বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান: আত্মোৎসর্গ যাকে দিয়েছে অমরত্ব
১৯৭১—বাংলাদেশ নামক দেশটির সঙ্গে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে সালটি। দীর্ঘ নয় মাসব্যপী মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে এই সালে। আমাদের জাতীয়তাবাদ জানান দেয় তার অস্বিত্ব, যার জ্বালানি হিসেবে ছিল দশকের-পর-দশক ধরে চলে আসা দমন এবং অবহেলা।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম পদক্ষেপের কারণে তূলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবে চলে আসা প্রতিবাদ থেকে জন্ম নেয় সর্বগ্রাসী বিদ্রোহের, পরিণত হয় মুক্তির আন্দোলনে। এই লড়াইয়ের অগ্রভাগে ছিল প্রাক্তন সৈনিক এবং বেসামরিক জনসাধারণকে নিয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনী। তাদের অদম্য সাহস আর নিঃস্বার্থ বলিদানে অবশেষে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদাররা।
নানা পেশা, বয়স আর সামাজিক অবস্থান থেকে আসা মানুষদের সম্মিলনে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীকে দুটো মূল দলে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে ছিল নিয়মিত বাহিনী, যা গঠিত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিত্যাগ করে আসা সৈনিকদের নিয়ে। দ্বিতীয় ভাগে ছিল গণবাহিনী, যেখানে ছিলেন অস্ত্র হাতে নেওয়া বেসামরিক মানুষরা। নিয়মিত বাহিনীতে ছিলেন প্রায় ৫ হাজার সৈনিক, যারা ষষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) ব্যাটালিয়ন ছেড়ে এসে নাম লিখিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
আরও ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ১৬ হাজার সদস্য এবং প্রায় ৪৫ হাজার পুলিশ। ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে চলতে থাকা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল এই বাহিনীর সদস্যদের মনেও। তাই এ বাহিনীর প্রায় সবাই-ই, বিশেষ করে পদাতিক সৈন্য, এনসিও (নন-কমিশনড অফিসার) এবং জুনিয়র অফিসাররা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য লড়তে মানসিকভাবে আগে থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
স্বাধীনতার প্রতি বাংলাদেশের মানুষদের অদম্য স্পৃহার এক অনন্য প্রমাণ বলা যায় মুক্তিযুদ্ধকে। তারও আগে থেকে এই দেশের মানুষ বারবার দেখিয়ে দিয়েছে—স্বৈরতন্ত্রের সামনে তারা কখনোই মাথা নত করবে না; যার প্রমাণ আমরা আজও দেখে চলছি।
স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন কত জানা-অজানা টগবগে তরুণ। এমনই এক দুঃসাহসী তরুণ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা অবিচারের শিকার হতে হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে।
বীরশ্রেষ্ঠ: বাংলাদেশের বীর সেনানিরা
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মাননা হলো বীরশ্রেষ্ঠ। বীরশ্রেষ্ঠ পদক সম্মাননার দিকে দিয়ে আমেরিকার মেডেল অভ অনার কিংবা ব্রিটেনের ভিক্টোরিয়া ক্রসের সমতুল্য। সর্বমোট সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গের অভাবনীয় উদাহরণ হয়ে আছেন ।
এই সাতজন বীর চরম প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়েও তাদের সাহস, শৈর্য আর মহান মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন; যাদের দেখে আজও আমরা অনুপ্রাণিত হই।
সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রত্যেককে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়, কেননা তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিলেও স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি; রণক্ষেত্রে তার আগেই শহিদ হন। মাত্র একবার এই সম্মাননা ঘোষিত হয়েছিল, সেটাও ১৯৭৩ সালে । এরপর আর কেউ এই সম্মাননা পাননি। জাতির ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর, সরকারি গেজেটের মাধ্যমে।
সাতজন বীরশ্রেষ্ঠই তাদের বীরত্বে অনন্য। তবে তাদের মাঝেও কমবয়স, সাহস আর আত্মোৎসর্গের মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নামটি চিরঅম্লান হয়ে রইবে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার অধীন ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি দখলের যুদ্ধে যে বীরত্ব তিনি দেখিয়েছেন, তার ফলশ্রুতিতে তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
একজন ক্ষণজন্মা
ক্ষণজন্মা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের পরিবার বাস করত পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগনা জেলায়। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হয়, পুরো পরিবারটি এক অকিঞ্চিৎকর পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে আবিষ্কার করে। তাদের সম্পত্তির পুরোটাই পড়ে ভারতে, বাধ্য হয়ে ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী এলাকা খদ্দখালিশপুরে স্থানান্তরিত হন তারা।
আক্কাস আলি এবং কায়দাতুন্নেসার বড়ো সন্তান হিসেবে খদ্দখালিশপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান এবং বীরত্বের প্রতি সম্মান জানাতে পরবর্তীতে গ্রামটির নামকরণ করা হয় হামিদ নগর।
পাঁচ ভাইবোনের মাঝে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ হামিদুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। তারপর দারিদ্রের কষাঘাতে বাধ্য হন স্থানীয় একটা নৈশ স্কুলে নাম লেখাতে। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে বেড়ে ওঠায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে সামরিক বাহিনীতে নাম লেখাতে হয় ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সিপাহি হিসেবে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। যেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং শহিদ
