অবসাদের ৬ কারণ এবং এড়ানোর উপায়
অবসাদের কারণে আপনি হয়ত ক্লান্ত অথবা আপনার মধ্যে ভর করেছে অপ্রাপ্তি। আপনার মনে হতে পারে আপনি আপনার কাজের মূল্য পাচ্ছেন না। আপনার মনে হচ্ছে আপনার চাকরি ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু এটা কি আসলেই ভালো কোন সিদ্ধান্ত?
আপনি যেই পরিস্থিতিতে আছেন সেখানে ঠিক কি করতে হবে তা আপনিই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু এমন গবেষণা আছে যা আপনাকে বর্তমান চাকরি টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। আবার আপনি এই ধরনের গবেষণার ফলাফল দেখে বুঝতে পারবেন আপনি বর্তমান চাকরিতে কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং আপনার নতুন চাকরি কি কারণে বেছে নেওয়া উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবসাদকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেডিকেল রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন মডেল দিয়ে অবসাদ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানা যায়। তার মধ্যে একটি মডেলের নাম হলো 'এরিয়াস অফ ওয়ার্ক লাইফ মডেল' (বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিস্টিনা মাসলাক এবং একাডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল পি. লিটারের গবেষণা থেকে নেওয়া)। এই মডেলটি ৬ টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে যা আমাদের মধ্যে অবসাদ তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ হয়ত এইসব ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তনের মাধ্যমে অবসাদ কাটিয়ে চাকরি উপভোগ করে আবার কেউ কেউ হয়ত অবসাদের জন্য চাকরি ছেড়ে দেয়।
এখানে অবসাদের পেছনের ছয়টি কারণ উল্লেখ করার পাশাপাশি এদের সমাধানও দেওয়া হলো।
১. কাজের চাপ
আপনার কাজের চাপের সাথে আপনার কর্মদক্ষতা মিলে গেলে আপনি ভালো ভাবে আপনার কাজ শেষ করতে পারবেন। পাশাপাশি আপনি বিশ্রাম করারও সুযোগ পাবেন। আপনার কর্মক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের জন্যও আপনি যথেষ্ট সময় পাবেন। কিন্তু আপনি যদি কর্মক্ষেত্রে অনেক কাজের চাপ অনুভব করেন তাহলে এই রকম কোনোকিছুই আপনি উপভোগ করতে পারবেন না।
কাজের চাপের জন্য আপনি যদি অবসাদে ভোগেন তাহলে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রতে আপনি কেমন করছেন তা বুঝতে হবে। এই ক্ষেত্রগুলো হলো: সঠিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে চাকরি করা, আপনার কাজকে গুরুত্ব দেওয়া, দায়িত্ব অর্পণ করা, না বলতে জানা এবং চাকরিতে সবকিছুই আপনার মনের মত হবে সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা।
আপনি যদি এইগুলির মধ্যে এক বা একাধিক কাজ না করে থাকেন তাহলে সময় ব্যবস্থাপনায় উন্নতি করার চেষ্টা করুন এবং তারপর দেখুন আপনি কেমন অনুভব করছেন। অনেক ব্যক্তির জন্য বিশেষ করে যারা মানুষকে আনন্দ দিতে পছন্দ করেন তাদের কাজের চাপ কমানোর কিছু সক্রিয় প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের অবসাদের অনুভূতি কমাতে পারে। পাশাপাশি তারা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেতে পারেন।
২. নিয়ন্ত্রণের অভাব
আপনার যদি প্রতিষ্ঠানে প্রভাব কম থাকে, উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট সুযোগ না থাকে এবং আপনার মত প্রকাশের কোন জায়গা না থাকলে আপনার কর্মজীবন আপনার ব্যক্তি জীবনের উপর প্রভাব ফেলবে। যদি আপনার মনে হয় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই তাহলে নিজেকেই প্রশ্ন করুন, "কেন আমার এই রকম অনুভূতি হচ্ছে?" যেমন আপনার বস কি আপনাকে যে কোন সময়েই কল দেয় এবং আশা করে আপনাকে সব সময় কল দিলেই পাওয়া যাবে? অথবা আপনার কর্মক্ষেত্রে যেই সকল সুবিধা দেওয়া হয় সেগুলো আপনার ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য অপর্যাপ্ত?
