সমতলের চা-শিল্প: শখের চায়ে শোকের ছায়া, অসহায় চাষী
২০২২ সালের নভেম্বরে পঞ্চগড়ের চাষী শাহজালাল আক্ষেপ করে বলেছিলেন চা শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এক বছর পরে এসে যেন সেই চিত্র দৃশ্যমান হলো। অনেক চাষীই এখন চা বাগান উপড়ে ফেলছেন। অনেকে চা বাগান তুলে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
শাহজালালের বাড়ি পঞ্চগড় সদরে। চা বাগান করেন ১৫ বছর ধরে বোদা উপজেলার তেপুকুরিয়া এলাকায়। শুরু থেকেই প্রায় লোকসানের মুখে। জানান, চা বোর্ডের কর্মকর্তাদের কথা শুনে লাভের আশায় থাকেন চাষীরা। কিন্তু লাভের মুখ দেখতে পান না। বাধ্য হয়ে চা বাগান কেটে মসলা ও আমের চাষ শুরু করেছি।
গত মাসে ৭ একর জমির চা বাগান উপড়ে ফেলেছেন তিনি। এরপর বাগানেই দুধ দিয়ে গোসলও করেছেন। লোকসানে থাকা এই চাষী বলেন, চা বাগান এখন পঞ্চগড়ের গলার কাঁটা।
শাহজালার বলেন, "কৃষক না বাঁচলে সমতলের চা বাগানের সৌখিন শিল্প দিয়ে কী হবে। মাঝখান থেকে শুধু কারখানাগুলো কোটি কোটি টাকা আয় করছে। আর সরকার চা বাগানের কল্যাণে কোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু ক্রমাগত নিঃস্ব হচ্ছেন চাষীরা। শখের চা-য়ে এখন শোকে ছায়া নেমে এসেছে।"
সমতলে চা চাষাবাদ শুরু হয় পঞ্চগড় জেলায় ২০০০ সালে। ক্ষুদ্র পর্যায়ে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি এবং পরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের হাত ধরে বাগান পর্যায়ে চা চাষ শুরু হয়। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয় বাগান পর্যায়ে।
পাঁচটি জেলায় নিবন্ধিত ৯ টি ও অনিবন্ধিত ২১ টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান (২৫ একর পর্যন্ত) রয়েছে ৮ হাজার ৩৩৫টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪৫টির নিবন্ধন রয়েছে। চা বোর্ডের জরিপে এই অঞ্চলে ৪০ হাজার একর জমিতে চা চাষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ রয়েছে।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিস বলছে, ২০২২ সালে পাঁচ জেলায় ৯ কোটি ০২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৩২ কেজি সবুজ চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। জাতীয় উৎপাদনে অবদান ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০২১ সালে পাঁচ জেলায় ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার ৯ কেজি চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। এই উৎপাদনে জাতীয় অবদান ছিল ১৫ শতাংশ। আর অঞ্চলভিত্তিক চা উৎপাদনে দ্বিতীয়। অর্থাৎ সিলেটের পর এখন রংপুর অঞ্চলেই বেশি চা উৎপন্ন হয়।
কিন্তু দাম আর কারখানার কৌশলগত বেড়াজালে আটকে কৃষকদের অবস্থা ভয়াবহ। কেটে ফেলতে হচ্ছে সন্তানের মতো যত্নে বড় করা এই ফসল। গত ২৬ অক্টোবর কয়েক এককের একটি বাগান তুলে ফেলেন পঞ্চগড়ের বড়কামাত এলাকার মো. আবজল হোসেন।
এই চাষী বলেন, "শ্রমিক খরচ, সার, কীটনাশকের খরচে আর কুলাতে পারছি না। এখন অন্য আবাদ করে সংসার চালাবো। বাদাম, শাক-সবজি করে খাবো। আন্দোলন করলে তাদের বিরুদ্ধে তালিকা করা হয়। কোথাও পাতা নেওয়া হয় না। পাতা ফেলে দিতে হয়। সন্তানের মতো লালন পালন করতে হয়। অথচ এগুলো তুলে ফেলতে হচ্ছে। অনেকবার প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না।"