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা হামলে পড়ে অসতর্ক, নিরস্ত্র জনতার ওপর। এরপরই তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নাম লেখায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তবে হামিদুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন, কর্মক্ষেত্র থেকে গ্রামে ফিরে সেখান থেকে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। অতঃপর সেখান থেকে সেক্টর আটে চলে আসেন। ১৮তম জন্মদিনের মাত্র কয়েকদিন আগে ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিয়ে জীবন হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীনের লড়াইয়ে নাম লেখান হামিদুর রহমান।
সেক্টর আটের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ছিল ধলাই বর্ডার আউটপোস্ট। মুক্তিবাহিনীর জন্য এই সীমান্ত ফাঁড়িটা দখল করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই ভার পড়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি সি-এর ওপর, যার সদস্য ছিলেন হামিদুর রহমান।
ধলাই ফাঁড়ি নিয়ে ২৪ অক্টোবর রাত থেকে শুরু করে ২৭ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে খণ্ডযুদ্ধ। তবে ফলাফল মুক্তিবাহিনী বা পাকিস্তানি হানাদার—কারও পক্ষেই আসেনি। ২৭ অক্টোবরের সন্ধ্যায় যোদ্ধাদের তিনটি প্লাটুন রাতের আঁধারে আত্মগোপন করে এগিয়ে যায় আউটপোস্টের দিকে।
শত্রুবাহিনীর কাছাকাছি আসার পর অতর্কিত আক্রমণ চালাবার জন্য প্রস্তুতি নেন মুক্তিযোদ্ধারা। তবে তার আগেই অপ্রত্যাশিতভাবে একটা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরিত হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ফাঁস হয়ে শত্রুপক্ষের কাছে। জবাবে অন্ধের মতো গুলি ছুড়তে থাকে তারা।
কয়েক ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে যুদ্ধ। তবে উত্তরপূর্ব দিক থেকে আসা লাইট মেশিনগানের গুলিবৃষ্টির কারণে মুক্তিযোদ্ধারা এগোতে পারছিলেন না। এদিকে হাল ছাড়ার মানসিকতাও তাদের মাঝে নেই। তাই জায়গা থেকে হটার কথা কারও মাথায় আসেনি। হামিদুর রহমানও ছিলেন এই দলে। জানতেন, শত্রুপক্ষ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে। অথচ ফাঁড়িটা দখল করাও জরুরি।
অবশেষে হামিদুর রহমান আর তার ১২৫ জন সহযোদ্ধা মিলে সিদ্ধান্ত নেন, গ্রেনেড ছুড়ে শত্রুবাহিনীকে প্রতিহত করবেন। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্বটা হামিদুর রহমান তুলে নেন নিজের হাতে। বুকে হেঁটে রুক্ষ জমিনের ওপর দিয়ে এগিয়ে সফলতার সঙ্গে দুটো গ্রেনেড ছোড়েনও। …কিন্তু তারপরই হানাদারদের ছোড়া একটা গুলি এসে লাগে তার গায়ে।
আহত অবস্থায়ই হামিদুর রহমান ছুটে যান শত্রুর মেশিনগানের দিকে। সেখানে যে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য প্রহরা দিচ্ছিল, তাদের সঙ্গে শুরু করেন হাতাহাতি লড়াই। একপর্যায়ে মেশিনগানটিকে চুপ করিয়ে দিতেও সমর্থ হন। নিজের শারীরিক অবস্থার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই লড়তে থাকেন হামিদুর রহমান। তার এই বীরত্বের কারণে আক্রমণকারী মুক্তিবাহিনীর সহযোদ্ধারা এবার নিরাপদে অগ্রসর হন।
যুদ্ধে জয় হয় মুক্তিবাহিনীর, কিন্তু সেই বিজয় দেখে যেতে পারেননি হামিদুর রহমান। ধলই সীমান্তের এই ফাঁড়ি দখল করার পর সহযোদ্ধারা আবিষ্কার করেন হামিদুর রহমানের প্রাণহীন দেহ।
হামিদুর রহমানের মরদেহ তার সহযোদ্ধারা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। ঘটনাস্থলের প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে, ত্রিপুরার আমবাসায় শায়িত হন তিনি। তার আত্মোৎসর্গের প্রতি সম্মান জানাতে ধলই সীমান্তে স্থাপিত হয় একটা স্মৃতিসৌধ
কথিত আছে, পাকিস্তানি বাঙ্কারের বিশ ফুট দূরে একটা খালের পাশে হামিদুর রহমানকে শেষ জীবিতাবস্থায় দেখা গিয়েছিল। সেই স্থানটিকেই স্মৃতিসৌধের স্থান হিসেবে বাছাই করা হয়। তবে বন্যার কারণে কবরটি ডুবে গেলে মরদেহের পুরোটা পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, হামিদুর রহমানের মরদেহ সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে এনে আরেক বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের মরদেহের পাশে দাফন করা হবে। ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ফিরিয়ে আনা হয় তার দেহাবশেষ, চিরনিদ্রায় অবশেষে তিনি শায়িত হন তার প্রিয়, স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
খুবই অল্পবয়সে শহিদ হলেও, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বীরত্ব আজীবন অম্লান হয়ে রইবে স্বাধীনতার ইতিহাসে। তিনি যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতারই মূর্ত প্রতীক, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার উদাহরণ।
- মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ: গবেষক, চিকিৎসক, লেখক, অনুবাদক
তথ্যসূত্র:
1. Jamal, Ahmed Abdullah. 2008. "Mukti Bahini and the Liberation War of Bangladesh: A Review of Conflicting Views." Asian Affairs 30 (4): 5–17.
2. Van Schendel, Willem. 2020. A History of Bangladesh. Cambridge University Press.
3. Akmam, Wardatul. 2002. "Atrocities against Humanity during the Liberation War in Bangladesh: A Case of Genocide." Journal of Genocide Research 4 (4): 543–59.