তারপর নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি কীভাবে এর থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। আপনার বসের সাথে আলাপের মাধ্যমে কি এই সকল সংকটের সমাধান করা সম্ভব? আপনি কি এমন কোন চুক্তিতে আসতে পারেন যার কারণে আপনি সবসময় নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা ভোগ করবেন? অথবা ঠিকঠাক যোগাযোগের মাধ্যমে আপনি নিজের উন্নতি ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার তা পেয়ে যাবেন? ক্ষেত্রগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর আপনি বুঝতে পারবেন কোন জিনিসগুলো আপনার চাকরিতে প্রভাব ফেলে এবং আপনি অনেক চেষ্টা করলেও কোন জিনিসগুলো কখনোই পরিবর্তিত হবে না।
৩. পুরস্কার
আপনি কর্মক্ষেত্রে যে সকল বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ পুরস্কার অথবা স্বীকৃতি পাচ্ছেন তা যদি আপনার পরিশ্রমের সমতুল্য না হয় তাহলে আপনার মনে হবে আপনি আসলে পণ্ডশ্রম করছেন।
এই রকম পরিস্থিতিতে আপনি আসলে খুঁজে বের করতে চাবেন কী করলে আপনি ঠিকঠাক স্বীকৃতি পাবেন। উদাহরণ হিসেবে আপনি বেতন বাড়ানোর কথা বলতে পারেন অথবা চাকরিতে পদোন্নতি চাইতে পারেন। আপনার হয়ত আরও ভালো মূল্যায়নের পাশাপাশি আপনার বসের সাথে হয়ত আরো সময় কাটানো প্রয়োজন। অথবা আপনি আসলে যেই পুরস্কারগুলো পেয়েছেন সেগুলোর ঠিকঠাক সুবিধা ভোগ করা উচিত। পরীক্ষা করে দেখুন আপনি যেই পুরস্কার পাচ্ছেন সেটি কি আপনার জন্য যথেষ্ট এবং এই ধরনের পুরস্কার ভোগ করার মত আপনার আরো সুযোগ আছে কিনা।
৪. সহকর্মী
আপনি কাদের সাথে কাজ করেন? তারা কর্মক্ষেত্রে আপনাকে কেমন সাহায্য করে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনার সহকর্মী কারা হবে তা আপনি নিজে নির্ধারণ করতে না পারলেও তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন হবে সেটা আপনি ঠিক করতে পারবেন। আপনি অন্যদেরকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন তাদের দিন কেমন যাচ্ছে। কাউকে মেইল পাঠিয়ে আপনি তাদেরকে সাধুবাদ জানাতে পারেন তাদের করা কোন কাজের জন্য। অথবা জটিল কোন বিষয় নিয়ে তার সাথে সম্মানজনক ভাবে আলাপ করতে পারেন।
অবসাদ ছোঁয়াচে রোগের মত একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পরতে পারে। তাই আপনার ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য আপনাকে অবশ্যই দলের মনোবল পরিবর্তন করতে হবে। সবকিছু করার পর যদি আপনার মনে হয় আপনার সহকর্মীদের সাথে আসলে আপনার মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় অথবা তারা আসলে নিজেদের উন্নতি ঘটাতে চায় না তাহলে আপনার নতুন চাকরির খোঁজ করাই ভালো।
৫. স্বচ্ছতা
ভেবে দেখুন আপনি কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছ এবং ন্যায়সংগত আচরণ পাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করেন কিনা। উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি আপনার কাজের জন্য ঠিকঠাক স্বীকৃতি পানি নাকি আপনার কাজের কৃতিত্ব অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে এবং আপনি ঠিকঠাক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না? অন্য কেউ কি কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে যেটা আপনাকে দেওয়া হচ্ছেনা?
আপনার যদি মনে হয় স্বচ্ছতার অভাবে আপনি অবসাদে ভুগছেন তাহলে আপনাকে এই নিয়ে কথা বলা উচিত। অনেকসময় মানুষজন তাদের পক্ষপাতের বিষয়ে টের পায় না এবং তাদের কাছে না চাইলে আপনাকে কিছু দিবে না। আপনি বিভিন্ন কাজে আপনার যেই অবদান কিংবা সময় দিচ্ছেন তার জন্য কৃতিত্ব চাইতে পারেন। এবং তারপরও যদি আপনার মনে হয় আপনি ঠিকমতো সাড়া পাচ্ছেন না তাহলে আপনার ভদ্রতার সাথে বিষয়গুলো তাদেরকে বোঝানো উচিত।
৬. মূল্যবোধের অমিল
আপনি যদি কোন জিনিসকে ভালো করে মূল্য দেন কিন্তু আপনার প্রতিষ্ঠান যদি সেভাবে মূল্য না দেয় তাহলে আপনি হয়ত আপনার কাজ করার অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলবেন। আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। যখন আপনি অবসাদের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন তখন আপনাকে ভাবতে হবে আপনার মূল্যবোধের সাথে আপনার প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধের মিল থাকা কতটা জরুরি।
আপনার প্রতিষ্ঠানের যারা প্রধান তারা তাদের মান পরিবর্তন করেছে কিনা তাও বিবেচনা করুন। আপনার চারপাশে দেখুন এবং নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: আমার বস, আমার দল এবং আমার প্রতিষ্ঠানের কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয় এবং সম্পদ বিনিয়োগ করে? তাদের অথবা প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ কি আমার পছন্দ? তারা এই পরিবর্তন মেনে নিতে আগ্রহী? যদি আপনি আপনার মূল্যবোধের ব্যাপারে কঠোর হন এবং প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে আপনার মূল্যবোধের যথেষ্ট পার্থক্য থাকে তাহলে আপনাকে এমন চাকরির সন্ধান করতে হবে যা আপনার মূল্যবোধের সাথে যায়।
অবসাদ মানে আপনি যে শুধুই ক্লান্ত এমনটা নয়। এটি একটি বহুমুখী সমস্যা যার বহুমুখী সমাধান দরকার। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আগে ভাবুন আপনি কি নিয়ে অবসাদে ভুগছেন এবং এর কোন সমাধান আছে কি না। যদি আপনি দেখেন আপনার অনেক চেষ্টার পরও পরিবর্তন সামান্য তাহলে ভেবে দেখেন আপনি কি চাকরিতে থাকবেন নাকি চাকরি ছেড়ে দিবেন।