গত ২০ অক্টোবর পঞ্চগড়ের আজিজনগর বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরির উত্তর পাশে চা-চাষী মো. বাসেদ তার তৈরি করা স্বপ্নের ৫০ শতক চা বাগান তুলে ফেলেন। তার ভাষ্য, কাঁচা চা পাতার ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ও উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে তিনি চা-বাগান তুলে ফেলছেন।
চা বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে চাষী মাহমুদুল ইসলাম বলেন, "এই জমি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। আমরা আর পারছি না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ব্যাংকে লোন বেড়েছে। চা পাতার দাম ২০ টাকা কেজি থাকলেও জমি বিক্রি করতে হতো না। ভয়ানক ব্যাপার, এখন চা পাতার দাম প্রতি কেজি ৮ টাকা। এখন বাধ্য হয়ে চা-বাগানসহ ৮০ শতাংশ জমি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
বাগান থেকে চা পাতা তুলে কারখানায় চা (রেডি টি) তৈরি করা হয়। সমতলের চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা লাইসেন্স নিয়েছে ৪৮ টি কারখানা। এ এসব কারখানা চাষীদের কাছ থেকে সবুজ চা-পাতা কিনে চা তৈরি করে। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত এই চা নিলাম বাজারে বিক্রি করেন কারখানা মালিকেরা। কৃষকদের অভিযোগ, এসব কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে চাষীরা দিন দিন লোকসানের দিকে যাচ্ছে।
১৯৬৮ সালে পঞ্চগড় সুগারমিল চালু হয়ে ক্রমাগত লোকসান দেওয়ার পর আসলে এই অঞ্চলে চা শিল্প বিকাশে ছোট পরিসরে আলোচনা শুরু হয়। ওই সময়ে আখ চাষে লোকসানের পর মূলত এই অঞ্চলের চাষীরা চা শিল্পে ঝুঁকে পড়েন। শুরুতে এই শিল্পে সম্ভাবনার হাতছানি দেখে এলেও এখন ভয়নক লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন চাষীরা।
তারা জানান, ভারতের দার্জিলিংয়ের চা বিশ্ব বিখ্যাত। পঞ্চগড়ের চা-য়ের কোয়ালিটিও চমৎকার। কিন্তু সঠিক মূল্য পাওয়া যায় না। এখন এক কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয় ২০ টাকার উপরে। অথচ বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ৮ থেকে টাকায়। এই দামের মধ্যে আবার প্রতি মণে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পাতার দাম কেটে নেয় কারখানাগুলো। আবার কারখানাগুলো বাকীতে পাতা নেয়। শ্রমিক খরচ আছে প্রতি কেজি চা পাতায় ৪ টাকা।
অর্থাৎ বর্তমান বাজারমূল্য আর বিভিন্ন অজুহাতে পাতার দাম কেটে নেওয়ার কারণে চাষীদের পকেটে কোনো টাকা যায় না। সার-কীটনাশাকসহ অন্যান্য খরচের কারণে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঋণের বোঝা।
বাড়ি তেতুলিয়ায় হলেও সদরের টুনিহাট এলাকায় ২০ একর জমিতে চা বাগান করেছেন আজহারুল হক। তিনি জানান, এখন চা বাগান থেকে কিছু পাওয়া যায় না। এখন বাগানে ইনভেস্ট করতে হচ্ছে। ছোট ছোট চাষীরা বাগান উপড়ে ফেলছেন। পাতার দাম না বাড়লে বড় চাষীরা হয়তো আগামী বছরে সব উপড়ে ফেলবেন। অনেকে লসের উপরেই রাখছেন। এর মধ্যেই অনেকেই সার, কীটনাশকের দোকানে অনেক বড় ধরনের নিয়ে বসে আছেন। তাদের কী হবে!
বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানি চাকরি ছেড়ে চা-চাষী হওয়া আজহারুল আরও বলেন, "সত্যিকারের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাদের আর যাওয়া জায়গা নেই। আমার এলাকার বন্ধুবর টুনিহাট কলেজের শিক্ষক শাহাদহ হোসেনের কাছে লীজ নিয়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেননি এক চাষী। এই কারণে তিনি ৭ একর চা বাগান উপড়ে ফেলেছেন। আমিও এই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিক্রয়ডটকম, সেলবাজারসহ অন্যান্য লোকজনকে বলেছি। এখন আর রাখার মতো পরিস্থিতিতে নেই। বাগান আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েও আমার এখন মাসে ৫০ হাজার টাকা খরচ। কতো লোকসান দেওয়া যায়!"
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার এলাকায় ২০১৪ সাল থেকে ২০ একর জমিতে চা বাগান করেন শাহিনুর ইসলাম। তিনি প্রায় ২৫ বিঘার বাগান এর মধ্যে উপড়ে ফেলেছেন। নির্বাচনের পর বাকী অর্ধেক উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বলেন, "শুধু লোকসান হলে রাখা যেতো। কিন্তু এখন টাকার অভাবে চিকিৎসা, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ যোগানো কষ্ট হয়ে পড়েছে। ব্যাংকের লোনের সুদ বাড়ছে। এই কারণে কিছুদিন আগে দেড় বিঘা জমি বিক্রি করেছি। এই পরিস্থিতি প্রায় সবার। কেউ মুখে বলছে, কেউ বলছে না।"
ঢাকা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে শখ করে কয়েক বছর আগে উদ্যোক্তা হয়েছেন প্রকৌশলী মো. মানিক উদ্দিন। চা পাতার দামে ভয়ানক ধসের কারণে খুব চিন্তায় রয়েছেন তিনি। পঞ্চগড়ের ওমরখানা ক্যাম্পে তার চা বাগান। বাগানের পাতা তিনি আর বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছে না। পাতা কেটে বাগানেই ফেলছেন।
মাসে প্রায় অন্তত লাখ টাকা লোকসান দেওয়া এই উদ্যোক্তা জানালেন, দিনের পর দিন লোকসানে আর পারা যাচ্ছে না। এক কেজি পাতা উৎপদনে খরচ ২০ থেকে ২৫ টাকা। অথচ পাতা বিক্রি করে কেজিতে ১ টাকায়ও থাকছে না। এখন ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা করছি।
উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। অথচ চা পাতার দাম কমেছে চার গুণ। ভয়ানক এই পরিস্থিতিতে পড়েছে বড় বাগানগুলোও।
কাঞ্চজঙ্ঘা টি এস্টেটের ম্যানেজার ফায়সাল হোসেন বলেন, "ক্ষুদ্র কৃষকই নয় বড় চাষীরাও সমস্যায় পড়েছেন। নতুন বছরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সবাই। এমন পরিস্থিতি সবার। কিছু করার নেই চাষীদের।"
সমতলের চা নিয়ে কোনো আশার বাণী নেই চা বোর্ডের কাছেও। বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন জানান, দেশে চাহিদার চেয়ে চা উৎপাদন বেশি হচ্ছে। অর্থনৈতিক চাপের কারণে মানুষও চা কম খাচ্ছে। আগে বেশিরভাগ চা আমদানি করা হতো। এই কারণে সরকারের এই খাতে তেমন নজর ছিল না। আবার পঞ্চগড়ের চা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না। হঠাৎ করে চায়ের সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণে দাম কমে গেছে। সব মিলে এই পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন চাষীরা। বাধ্য হয়ে কিছু চাষী চা বাগান কেটে ফেলছেন।