্য, ধারাবর্ণনা রচনা ও পাঠ এবং পরিচালনা আলমগীর কবিরের।
বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ইনোসেন্ট মিলিয়নসের বিষয় শরণার্থী শিশু। বিষয়ের দিক থেকে ছবিটি ব্যতিক্রমী। ছবিটির দৈর্ঘ্য ১৯ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। স্টপ জেনোসাইডসহ চারটি ছবিরই প্রোডাকশন কন্ট্রোলার ছিলেন চিত্তবর্ধন।
চাবি দিয়েছিলেন আলমগীর কবিরকে
প্রতিটি ছবির দুটি করে ফাইনাল প্রিন্ট নেওয়া হয়েছিল বলে মনে করতে পারেন দেবু। ফুটেজগুলো ফিল্ম সার্ভিসের আলমারিতে তালাবদ্ধ করে চাবি সঙ্গে করে তিনি ঢাকায় চলে এসেছিলেন বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে। ৮০০০ ফুট অব্যবহৃত নেগেটিভও আলমারিতে রেখে এসেছিলেন তিনি। দেশে ফিরে আসার পর আলমগীর কবিরের 'ধীরে বহে মেঘনা ছবি'র সম্পাদনা কাজে যুক্ত হন। ছবিটির প্রযোজক আজমল হুদা মিঠুর অনুরোধে আলমারির চাবি তিনি আলমগীর কবিরকে দিয়েছিলেন।
দেবু জানাচ্ছেন, ফিল্ম সার্ভিসেস স্টুডিওর দুটি চালান পাওয়া গেছে, তা থেকে বোঝা যায় ইনোসেন্ট মিলিয়ন, লিবারেশন ফাইটার্স এবং এ স্টেট ইজ বর্নের একটি করে কপি জনাব আবুল খায়ের এমএনএ গ্রহণ করেছেন। আর স্টপ জেনোসাইডের মূল নেগেটিভ বাংলাদেশ সরকারকে উপহার দিয়েছিল চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি। ঢাকায় চারটি ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হোটেল পূর্বাণীতে। এরপরও ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়ে থাকবে, তবে সংরক্ষণের পর্যাপ্ত উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। ১৯৮৮ সালে শর্টফিল্ম ফোরাম আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবেও ছবি চারটি একসঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে।
সুখেই আছেন দেবু
সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে লিবারেশন ফাইটার্স ব্যতিত অন্য তিনটি ছবি সংরক্ষিত আছে। শামসুল আলম বাবু লিবারেশন ফাইটার্সের একটি কপি গলিত অবস্থায় ফোরামের গুদাম থেকে উদ্ধার করে লন্ডন পাঠিয়েছেন পুনরুদ্ধারের জন্য। এফডিসি চলচ্চিত্রের গবেষক সুইডিশ লটে হক এবং ব্রিটিশ-বাঙালি লায়লা উদ্দিন এর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ছবিটি পুনরুদ্ধারে ৬০০০ ইউরো প্রয়োজন।
দেবু দেশে ফেরার পর আর খুব বেশি ছবি সম্পাদনা করেননি। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করতে থাকেন। আগের বছর তিনি প্রেমে পড়েন, এ সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একাশি বছর বয়সী মানুষটি এখনো শক্ত-সমর্থ, আবু মুসা দেবু নামে চলচ্চিত্রপাড়ার সবাই তাকে চেনে, এখনও বাসে চড়ে সারা ঢাকা ঘুরে বেড়ান। তিনি চিত্রসম্পাদক সমিতির সভাপতি। কন্যার বিয়ে দিয়েছেন, স্ত্রী ও দুই পুত্র নিয়ে ঢাকার শেওড়াপাড়ায় সুখে বসবাস করছেন।